নারীর যৌনতা যে সমাজে ট্যাবু
প্রকাশ | ২৩ জুন ২০১৭, ২২:৪৭
সুস্থ যৌনতা বলতে যেটা বোঝায়, সেটা আমাদের সমাজে ট্যাবু। ইদানীং আমাদের দেশের কিছু তথাকথিত গোষ্ঠীও এ ট্যাবুটাকে আরো বেশি করে বাক্সবন্দী করতে ব্যস্ত। তাই বারবার সুস্থ যৌনতাকে বিকৃত করে উপস্থাপনা করা হচ্ছে (প্রচার করা হচ্ছে ময়ুর সেক্স করে না, ছেলে ময়ুরের চোখের জল খেয়ে প্রেগন্যান্ট হয় মেয়ে ময়ূর!)। যৌনতাকে যে সমাজ ট্যাবু করে রেখেছে, সেখানে আরো একধাপ এগিয়ে নারীর যৌনতার অধিকার নিয়ে সওয়াল করলে সমাজের স্বঘোষিত কর্তারা যে ছি ছি করে তেড়ে আসবেন, আর সেই তেড়ে আসাতে কিছু পতাকাবাহী তাবেদার শ্রেণীর নারীও যে হাততালি দেবে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। সেই ছি ছি কে উপেক্ষা করেই বাকি লেখাটা লিখছি।
আমাদের প্রচলিত কোনো ধর্মগ্রন্থই নারীকে যৌনতা উপভোগের কোনো বিধান দেয়নি। কোনো ধর্মগ্রন্থের কোথাও বলা হয়নি স্ত্রী যদি যৌনতায় সন্তুষ্টি লাভ না করে তবে স্বামীর পাপ হবে। বরং বিধান দিয়েছে নারীর একমাত্র কাজ স্বামীর যৌনতার আনন্দটুকু নিশ্চিত করা। স্বামী অক্ষম হলেও তাকে ছেড়ে যাওয়ার অধিকার নারীকে দেওয়া হয়নি। যে সমাজে যৌনতা শব্দটাই নিষিদ্ধ, সেখানে কোনো নারী যদি যৌনতার কথা বলে তাকে কি নামে ডাকা হয়, সেটা আমাদের কারোরই অজানা নয়। যাই হোক, সমস্ত বিষয়টাকে ধর্মের ছাঁচে ফেলে এমনভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে যাতে নারীরা নিজেদের জন্য যৌন আনন্দ বলে যে কিছু আছে, সেটার কথা কস্মিনকালেও না ভাবতে পারে।
নারী পুরুষের তুলনায় যৌনতায় কখনোই পিছিয়ে ছিলো না। নারী যে পুরুষের চেয়ে যৌনতায় বেশি সক্রিয় এর অসংখ্য প্রমাণও আছে। 'সেক্স ডিফারেন্স ইন সেক্সচুয়াল ফ্যান্টাসি' বইটি তে এলিস স্যামন্স বলেছেন যৌনতার ক্ষেত্রে নারীরা অনেক সময় পুরুষের তুলনায় ৭ গুণ বেশি সক্রিয় থাকে।
কিন্তু বাস্তবে যৌনতাকে পুরুষ নিজেদের কব্জায় রেখেছে যুগ যুগান্তর থেকে। নারীরও যে কম বেশি যৌনচাহিদা থাকতে পারে সেটা তারা মেনে নিতে পারে না। বিছানায় যে নারী নিজে এগ্রেসিভ ভুমিকা নেয় বা পুরুষটিকে গাইড করতে চায়, তার সেই ডমিনেশন পুরুষটি মেনে নিতে চায় না, অথবা ভাবে নারীটির নিশ্চয় সেক্সের প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে। অতএব কর্তার ইচ্ছাই কর্ম। এবং যৌনতার ক্ষেত্রে পুরুষ তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। বেশিরভাগ পুরুষ নিজের তৃপ্তিটুকুই চায়, সঙ্গিনীও তৃপ্ত কিনা, সে বিষয়ে ফিরেও দেখে না। যা প্রচণ্ড রকমের স্বার্থপরতা। আমাদের সমাজে অনেক নারীই আছেন যারা বছরের পর বছর অতৃপ্ত থেকেও সংসারধর্ম পালন করে যাচ্ছেন। পতি পরমেশ্বরের যৌন চাহিদা যন্ত্রণাদায়ক, বিরক্তিকর হলেও মুখ বুজে, লোকলজ্জার ভয়ে টু শব্দটি করছেন না। কারণ, যুগ যুগ ধরে তাদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আসা হয়েছে। যৌনতা কি সেটা পরিপূর্ণভাবে জানতে দেওয়া হয়নি। অধিকাংশ নারীই জানে না ‘অর্গাজম’ আসলে কি?
ধর্ম, সমাজ, নারীকে ছোট থেকেই পই পই করে শিখিয়ে দিয়েছে, নারীকে নিজের যৌনচাহিদা দমন করে রাখতে হয়, সেটার কথা মুখে বলা পাপ, সেটা যে নারী বলে সে বেশ্যা। বিধবাদের যৌনচাহিদা না হওয়ার জন্য তাদের আমিষ খাওয়া বারণ। যৌন চাহিদা শুধুমাত্র পুরুষের আছে এবং যখন যেভাবে ইচ্ছা তারা সেটা মেটাতেও পারে। তাদের জন্য ঘরও আছে, বাইরেও আছে। মধ্যযুগে কোন এক জায়গায় নাকি পরিবারের পুরুষেরা বিদেশ বিভুঁইয়ে যাওয়ার সময় পরিবারের নারী সদস্যের যোনী তালা দিয়ে যেত। কুমারী মেয়েদেরও বিয়ে না হওয়া অব্দি যোনী তালা দেওয়া থাকত। আমাদের দেশে আক্ষরিক অর্থে তালা দেওয়া হয় না বটে, তবে হাজার হাজার অদৃশ্য শেকল আর তালা নারীকে ঘিরে রাখে। নারী জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি শুধু দিয়েই যাবে, তার চাহিদা, ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে।
ডমেস্টিক ভায়োলেন্স বলতে আমরা শুধু মারপিটকেই বুঝি। কিন্তু যৌনচাহিদা থেকে বঞ্চিত করাও যে একধরনের ডমেস্টিক ভায়োলেন্স সেটা আমরা বুঝতে চাই না। যৌনচাহিদা দমন করতে করতে একসময় অনেক নারী মানসিকভাবে অসুস্থও হয়ে পড়তে পারে। ঘুম, খাওয়া, পায়খানা প্রস্রাব করার মতো যৌনচাহিদাও যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব প্রাণীর একধরনের সাধারণ শরীরবৃত্তীয় ঘটনা, যা আমরা নিয়ন্ত্রন করতে পারি, উপেক্ষা নয়, এটা বুঝতে আমাদের সমাজের এখনো কয়েকশ বছর লেগে যাবে!
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্ট