একটি ভুলই শেষ কথা না
প্রকাশ | ৩০ জুন ২০১৬, ০১:৪৫
‘লোকে কি বলবে’ জাতীয় একটি ভাবনা আমাদের সমাজ এবং পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের মেয়েদের মগজে গেঁথে দিয়েছে। এই পোশাকটা কেমন দেখাবে লোকের চোখে? আমাকে একটি ছেলে চুমু দিয়েছে জানলে লোকে কি বলবে? আমি একটি ছেলের থেকে প্রতারিত হয়েছি জানলেই বা কি বলবে লোকে?...ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। আমার ওপর ঝড়, ঝঞ্ঝা, মহামারী, টর্নেডো যাইই যাক, লোকের চোখে ভালো থাকতে হবে! সমাজের চোখে ভালো মেয়ে, সতীসাধ্বী সেজে থাকতে হবে। আমার সাথে যাইই ঘটুক, আমি ধর্ষিত হই বা প্রতারিত হই, বাড়িতে স্বামীর কাছে লাঞ্ছিত হই, ভাব দেখাতে হবে- আমার গায়ে কোনো পুরুষের ছোঁয়া তো দূর নজরও লাগেনি! আমার গায়ে ফুলের টোকাটিও পড়েনি!
প্রথম কথা হচ্ছে- আমি কি পরবো, কি করবো, কোথায় যাবো সেটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত বিষয়। আমার কাজ যতক্ষণ কুকাজ বলে, ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত না হচ্ছে ততক্ষণ আমি স্বাধীন। দ্বিতীয় কথা প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন। নতুন করে পুরুষের কাছ থেকে নারীকে স্বাধীনতা নিতে হবে কেন? এটি হয়েছে শুধুমাত্র মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকার কারণে। স্বামীর টাকায় চলবো, আর স্বামীর কথা শুনবো না তা হয় না। এই সমাজে টাকা হচ্ছে একটি চাবি। এই চাবি তুমি যতক্ষণ হাতে না পাচ্ছ ততক্ষণ চাবিওয়ালার পেছনে ঘুরতে হবে। তুমি যেতে চাইবে ডানে, চাবিওয়ালা বলবে বামে। তুমি চাইবে এই নীল শাড়িটি কিনবে, চাবিওয়ালা বলবে- লাল শাড়িটাই কেনো, ওটাই বেশি সুন্দর। তোমাকে লালটাই কিনতে হবে। কিন্তু নিজের টাকা থাকলে তুমি চাবিওয়ালার পছন্দেরটাও পেতে, নিজের পছন্দেরও দাম থাকতো, তোমার হাতেই চাবিটি থাকতো।
একটি ছেলের কাছে তুমি প্রতারিত হয়েছ, তোমার সতীত্ব গিয়েছে বলে তোমাকে মারা যেতে হবে কেন? কেন গলায় দড়ি দিতে হবে? সতীত্বের ধারণাটা তোমার মাথায় কে দিয়েছে? পুরুষ দিয়েছে। পুরুষ বলে দিয়েছে সতীত্ব ছাড়া তুমি অচল মুদ্রা, তোমার মান যাবে, জাত যাবে। আর তুমি দিব্যি সেটা মেনে নিয়ে বসে আছ। অথচ সে ঠিকই দশটি মেয়ের সতীত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলে একটি সতীসাধ্বী মেয়ে নিয়ে সংসার করবে। তুমি এদিকে সেই হারানো সতীত্ব নিয়ে অপমানিত হবে, কষ্ট পাবে, প্রয়োজনে আত্মহত্যা করবে।
ভাইয়ের কপালে ফোঁটা, স্বামীর জন্য শাঁখা সিঁদুর, ভাইয়ের হাতে রাখী, জামাইকে জামাই ষষ্ঠীতে খাওয়ানো, শিব রাত্রিতে শিবের মতন বর চাওয়া! শিবের মতন একটি লম্পট বর না পেলে তোমার চলবে না, তোমার মঙ্গল হবে না। স্বামীর পায়ের নিচের বেহেশতে না গেলে তোমার সুখ মিলবে না! তোমার মঙ্গল সিঁদুর খেলায়, শিবের পূজায়, ভাইয়ের ফোঁটায়, পায়ের তলার বেহেশতে।
তুমি আমাকে গালি দেবে, বলবে আমি নাস্তিক, আমি নারীবাদী, আমি নির্লজ্জ, আমি নিকৃষ্ট। স্বামীকে প্রণাম করবে। এরপর ভুল হলে মার খাবে, মার খেয়ে কাঁদবে, কেঁদেকেটে মরবে, গলায় দড়ি দেবে। তারপর তোমার মৃত্যুতে শোক জানাতে আসা লোকগুলো কাঁদবে, কিন্তু আমি প্রতিবাদ করতে গেলে তোমার মতোই বলবে- আমি নারী নই, পুরুষের জন্য আমি নারীরূপী শয়তান! অথচ তুমি মরার আগে তোমার ঈশ্বর তোমাকে সাহায্য করবেন না, তিনি পক্ষ নেবেন তোমার অত্যাচারী স্বামীর, আর আমি বাঁচাতে গেলেই হবো সাক্ষাৎ শয়তান!
শোনো মেয়ে, ভুল করা জীবনেরই অংশ। তুমি একটি ভুল মানুষকে ভুলে মনটি, শরীরটি দিয়েছিলে ঠিক। কিন্তু সেই ভুলটিই শেষ কথা না। তুমি গুণী হও, টাকা হোক, তোমার ব্যক্তিত্বে ঝলমল করুক চারিদিক। তুমি দেখাও- ভুল করা জীবনেরই অংশ। যে ভুলটিকে ভুল হিসেবে নেবে সেইই বরং কাছে আসুক, ভালবাসুক। রূপ, সতীত্ব, চুলের ঘনত্ব তোমার কোনো যোগ্যতা নয়, বরং সেই ভুলটিই যোগ্যতা হোক তোমার। ভুলটির গায়েই কেউ ভালোবাসার প্রলেপ লাগিয়ে দিতে দিতে বলুক- তোমার ভুলটিই আমার প্রথম ভালোবাসা, যাতে তুমি যোগ্য হয়ে উঠেছ ভুলটিকে জয় করতে!
লেখক: তরুণ লেখক ও সাহিত্যিক