আমার পোশাক নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন?
প্রকাশ | ১৯ জুন ২০১৭, ২০:১৫ | আপডেট: ১৯ জুন ২০১৭, ২০:২০
সেই ছোটোবেলা থেকে গ্রাজুয়েশন ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা অব্দি আমার চুল একদম ছোট করে কাটা ছিল, মানে ছেলেদের চুলের মতো। ইদানীং একটু লম্বা হয়েছে। ছোটোবেলা প্রতি রোববার দিন বাপী আমাকে আর আমার ছোটবোন মুনকে সঙ্গে নিয়ে সেলুন থেকে চুল কাটিয়ে আনতেন। বড় হয়ে সেলুনে না গেলেও, পার্লার থেকে ছোট করে চুল কাটিয়ে আসতাম। ছোটোবেলা থেকেই আমি সবসময় প্যান্ট সাথে শার্ট বা টি-শার্ট পরতাম। এমনকি এখন অব্দি তার হেরফের হয়নি। এখনও পরি। যতদুর মনে পড়ে প্রাইমারী স্কুলেও আমি প্যান্ট আর শার্ট পরে যেতাম। মাধ্যমিকে আমাদের স্কুলে মেয়েদের ড্রেস ছিলো শাড়ি। সমস্ত শাড়ি সেফটিফিন দিয়ে কোনোক্রমে গায়ে ঝুলিয়ে স্কুলে যেতাম। জামা বা চুড়িদার আমাকে কখনো কিনে দেওয়া হয়নি। এখনও নেই। ছোট থেকে এগুলোই আমার পছন্দের পোশাক। মাঝেমধ্যে এখন অবশ্য ইচ্ছে হলে শাড়ি পরি। তাও সর্বসাকুল্যে দু-তিন বারের বেশী পরিনি।
সে যাই হোক। আমার জীবনের রামকাহিনী লিখতে বসিনি এখানে। যে প্রসঙ্গে এই কথাগুলোর অবতারণা সেটা হলো, সেই ছোটোবেলা থেকে এই সমাজের একটা প্রশ্নে আমি জেরবার হয়ে আছি, সেটা হলো আমি ছেলে না মেয়ে? মেয়ে হলে সালোয়ার কামিজ না পরে প্যান্ট টি-শার্ট পরি কেন?? বয়কাট চুল কেন?? এক অদ্ভুত চোখে তারা দেখতে লাগলো আমায়। একটু বড় হওয়ার পর শুরু হলো ধর্মীয় অনুশাসনের কথা। গ্রামের বাড়ি বছরে যে দুবার যেতাম, গ্রামের চাচী, ফুফু, খালা, চাচাতো বোন, সবার একই কথার সাথে যোগ হলো আল্লার আদেশ উপদেশের কথা। এসব পোশাক পরলে পাপ হয়। নরকে যায় মৃত্যুর পর ইত্যাদি ইত্যাদি। বাপিকে একবার মসজিদের ইমাম বললেন আপনার মেয়েকে এসব পোশাক না পরিয়ে সালোয়ার কামিজ পরতে বলবেন। আমার বাপি বললেন, আমার মেয়ে কি পরবে না পরবে সেটা বলার আপনি কে? আমার মেয়ে তো খালি গায়ে হাঁটছে না! যথেষ্ট ভদ্র পোশাকই পরে আছে।
সত্যি কথা বলতে কি বাপি কোনোদিন আমাদের কোনো ধর্মীয় অনুশাসনে বেঁধে রাখেননি। মুক্তভাবে, মুক্তমনে বড় করেছেন। কৃষকসভা, পার্টির কাজ শেষে যেটুকু সময় পেতেন আমাদের বিভিন্ন ফাংশনে নিয়ে যেতেন, কমিউনিজম সম্পর্কে বোঝাতেন, প্রচুর বই কিনে দিতেন। পরিক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে বই উপহার দিতেন। কোনোদিন ছেলে-মেয়ের তফাৎ শেখান নি। সারাজীবন বাপির এই সাহস যুগানো থেকেই আজকের আমি হয়তো এইরকম হতে পেরেছি। যাইহোক, শুধু গ্রামের আত্মীয়-কুটুমই নয়, প্রাইভেট টিউশনের বন্ধুরা থেকে শুরু করে পাড়ার বয়স্ক কাকিমা - সবার মুখে একই প্রশ্ন এখনো। যেন আমার বয়কাট চুল আর প্যান্ট-শার্ট তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে!!
এসব প্রশ্ন আমার বড় অদ্ভুত লাগে। আচ্ছা আমি ছেলে হই বা মেয়ে তাতে এই সমাজের মানুষের এত মাথাব্যথা কেন?? তাদের এত সুড়সুড়ি কেন লাগে?? আমি বুঝতে পারি না। আমি তো কাউকে বলি না, তুমি কেন শাড়ি পরেছো? তুমি কেন সালোয়ার কামিজ পরেছো? তুমি কেন হিজাব পরেছো? তাহলে অন্য একজন কি পরলো, গলায় ওড়না দিলো কিনা, জিন্স-টি-শার্ট পরলো কিনা, সেটা নিয়ে তাদের এত মাথাব্যথা কেন?? পোশাক মানুষ নিজের ইচ্ছেয় পরে। চুল মানুষ নিজের ইচ্ছেতে ছোট করে অথবা লম্বা করে! মানুষের ইচ্ছের উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার কে এই মানুষগুলোকে দিয়েছে??
আসলে কি জানেন, নারীকে মাংসপিণ্ড শুধু পুরুষই ভাবে না, ক্ষেত্রবিশেষে নারীরাও ভাবে। পুরুষতন্ত্র তাদের মাথায় পই পই করে ঢুকিয়ে দিয়েছে নারীর সংজ্ঞা। ভালো নারী খারাপ নারীর সংজ্ঞা। ভালো নারী মানে তোমাকে সালোয়ার কামিজ পরতে হবে। ভালো নারী মানে আধহাত ঘোমটা বা হিজাব পরা এক জড়বস্তু। যে বাবুরাম সাপুড়ের সাপের মতো 'করে নাকো ফোঁসফাস, নেই কোনো উৎপাত'। একজন নারীর হাত, পায়ের পাতা, গলা, মুখ, সবই এই সমাজে সেক্স অবজেক্ট। তাই তাকে আপাদমস্তক ঢেকে থাকতে হবে। তার চুল কেমন হবে, হাঁটা চলা কেমন হবে হবে সেটাও পূর্বনির্ধারিত করে দেওয়া হবে। এর বাইরে কোনো মেয়ে অন্যরকম কিছু করতে চাইলেই সে খারাপ মেয়ে।
কিন্তু তারা জানে না তাদের এইসব প্রশ্নে আমার রাগ উঠে না, করুণা হয় তাদের প্রতি। করুণা হয় এটা ভেবে, তারা জানে না যারা পোশাকের দোহাই দিয়ে নারীকে বন্দি রাখতে চায়, একজন মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চায়, কুপুরুষের কুরুচিকে জায়েজ করতে চায়, তাদেরকে আমি মানুষ সারিতেই ফেলি না!!
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্ট