পুলিশিতথ্য ও সাংবাদিকতা বিষয়ে তিন প্রসঙ্গ
প্রকাশ | ২৬ জুন ২০১৬, ১৯:৫৩ | আপডেট: ২৬ জুন ২০১৬, ২০:০৮
১। প্রায়ই পত্রিকায় দেখি, পুলিশ কোন কথিত বা সন্দেহজনক অপরাধীকে রিমান্ডে নেয়ার পরে সেই কথিত অপরাধী ব্যক্তি কী কী বলেছেন, সেসব গণমাধ্যমে ফলাও করে ছাপা হয়। এখন কোন ব্যক্তি চলমান কোন কেসে পুলিশি জেরায় বা মারধরে কী কী বলেন, তা শুধু জেরাকারী অফিসাররা ছাড়া কারোর জানার কথা নয়, যা কেসটির নিষ্পত্তির জন্য ব্যবহার করার কথা । সেইসব খবর যদি আগেই বাইরে চলে আসে, তবে কেস ক্ষতিগ্রস্ত হবে জানা কথা। যদি বাইরে আসে তো জেরাকারী কর্মকর্তাদের কাছ থেকেই আসে। গণমাধ্যমে যায়। পুলিশের চাকরিতে কি কোন নীতিমালা নেই যে এসব গোপন তথ্য সরবরাহ করা অন্যায়?
২। সাংবাদিকরা এইসব তথ্য ছাপিয়ে দেন। আমরা পড়ে উত্তেজিত হই। কথিত অপরাধীর পক্ষে-বিপক্ষে সামাজিক মাধ্যমে মত দিতে থাকি। যাকে বলে মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে যায়। কিন্তু তারচেয়েও মারাত্মক যেটি ঘটে, তা হলো, মিডিয়া কাউকে অপরাধী বলে দেয়। যেমন গতকাল পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে। কিন্তু, সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী মাত্রেই জানেন, এ কাজ করার অধিকারীই তারা নন। তারা কাউকে দোষী বা নির্দোষী রায় দিয়ে দিতে পারেন না। ঘটনা-প্রবাহ তুলে ধরা তাদের কাজ, মতামত দেয়া নয়। এখন কেউ যদি খুনের পরিকল্পনাকারী প্রমাণিত হন, তবে সেই রায় দেবে আদালত। পুলিশ কিংবা সাংবাদিক নয়। সাংবাদিক আদালতের রায় উল্লেখ করে জানাবেন যে আদালত কথিত ব্যক্তিকে খুনি সাব্যস্ত করেছেন। আদালতে নিষ্পত্তি হবার পরে সাংবাদিক সূত্র উদ্ধৃত করে ঘটনাটি জানাবেন।
৩। তৃতীয় বিষয়টি হলো, প্রায়ই দেখি এইসব খবরের ক্ষেত্রে লেখা হয় বা বলা হয়, 'নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা 'জানান। খুব পিচ্ছিল খেলা। 'বিশ্বস্ত সূত্র', 'গোপন সূত্র'- এগুলো কোন সূত্র নয়। অন্তত সাংবাদিকের সূত্র নয়। কারণ, নাম না থাকার কারণে এইসব কথিত সূত্রের বক্তব্যকে ক্রসচেক করা যায় না। যে তথ্য ক্রসচেক করা যায় না, সেসব সাংবাদিকতায় সূত্র বলে গণ্য হয় না। উপরন্তু, একজন সাংবাদিকের জানা থাকার কথা, সাংবাদিকতার সাথে প্রপাগান্ডার পার্থক্য তৈরি হয় এই সংবাদসূত্রের স্বচ্ছতার উপরে।
সাগর-রুনি'র ঘটনায় আমরা দেখেছিলাম কীভাবে খুন হওয়া রুনির চরিত্র নিয়ে মূল ধারার বেশ কিছু পত্রিকায় নির্লজ্জভাবে মিথ্যাচার করা হয়েছিলো। তখন বিডিনিউজ২৪ডটকম-এ লিখেছিলাম, ''সাগর-রুনি-মেঘ প্রতিবেদনঃ মামুলি হলুদকে ছাড়িয়ে কালো সাংবাদিকতায়''। কল্পকাহিনী বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরকে নিয়েও। তনু'র ঘটনায় একটি মহল থেকে ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা করা হয়েছিলো কারো সাথে তার সম্পর্কের বিষয়ে, কিন্তু আগাতে পারেনি। এরও বহু বছর আগে, কল্পনা চাকমাকে অপহরণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছিলো, কোন প্রেমিকের সাথে তিনি পালিয়ে গেছেন। কিন্তু, আজো জীবিত বা মৃত কোন প্রেমিক তো দূরে থাক, কল্পনার খোঁজও পাওয়া যায়নি। মনে পড়ে ইয়াসমীন আর সীমার কথা। তাদের ধর্ষণ আর খুন করাকে বৈধতা দেবার জন্য তাদের যৌনকর্মী বানানোর চেষ্টা। আর সবশেষে, পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু সম্পর্কেও একই গল্প ফাঁদার চেষ্টা করা হয়েছে।
আমাদের দেশে, এখনো, কোন নারীর 'পরকীয়া' দেখাতে পারলে তাকে খুন করা বৈধ হয়ে যায় বলেই এসব প্রচার হয়ে থাকে। শুধু নারী না, সাম্প্রতিক সময়ে পুরুষকেও 'চরিত্রহীন' দেখানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শফিউল আলম লিলনকে হত্যা করার পর পত্র-পত্রিকায় তার কোন নারীর সাথে সম্পর্কের গল্পই ঢালাওভাবে প্রচার করা হলো।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব কিন্তু খুনিকে খুঁজে বের করা। পরকীয়া/স্বকীয়া দেখার দায়িত্ব নয়। হতেই পারে, কোন আপনজনের হাতেও কেউ খুন হতেই পারেন। কিন্তু সেটি বের করাই পুলিশের দায়িত্ব। আর সেই খবর যথাযথভাবে উপস্থাপন করা সংবাদপত্রের দায়িত্ব। গল্প বানানো মানেই হলো ঘটনায় দোষীকে আড়াল করার চেষ্টা। দুঃখজনক বিষয় হলো, কেবল একজন দায়িত্বহীন বা কমজানা সাংবাদিক বা পুলিশ এসব কল্পকাহিনী বানানোতে ব্যাপৃত থাকেন, বিষয়টি মোটেই এমন নয়। বরং যেসব ঘটনা ধামাচাপা দেবার জন্য এসব পথ বেছে নেয়া হয়, সেইসব ঘটনার গুরুত্ব বলে দেয় সংবাদপত্র কিংবা পুলিশ- উভয় ক্ষেত্রেই দায়িত্বশীল মহল জড়িত থাকেন, বা কারো পক্ষে এইসব কাজ করেন।
আমার প্রশ্ন হলো, খুন হয়ে যাবার পরেও তাদের পরিবার-পরিজনকে সামাজিকভাবে খুন করার এসব কুৎসিত খেলার ভেতর দিয়ে খুনিদের আড়াল করার প্রচেষ্টার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেবার উপায় কি আমাদের দেশে নেই? একটি পথের তালাশ অবশ্য দিয়েছেন মাহমুদা খানম মিতুর পরিবার। আইনী ব্যবস্থা নেবার কথা বলেছেন তারা। খানিকটা কাজ বোধহয় হয়েছে। অন্য কোন পথ?
লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়