ক্ষমতাবান লিঙ্গরা এবং একজন নাসের উদ্দিন
প্রকাশ | ০৯ মে ২০১৭, ২১:৪২ | আপডেট: ০৯ মে ২০১৭, ২১:৫৩
প্লিজ আপনারা অত উত্তেজিত হবেন না। নাসের উদ্দিন আমাদেরই একজন। বাকী বিল্লাহ ভাই বাংলা কম্যুনিটি ব্লগ থেকে শুরু করে এখনকার ফেসবুক অভিযাত্রা পর্যন্ত তার অভিজ্ঞতায় এখন আশাবাদী হচ্ছেন। বলছেন তার হোমপেজে মেয়েদের জামাকাপড় বা মেয়েগুলো অতরাতে কেন গিয়েছিল পার্টিতে-এই ধরনের কোন মতামত দেখা যায়নি। সবাই প্রতিবাদ করছেন, এই ঘটনার বিচার চাইছেন।
আমিও আমার হোমপেজে এরকম কোন মতামত দেখিনি। কিন্তু বন্ধুগণ আমার বা বাকী বিল্লাহ ভাইয়ের হোমপেজটাই বাংলাদেশ নয়। নাসের উদ্দিন এর বাংলাদেশ এবং সমাজও বাংলাদেশ। সেটাও আমাদের আমলে নিতে হবে। আমি বরং ধর্ষিতাদের পক্ষে থাকা মতামতগুলোকেই ইগ্নোর করি। ফেসবুক এবং বন্ধুমহল পর্যন্ত তাদের দৌড়। বরং নাসের উদ্দিনরা ছড়িয়ে আছেন আনাচে কানাচে। তারা বাসে, ট্রেনে, ঘরে-বাইরে, শপিংমলে, কাজের ক্ষেত্রে, জলে-স্থলে, অন্তরীক্ষে তাদের মতামত ছড়িয়ে দেন। দৃঢ়ভাবে। আমাদের নাক উঁচু, নিজেদের জ্ঞানী ভাবা ফেসবুকাররা এদেরকে বালছাল ভাবেন, নাসের উদ্দিনকে কেন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে বিরক্ত হন, কিন্তু সত্যি বলতে কি জনরুচি, জনমত এইটাই। পুরুষ কেন পুরুষ হয়ে ওঠে, কোন অবদমন, কোন মানসিকতা থেকে তারা পুরুষ হয়- ভাবা দরকার তাও।
সিমন দ্য বুঁভেয়ার যেমন বলেছিলেন নারী হয়ে কেউ জন্মায় না বরং হয়ে ওঠে, আমার তো মনে হয় পুরুষ হয়েও কেউ জন্মায় না ক্রমশ: হয়ে ওঠে পুরুষ। হয়ে উঠে সে পার্টিতে যাওয়া নারীর দিকে আঙুল তোলে, অত রাতে গেলেই ধর্ষণ বৈধ হয় এমন কথা আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি শুধু নাসের উদ্দিন নয়, নাসের উদ্দিন এর পোস্টে লাইক এবং কমেন্ট করা শ'খানেক পুরুষই নয়, ছুপা রুস্তম অধিকাংশ পুরুষ এবং নারীরাও ভাবছেন। ২০০০ সালে থার্টি ফার্স্ট নাইটে টিএসসিতে বাঁধন যখন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন- তখন যেমন জয়নাল হাজারী থেকে শুরু করে অনেকেই বাঁধনের বিচার চেয়েছিল তেমনই ২০১৭ সালে জন্মদিনের পার্টিতে মুখে মেয়ে দুইটার বিচার না চাইলেও ধর্ষকদের পক্ষে দাঁড়ানো মানুষের অভাব নাই।
এই দেশে ধর্ষিতা একটা আইডিয়া। নারী দুর্বল, যৌন বস্তু, নিজেকে ঢেকে না রেখে সে এখানে-ওখানে যাবে আর ধর্ষিত হবে না তা হয় না। যারা ধর্ষণের বিচার চাইছেন তাদেরও অনেকে নারী 'মায়ের জাত, বোনের জাত, স্ত্রীর জাত' তাই অনেক কষ্টে বিচারটা চাইছেন, মানুষ হিসেবে মানুষের সাথে যে অন্যায়টা ঘটেছে তার জন্য চাইছেন না। পাশাপাশি চলছে নারীকে হেদায়েত। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এক ফেসবুক পোস্টের নিচে আমাকেই অন্তত: দুইজন বলেছেন, এই ধরনের পার্টি থেকে বিরত হন, সতর্ক হন। তো এদেশে পুরুষদের সাথে স্বাভাবিকভাবে হেসে কথা বললে, দুই একটা সেক্সিস্ট জোক বললে, মোটরবাইক চড়লে বা চা-কফি বা দুএক পেগ খেলে সেই নারীকে শোয়ার জন্য তৈরি বলে ধরে নেওয়া হয়। শুধু এদেশ কেন আমেরিকার মতো দেশেও গত বছরই রায় হলো এরকম এক ঘটনার। পার্টিতে মদ খাওয়া এক তরুণীকে বিখ্যাত সাঁতারু ধর্ষণ করলে আমেরিকার সমাজ পর্যন্ত বলেছিল এই মেয়ে কেন মদ খেয়ে মাতাল হলো। ধর্ষণ সর্বোপরি এক বিনোদন পুরুষের কাছে।
এই ঘটনার বিচার হবে কিংবা হবে না তাতে আদতে কিছু আসে যায় বলে মনে হয় না আমার। সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ বা সাদমান এর বিচার করতেই পারেন আপনারা, কিন্তু এই যে সমাজ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজারও ধর্ষকামী পুরুষের বিচার কি করা যাবে? বা এটা কি আসলে বিচারের বিষয় না সংস্কৃতির? ধর্ষণ আসলে আমাদের সংস্কৃতি। আর এই সংস্কৃতির ধারক বাহক পুরুষদের একটু জানতে বুঝতে হবে- কেন পুরুষেরা মানুষ না হয়ে শুধুই লিঙ্গবান পুরুষ হয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে তা নিয়ে এখন গবেষণা হওয়াটা অবশ্যই বিচারের চেয়ে কোন অংশে জরুরী কম নয়।
লেখক: সাংবাদিক