পিরিয়ড কোন পাপ নয়, গ্লানিও নয়
প্রকাশ | ২৮ মে ২০১৭, ২২:১৩
আমার বয়স তখন ১২ ছুঁই ছুঁই। ক্লাস সেভেনে পড়ি। একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে ইউনিফর্মের সালোয়ার রক্তে ভিজে যেতে দেখে অদ্ভুত একটা ভয় গ্রাস করে ফেলেছিলো আমাকে। আর কি ভয়ানক নি:সঙ্গতা!! আম্মা বাড়িতে ছিলেন না, ঢাকায় খালার বাসায় গেছেন। বিশাল যৌথ পরিবার, ঘর ভর্তি মানুষ। দাদি, চাচি, ফুফু সবাই আছে, অথচ একজন মানুষও নেই যাকে আমি এই ভয়ংকর ঘটনা জানাতে পারি। কি হয়েছে আমার? আমাদের স্কুলে তখন জ্বিন ভূতের উপদ্রপ মিথের মতো। আমাকে জ্বিনে ধরেছে? খারাপ কোন অসুখ হয়েছে? আমি কি কোন পাপ করেছি? এখন কি আমি মারা যাবো?
আমার এখন কি করতে হবে? এরকম কি কালকেও হবে? হলে আমি কি করবো? কিচ্ছু জানি না। শুধু সিক্সথ সেন্স বলেছে, এমন আবারো হবে। পরের দিন স্কুলে যাওয়ার সময় ইউনিফর্মের নিচে তিনটা পায়জামা পড়লাম। সারাদিন কাটা হয়ে থাকলাম। বাসায় ফিরে দেখি তিনটা পায়জামাতেই রক্ত। তীব্র ভয় আর বিষন্নতা আচ্ছন্ন করে রাখলো। দাদি কি একটা কাজ করতে বলেছিলো। আমি ভুলে গেছি, তাই দাদী এসে মারলো। মারের ব্যথা, শরীরের ব্যথা, একাকিত্বের ব্যথা একসাথে গিলে ফেললাম আমি। পরের দিনও এভাবেই কাটলো। তিনটা পায়জামা পরে স্কুলে যাওয়া, ঘরে ফিরে বিষন্ন হয়ে থাকা, বারবার বাথরুমে যাওয়া.....
যখন মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, আমি কোন পাপ করেছি বলে এরকম খারাপ একটা অসুখ আমার হয়েছে, এবং আমি মারা যাচ্ছি, তখন আম্মা এলো। কিন্তু আমার এই বিষণ্ণতা, ভয়, একা একা পালিয়ে বেড়ানো আম্মার চোখেই পড়লো না!! আমি একা একা কিভাবে যেনো আরো দু'দিন কাটিয়ে দিলাম।
এই বিশ্বসংসারের কেউ কিচ্ছু টের পেলো না। না আমি, না আমার সব চেয়ে ভালো বন্ধু বলে দাবী করা মা, না বাবা, এমন কি আমার পিঠের ছোট বোন, কেউ টের পেলো না কি ভয়াবহ একাকিত্ব আর ভয়কে সংগী করে আমি চুপচাপ একদিন নারী হয়ে গেলাম। যেভাবে এ দেশের লক্ষ লক্ষ মেয়ে ভয়, পাপবোধ, গ্লানি আর বিষন্নতার হাত ধরে চুপচাপ নারী হয়ে যায়।
তারপর সব চুপচাপ। ছ' মাস পরের ঘটনা। আমার বয়স বারো চলছে। ক্লাস এইটে ওঠেছি। দাদার সাথে রাগ করে আব্বা আমাদের নিয়ে চলে এসেছেন ভাড়া বাসায়। এক সকালে কি কাজে যেনো বাড়িওয়ালা আপার বাসায় গিয়েছি। আমি চলে আসার সময় দেখি আমার পেছন পেছন এসে আপা আম্মাকে সাথে নিয়ে আমার উপর পুলিশি তল্লাশি শুরু করলেন। কি হয়েছে !!! আমার স্কার্টের পেছনে নাকি রক্তের দাগ দেখা গেছে। যৌথ তল্লাশি শেষে আম্মা আর আপা নিশ্চিত হলেন, ঘটনা ঘটেছে!! পিরিয়ড হয়েছে!! এই তল্লাশি কার্যক্রমের পুরোটাতে আমি ছিলাম চুরির দায়ে ধরা পড়া তীব্র অপমান বোধের অনুভূতির মধ্যে।
আমি তখনো জানি না এই ঘটনা ছ'মাস আগের ঘটনার ধারাবাহিকতা। আমি হতভম্ব। কাউকে বলতেও পারছি না এমন একটা ঘটনা আগেও ঘটেছে আমার জীবনে। যাই হোক, আম্মা গোসল করিয়ে কাপড় ঠিকঠাক করে দিলেন। বললেন, বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ। তরকারী খাওয়া নিষেধ। এ ক'দিন শুধু দুধভাত, তাও চিনি ছাড়া। কারো বিছানায় ঘুমানো নিষেধ, আমার জন্য আলাদা বিছানা হলো। আমার আদরের ছোট ভাই, ওর কাছে যাওয়া যাবেনা। যে কাপড় ব্যবহার করতাম সেটি ধুয়ে মেলে দিতে হবে আলনার পেছনে যেন দেখা না যায়৷ আমি তখন অচ্ছুত! এবার আমি নিজেও বিশ্বাস করলাম সত্যিই আমি পাপ করেছি।
আব্বা বাসায় এসে শুনলেন। বিকেলে ঘুমের মধ্যে শুনি আব্বা আমার পায়ের কাছে বসে দোয়া পড়ছেন আর আমার গায়ে ফু দিচ্ছেন। মেয়ে বড় হলে নাকি বাবাকে নতুন কাপড় দিতে হয়, তাই আব্বা একটা বেগুনী রঙের সালোয়ারের কাপড় কিনে এনেছিলেন। সে-ই আমার এই জীবনে আব্বার হাতে করে আনা একমাত্র উপহার। ওইসময় একমাত্র আব্বাই আমাকে অপবিত্র মনে করেননি। তবে দাদিকে এই খবর দিতে গিয়ে আব্বা বলেছিলেন, "আমার মেয়েটা মরে গেছে!!" মরে গেছে!!!
