নারী ও লেখকজন্মের পাপ!
প্রকাশ | ২৪ জুন ২০১৬, ০০:৩৭
টিভিতে যখন সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানগুলোতে যাই তখন প্রতিটি অনুষ্ঠানেই উপস্থাপক জানতে চায়- লেখালিখিতে আপনার পরিবার থেকে নিশ্চয়ই খুব সাপোর্ট আছে? আমি মধুর হেসে বলি- নিশ্চয়ই! আমার মা ভীষণ স্বাধীনচেতা মানুষ, তিনি এবং পুরো পরিবার খুব সাপোর্ট দেয় আমাকে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? পুরো পরিবার বলতে আমি বাবা-মা, ভাইবোনের যে সার্কেলটি বোঝাচ্ছি এদের বাইরেও অনেকে থাকে। মামা, চাচা, খালা, খালু, খালাতো, মামাতো ভাইবোনেরা...ইত্যাদি ইত্যাদি! এরা অনেকে পুরস্কার পেলে, ভালো রেজাল্ট করলে, টিভি শো হলে, পত্রিকায় ভালো ভালো কথা লিখে আমাকে নিয়ে ফিচার হলে প্রশংসার তুবড়ি ছুটিয়ে দেয়, তেমনি- আমি নাস্তিক, আমি নারীবাদী, আমি বেপরোয়া, বেহিসেবি, বেসামাল...হ্যানত্যান ইত্যাদি বলে দুর্নাম করতেও ছাড়ে না। এই লোকগুলো না থাকলে আমার জানা হতো না- বাঙালি যে কাজ সবচেয়ে ভালো পারে তা হচ্ছে অন্যের কূটনামী। কাজেই এসব কূটকথা ভেসে ভেসে বাড়ির লোকের কানেও আসে। তারা তখন বলতে শুরু করে- এটা লিখলে কেন? ওটা লিখলে কেন? এটা করলে কেন? ওখানে গেলে কেন?
আমার বাবা-মা ভাইবোনের ছোট্ট পরিবার; তারা আমাকে ভালোবাসে না তা নয়, খুব ভালোবাসে। কিন্তু অতিমাত্রায় ভালোবাসাও কখনো কখনো ব্যক্তিগত জীবন, কর্ম, স্বাধীনতায় অনধিকার হস্তক্ষেপে রূপ নেয়। কূটকথা ব্যাপারটা এমন যে, যে মানুষটির হাতে আমার জন্ম হয়েছে সেই ডাক্তারটি এখন বলে- আমি ইসলাম মানি না, ধর্ম মানি না, আমাকে যেন তওবা পড়িয়ে ধর্মের পথে আনা হয়। এর আগে আমার সাথে তার কোনো কথা নেই! আমি রক্তের সম্পর্কের চেয়ে ধর্মের দোহাইকে বড় হয়ে উঠতে দেখি।
আমি দেখি অধিকার, স্বাধীনতা নিয়ে কথা লিখে আমি আমার চারিদিকে খালি দেওয়াল তুলেছি, তুলেই যাচ্ছি। যে লেখা দিয়ে আমি নারীমুক্তির কথা বলি, প্রগতির কথা বলি, সেই লেখাই আমার চারিদিকে একের পর এক দেয়াল তুলে যায়। একসময়ের প্রিয় বান্ধবীটিও কথা বলতে চায় না, কারণ আমার সাথে কথা বললে সে খারাপ হয়ে যাবে বলে প্রচার করেছে তার ছেলেবন্ধুটি। এককালের প্রিয় শিক্ষকটিও আমাকে এড়িয়ে চলেন, কারণ আমার সোজাসাপ্টা কথা বলার আচরণকে তার অভদ্রতা মনে হয়। আমার পাওয়া বড় অংকের টাকার চেক, ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট এককালের প্রাণের বন্ধুর ঈর্ষার কারণ হয়, কারণ বহুদিন ধরে কবিতা লিখে আর গাঁটের পয়সা দিয়ে বই বের করেও তার অবস্থার উন্নতি হয়নি। আমি ধর্ম কর্ম করি না বলেই আমি মানুষ হিসেবে খারাপ হয়ে গিয়েছি বলে প্রচার করতে ছাড়ে না আমার ধর্মান্ধ মামাটি। আমি চতুর্দিকে কেবল চতুর্ঘাত পেতে থাকি।
