কেন নারীবাদ নিয়ে লিখছি?
প্রকাশ | ২৭ জুন ২০১৬, ১৬:১৭
চরিত্রহীন মানুষগুলোই অন্যের চরিত্রের উপর দাগ কেটে যায় নির্দ্বিধায়। যেমন ডা. লুৎফর রহমান নিয়মিতই যৌন-পল্লীতে যাতায়াত করতেন। নিন্দুকেরা বলতেন, তিনি নাকি যৌনকাম-বাসনা চরিতার্থ করার জন্যই যৌন-পল্লীতে যাতায়াত করতেন। আদৌতে তিনি তা ছিলেন না। ডা. লুৎফর রহমান ছিলেন একজন মানবতা-কামী। তিনি যৌন-পল্লীতে যৌনকাম-বাসনা চরিতার্থের জন্য যেতেন না। তিনি যেতেন স্বেচ্ছায় চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য। যৌনকর্মীদের মধ্যে সচেতনতা আর তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। অথচ নিন্দুকের তাকে পতিত বানিয়ে গল্প করতেই পছন্দ করতেন।
আমার লেখাগুলো নারী পক্ষীয় লেখা। ঠিক নারী পক্ষীয় নয়, নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি আর নারী অধিকার খর্ব করার বিরুদ্ধে, লেখার চেষ্টা করি। এ নিয়ে অনেক রটনা আছে আমাকে ঘিরে। অনেক দুর্নামও আছে। কারো কারো ধারণা, নারী সঙ্গ বা যৌন ক্ষুধা নিবারণের জন্যই আমি নারীবাদ নিয়ে লিখি। আমি একটা লুচ্চা! তা না হলে পুরুষ হয়ে কি করে নারীবাদ নিয়ে লিখি?
প্রথমত, লুচ্চা কোন অর্থে তারা ব্যবহার করে আমার জানা নেই। কিংবা লুচ্চার সংজ্ঞা কি? তারাও বোধ হয় জানেন না। যার ফলে এই শব্দটা ব্যবহার করেন। যদি বলেন যৌনতার লোভ। তবে বলব, ভুল। যৌনতা প্রতিটি মানুষেরই জীবনের একটা অংশ। আপনার যেমন আছে, আমারও তেমন আছে। তবে যৌনতার প্রতি লোভ আদৌ করিনি। আর নারীবাদ নিয়ে আমার লেখার উদ্দেশ্য এ নয়। কখনো ছিলও না।
যৌনকাম-বাসনা চরিতার্থের জন্য যদি নারীবাদ হতাম, তবে ছলে বলে কৌশলে অনেক নারীর সঙ্গ নিতে পারতাম। আজ পর্যন্ত সে সুযোগ নিই নি। আর যৌনতার প্রতি এতটা লোভ যদি থাকত, তবে যৌন-পল্লী বা শহরের আবাসিক হোটেলগুলোতেও যেতে পারি। সে ক্ষমতা বা সামর্থ্যটুকু আছে। হয় তো এই ধারায় আসার আগে এই দু’টা জায়গায় অনেক গিয়েছি। কিন্তু এই ধারায় এসে একটু একটু করে নিজেকে বদলাতে পেরেছি। কিছুটা মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যদিও পুরুষ থেকে মানুষ হওয়া সহজ নয়। তারপরও চেষ্টা করছি নিরন্তর।
এবার বলি কেন নারীবাদ নিয়ে লিখছি? আমি যখন খুব ছোট, তখন বাবা মারা যান। তখন মায়ের বয়স ছিল ২২ কি ২৩। আমার দেখা মতে মা ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী, রূপবতী। সে বয়সে বিধবা হওয়াতে মাকে কি যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে! সমাজ কিভাবে মাকে চোখ রাঙাত, তা খুব কাছ থেকেই দেখেছি। যা এখনও আমার চোখে ভেসে উঠে। সেখান থেকেই আমি বোধ করি, সমাজের এই ধারা পরিবর্তন জরুরী। এ জন্য দরকার লিঙ্গ বৈষম্যহীন একটা সমাজ ব্যবস্থা। অবসান হওয়া দরকার পুরুষতান্ত্রিক ভাবধারার।
সেই উপলব্ধি থেকে এখন বলতে পারি, শুধু আমার মা নয়। মায়ের মত এমন অনেক নারীই আছেন, যাদের প্রতি মুহূর্তে নিজের ঘর থেকে শুরু করে অফিস আদালত, সমাজ কিংবা অন্যান্য স্থানেও এমন বৈষম্যের শিকার হতে হয়। অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। তার কতগুলো আমরা জানি?
আমার ছেলে বন্ধু নেই বললেই চলে। তবে অনেক নারীদের সাথেই আমার ভালো সম্পর্ক ছিল (এর অর্থ এ নয়, তাদের সাথে বিছানা পর্যন্ত সম্পর্ক গড়িয়েছে)। সেখান থেকেও তাদের কথা শুনেছি, জেনেছি। উপরে উপরে সুখী মনে হত তাদের। কিন্তু, যখন তাদের ব্যক্তিগত জীবনটাকে জানতাম, তখন নিজের চোখ দিয়েই জল গড়িয়ে আসত। সেই সাথে পুরুষ হওয়ায় নিজেও লজ্জাবোধ করতাম। আর ভাবতাম, এত সুখী সুখী মুখ করে তারা এতটা কষ্ট কি করে পোষে রাখেন!
আমি জেনেছি একজন উচ্চ শিক্ষিতা সুন্দরী নারী হয়েও বিয়ে প্রথার নামে কিভাবে দিনের পর দিন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন! গর্ভধারণ না করার অপরাধে কিভাবে একজন নারীকে দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে! আবার গর্ভপাত না করার অপরাধে একজন নারীকে সমানভাবে নির্যাতন সহ্য করতে হয় এই সমাজে। এখন প্রশ্ন করতে পারেন, তবে তারা সংসার ছেড়ে একাকী বসবাস করেনি কেন?
হ্যাঁ করেনি। কারণ, নারী চাইলেও সব পারে না। তার মূলে হচ্ছে, নারীরা নিজের একার কথা কখনো ভাবে না। তারা ভাবেন তাদের সাথে জড়িয়ে থাকা অনেকগুলো মানুষের কথা। কারণ, তারা যে কন্যা, জয়া, জননী, ভগ্নি। যার জন্য শত অন্যায়, শত নির্যাতন তাদেরই মুখ বুজে সহ্য করে নিতে হয়। সবার সামনে সুখী সুখী মুখ করে একটা সুখের হাসি মেখে রাখে তারা। তবে কেউ কেউ ভিন্ন হন। তারা এমন নির্যাতনের মুখে লাথি মেরে বেরিয়ে আসেন। তারা অসীম সাহসী। এতটা সাহস সবার হয় না। তবে হওয়া দরকার।
লেখক: ব্লগার