আব্বাই বোধহয় সবচেয়ে ভালো বুঝেছিলেন, এই অসভ্য সমাজে মেয়েদের পিরিয়ড হওয়া মানে মরে যাওয়া। নারীত্ব মানে নিরন্তর গ্লানি আর মৃত্যুর ভয়াবহতা। যে নারীত্ব স্বাভাবিক, সুন্দর, গৌরবের, সে নারীত্ব এখানে পাপের বোধ নিয়ে আসে। যে রক্তপিন্ড থেকে মানুষের জন্ম হয়, সভ্যতার বিস্তার হয়, সে রক্তপিণ্ডকে দূষিত অপবিত্র ভাবা হয় এখানে। এই সময়ের একাকিত্ব, বিষন্নতা আর পাপবোধে আক্রান্ত হয়ে যে কতো কিশোরী আত্মহননের পথ বেছে নেয় সে হিসেব আমাদের হাতে নেই।
আমরা জানি না, এখনো বাংলাদেশে মাত্র ১৩ শতাংশ মেয়ে স্যনিটারি ন্যপকিন ব্যবহা্র করে। ৪০ শতাংশ ছাত্রী প্রতি মাসে মাসিকের সময় কমপক্ষে তিন দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকছে। মাসিকের সময় প্রচণ্ড ব্যথায় প্রায় মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে অনেক মেয়ে৷ তাদের ডাক্তার দেখানো হয় না৷ কর্মজীবি নারীরা মাসের এই সময়ের তীব্র ব্যথাকে নীরবে হজম করে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ সঠিক সময়ে পিরিয়ড হওয়াটাই একটি মেয়ের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থতার পূর্বশর্ত।
দিন অনেকটা পাল্টেছে। এই আমরাই পাল্টিয়েছি। আমি আমার মেয়েকে যেমন প্রস্তত করেছিলাম এই বিশেষ সময়ের জন্য, তৈরী করেছিলাম ওর বাবাকেও। যেনো আমার অনুপস্থিতিতে পিরিয়ড হলে মেয়ে তার বাবাকে জানাতে পারে। ছেলেকেও বুঝিয়েছি, মেয়েদের পিরিয়ড হলে কতটা কষ্ট হয়, সেসময় তাদের বিশ্রাম দরকার, ঠিকমত খাওয়া দরকার হয়, প্রাইভেসি দরকার হয়, পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার হয়। সবচেয়ে জরুরী হলো, যেহেতু ওরা কো-এডুকেশনে পড়ে, স্কুলে কোনো মেয়ের জামায় দাগ দেখলে তা নিয়ে যেনো কোন বাজে মন্তব্য না করে। এ সময় যেনো সে তার বন্ধুটিরও কেয়ার নেয় যতটুকু সম্ভব।
আজ বিশ্ব মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন ডে। সময় এসেছে পাল্টাবার। বদলাতে হবে ঘর থেকেই। আলোচনা করুন, কথা বলুন পরিবারেই। পিরিয়ড নিয়ে ভয় শংকা কাটিয়ে মেয়েরা উড়ে বেড়াক জীবনের দিগন্তে। পিরিয়ড নিষদ্ধ কোন বিষয় নয়, পাপ নয়, গ্লানিও নয়। অতএব, কথা হোক, ট্যাবু ভাঙ্গুক। সুস্থ থাকুক নারী, সুস্থ থাকুক পরিবার, স্বাভাবিক হোক নারীত্ব। নিয়মিত মাসিক, সুস্থ নারীত্ব, সুস্থ সভ্যতা।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী সংযোগ বাংলাদেশ