আমি এদের বোঝাতে পারি না- আমি ধর্ম বুঝি না, আইন বুঝি না, আমি কেবল মানুষ বুঝি। মানবতা বুঝি। মানুষ বিপদে পড়ে কাঁদলে আমার কান্না আসে, মানুষের ভণ্ডামিতে আমি ক্ষুব্ধ হই, মানুষের স্বেচ্ছাচারিতায় আমি দুঃখিত হই।
যারা লেখা পড়ে, পড়ে তাদের মতামত জানায়, ভালোবাসা জানায় তাদের আমার বলা হয়ে ওঠে না- আমি ভালো নেই! পুরস্কারসমেত বড় অংকের একটি চেক হাতে নিয়ে, ক্রেস্ট হাতে নিয়ে, সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে আমার হাসিমাখা মুখের ছবিটিই শুধু সত্য নয়। ছবিটির পেছনে ব্যক্তিগত সুখদুঃখ আর হারানোর ব্যথাগুলোও সত্য।
লেখক বলে শুধু হারিয়েই গিয়েছি তা নয়। পেয়েছি অগাধ ভালোবাসা, ভালোবাসা সমেত বহু উপহার, একটি অটোগ্রাফের জন্য দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা ভক্ত পাঠকের ভালোবাসা, একতোড়া গোলাপ, হাতে বানানো জুয়েলারি, কয়েকটি ডায়েরি, নোটবুক, চকলেট বাক্স, কয়েক ডজন কলম, দামী সিগারেট...অনেক পেয়েছি, আর পাচ্ছি।
তরুণ লেখক হওয়ার সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনাটি আমাকে তেমন একটা পোহাতে হয়নি, একটি বইও নিজের পকেটের টাকা খরচ করে বের করতে হয়নি, প্রকাশককে একটি বই বের করতে তোষামোদ করতে হয়নি। তবে কোন বইয়ে কত রয়্যালটি পেলাম, কে কত দিয়ে কিনে নিচ্ছে পাণ্ডুলিপি এই প্রশ্নগুলো আমাকে বিব্রত করে। নিজেকে ব্যবসায়ী মনে হয়। মধ্যবিত্ত সমাজে শেখানো অর্থমূল্যের কাছে লেখালিখির গুরুত্ব সাময়িকভাবে ঠুনকো হয়ে যায়।
আমার ভালো লাগে বলেই লিখি, প্রতিবাদ করতে চাই বলেই লিখি, মানুষের ভালোবাসা পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমার মাঝে কাজ করে বলেই লিখি। এটি আমার পেশা নয়, আমার নেশা। আমি বোঝাতে পারি না আমি শুধু টাকার জন্য লিখি না, লিখি মনটা বাঁচিয়ে রাখতেও। একসময় খুব লাজুক ছিলাম, আমার ন্যায্য পাওনাটি আমি চাইতাম না মুখ ফুটে। এই সুযোগে লেখার হাজার হাজার টাকা, যেটাকে বলে সম্মানী সেটাও মেরে দিয়েছে অনেকে। এখন নির্দ্বিধায় প্রকাশককে বলে ফেলি- আমার রয়্যালটি কই?
রয়্যালটি নামক প্রবঞ্চনা কোনো লেখকের সাথে করা হলে সোচ্চার হই, কারণ লেখক এটির দাবীদার। সম্ভবত একারণে সকল প্রকাশকের কাছে আমি ভালোও নই। বাজারে বই চলছে বলে বিনীত ভাব দেখি, কিন্তু সেটি না হলেই আমার সাথে তাদের সম্পর্ক শেষ হবে সেটাও বুঝি। তবুও বড্ড ঠোঁটকাটা আমি।
আমি জানি আমি মরে গেলে আমাকে নিয়ে স্তুতি করার মানুষের অভাব পড়বে না, কবর ঘিরে মোমবাতি জ্বালানোর লোকও কম হবে না। কিন্তু জীবিত আমাকে অনেকের সহ্যও হবে না। আমার প্রতিভা যাকে মুগ্ধ করবে আমার কথাবার্তা তাকেই ক্ষুব্ধ করবে। আমি জানি আমাকে নিয়ে বাবা-মা, ভাইবোনের পরিবারটিকে নানা প্রশ্ন শুনতে হয়, শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হতে হয়। আমার ইচ্ছে হয় তাদেরকে মুক্তি দিতে। কিন্তু যেখানে আমিই মুক্ত না সেখানে তাদের মুক্তি আসে কোত্থেকে?
আমি কন্যা হিসেবে ভীষণ বিড়ম্বনার, বোন হিসেবে ভীষণ প্রশ্নসাপেক্ষ, প্রেমিকা হিসেবে ভীষণ ব্যর্থ। যারা আমাকে ভালোবাসে তারা বাহবা দেয়, আড়ালে পরামর্শ দিয়ে বলে, যেন গা বাঁচিয়ে চলি!
আমি ‘আমি’ হয়ে যত চলতে চাই, আমার দেয়ালগুলো এসে অক্টোপাসের মতন আটহাতে আলিঙ্গন করে আমাকে। আমার দেশটিতে আমার কোনো স্বাধীনতা নেই। আমি গাছপালা ঘেরা রাস্তায় একা হাঁটতে পারি না, পাছে কেউ এসে আমার ঘাড়ে কোপ বসিয়ে দেয়! আমি রাত বারোটায় জোছনা বিলাস করে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফেরার কথা সুখস্বপ্নেও ভাবতে পারি না, কারণ আমি নিশ্চিত তখন রাস্তার কোথাও না কোথাও ওঁত পেতে থাকবে কোনো ধর্ষক, কোনো ডাকাত বা কোনো উত্যক্তকারী!
এই সমাজের চোখে সতীসাধ্বী, লক্ষ্মী, নিপাট বা নিভাঁজ মেয়ে আমি নই। আমি জানি স্ত্রী হিসেবে, প্রেমিকা হিসেবে পাবার জন্য বা আমার মতন একরোখা, অপাঙক্তেয়, দুর্বিনীত মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবার জন্য কোনো আদরের দুলাল বসে নেই। এরকম কাউকে সঙ্গী করাটা তাদের কাছে হবে খাল কেটে কুমীর আনা। কাজেই আমি কারো সাথে নিজেকে জড়িয়ে জীবনের স্বপ্ন দেখি না।
আমি আমার নিজের দেশে, নিজের পরিবারে, নিজ সমাজে একটি বন্দী জীবন কাটাই। একটি স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতীয় শোকদিবস...দিবসসর্বস্ব একটি জীবন কাটাতে কাটাতে আমাকে স্বাধীনতার কথা লিখতে হয়। আমি খুব ভালমতো জানি মেয়েদের কোনো দেশ নেই। তবু আমি এই ভূখণ্ডকে দেশ ভাবি। এই ভূখণ্ডে নারীস্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নগুলো চোখের পাতায় জেগে থাকে, স্বপ্নগুলো বুকের গভীরে মন্ত্রণা দেয়। আমি আমার স্বপ্নগুলো নিয়ে পথ চলতে চাই। কেউ না থাকুক পাশে, স্বপ্ন বেঁচে থাক, স্বপ্ন পাশে থাক!
অনেকদিন আগে প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ জানতে চেয়েছিলেন- আমার জীবনের লক্ষ্য কি? আমি বলেছিলাম- আমার জীবনের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই। তিনি উত্তরে বলেছিলেন- লক্ষ্যহীন মানুষের লক্ষ্য থাকে না ঠিকই, কিন্তু অন্য অনেকের লক্ষ্য থাকে তার মতন হবার!
আমি আজও জীবনের মাঝসমুদ্রে এসে বোকা নাবিকই রয়ে গেছি। আমি জানিনা আমার গন্তব্য কোনদিকে, কিন্তু আমার চলা গন্তব্যের খোঁজেই। আমি জয়ীদের উদাহরণ হতে চাই না, পরাজিতদের বুকের আশা হতে চাই। তাই আমার যুদ্ধ আমি একাই লড়ি, পরাজয় নিয়ে মাথা ঘামাই না। হেরে গেলেও আমি যুদ্ধ শেষে হাসিমুখে বলতে চাই- যুদ্ধটা আমি একা লড়েছি, একা হেরেছি কিন্তু পরাজয় নিশ্চিত জেনে কখনো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসিনি!
লেখক: তরুণ লেখক ও সাহিত্যিক