বেশ্যাকে ধর্ষণ করাও সমান অন্যায়
প্রকাশ | ০৯ মে ২০১৭, ১৩:৪৪ | আপডেট: ০৯ মে ২০১৭, ১৬:২৭
শিক্ষাজীবনে যখন বিতর্ক করতাম, আমার পছন্দের একটা প্রোটোটাইপ ছিলো বিষয়ের ব্যবচ্ছেদ দিয়ে শুরু করা এবং আমি বিপক্ষ দলের বক্তা হলে, একটা কাউন্টার অপিনিয়ন প্রতিষ্ঠা করা। বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি।
ধরুন বিতর্কের দুটি দল, একটি নারী দল অন্যটি পুরুষ দল। বিতর্কের বিষয় -
"ভালোবাসা মোরে ভিখারী করেছে তোমারে করেছে রানী"
পক্ষে - পুরুষ দল এবং বিপক্ষে - নারী দল।
ধরে নিচ্ছি পুরুষ দল তাদের বক্তব্যে, প্রেমে পড়লে নিজের মানসিক অবস্থা দিয়ে শুরু করবেন এবং শেষ করবেন ক্রেডিট কার্ডের স্টেটমেন্ট দিয়ে।
নারী দলের বক্তা হয়ে আমি যেটা করবো তা হচ্ছে শুরু করবো বিষয়ের ব্যবচ্ছেদ দিয়ে এবং শেষ করবো প্যারালাল বা কাউন্টার ওপিনিয়ন দিয়ে। বিষয়ের ব্যবচ্ছেদ অর্থাৎ সংজ্ঞা ধরে টান মারা হবে। বুঝানো হবে 'ভালোবাসা', 'ভিখারী' ও 'রানী' বলতে আসলে কি বোঝায় এবং ঠিক কি কারণে পুরুষ দল না নিজেরা ভিখারী না আমাদেরকে রানী বানিয়েছেন! এবং কাউন্টার অপিনিয়ন এ আমি সম্ভবত স্টাব্লিশ করার চেষ্টা করবো
- ভালোবাসা তোরে শিকারী করেছে আমারে করেছে নারী (রানী'র উল্টা আর কি)!
হজরত আলী আর তার শিশুকন্যার লাশে পচন ধরার আগেই আবার মিডিয়া উত্তাল! সমাজের বিত্তবান ও ক্ষমতাধর পরিবারের তিন ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুটো মেয়েকে কৌশলে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেছেই শুধু না, এর ভিডিওচিত্রও ধারণ করিয়েছে দেহরক্ষী দিয়ে। সাবসিকুয়েন্টলি, হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলো অভিযোগ দায়ের করলে মেরে ফেলবে। পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সবাই ঘটনা জানেন, তাই ঘটনার বর্ণনা দেয়ার কিছু নাই।
কোথায় যেনো পড়েছিলাম, আইন মাকড়সার জাল, বড় জিনিস ওই জাল ছিঁড়ে বের হয়ে আসে, ধরা পড়ে ছোট জিনিস! সত্যি বলতে ঘটনার কোনো বিচার হবে আমি আশা করি না। এখনো যে তিন কুলাঙ্গারকে দেখে কোনো 'কিউট আপ্পি' ক্রাশ খায় নি, আমি এতেই বিস্মিত। জঙ্গি তাহমিদের মতো এরাও বের হয়ে যাবে, উল্টো এটা প্রমাণ করে দিয়ে যাবে যে দুই ভিকটিমই আসলে নষ্ট মেয়েমানুষ! ইতিমধ্যে এক অভিযুক্তের বাবা বলেই ফেলেছেন যা ঘটেছে মিউচুয়ালি ঘটেছে! যেনো ঐখানে একটা প্ল্যানড্ পর্নোগ্রাফি শ্যুটিং হয়েছিলো ওই রাতে, এইতো? সোনার দোকানের মালিকের সোনার ছেলের সোনার লোভে নষ্টা মেয়েমানুষ প্ল্যান করে এই কান্ড ঘটিয়েছে! ভিকটিমই নষ্টা, নষ্টা না হলে কেউ অতো রাতে ঐখানে যায় (তালি হবে...সমবেতভাবে)!
ঠিক শেষ লাইনটা থেকেই শুরু করি। জনাব সোনার মালিক ও তার সোনায় সোহাগা হিন্দিকেশ সমাজপতিরা, আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা কি তা জানেন? আরে! এইসব খারাপ কথা তো আপনাদের জানার কথা না, আফটার অল আপনারা হইলেন ফেরেশতা উষ্টা খাইয়া তার কোল থেইক্যা ছিটকায়া পড়া ভালা মানুষ, তাই না? যাক, মর্ত্যে যখন আইসাই পড়সেন, শুনেন ধর্ষণের সংজ্ঞা কি।
আইনে বলা আছে (বন্ধুতালিকায় অনেক ভিনদেশী আছে তাই বাংলা উচ্চারণে লিখলাম),
"রেপ ইস এ টাইপ অফ সেক্সুয়াল আসাল্ট ইউজুয়ালি ইনভলভিং সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স অর আদার ফর্ম অফ সেক্সুয়াল পেনিট্রেশন ক্যারিড আউট এগেইনস্ট এ পার্সন, উইদাউট দ্যাট পার্সনস কনসেন্ট"
শেষ অংশটা পড়েন - ক্যারিড আউট এগেইনস্ট এ পার্সন, উইদাউট দ্যাট পার্সনস কনসেন্ট।
এবার আসুন সংজ্ঞা ব্যবচ্ছেদ করি।
১) এগেইনস্ট - বিপক্ষে
২) পার্সন - ব্যক্তি | এখন ব্যক্তি ছেলে হতে পারে, মেয়ে হতে পারে, হিজড়া হতে পারে ,উকিল, ডাক্তার, জজ, বিবাহিত, অবিবাহিত, কালো, লম্বা, ফর্সা, বেশ্যা যে কিছুই হতে পারে।
৩) উইদাউট দ্যাট পার্সনস কনসেন্ট - ওই ব্যক্তির সম্মতি ব্যতীত। এই 'ইচ্ছার বিরুদ্ধে' ব্যাপারটা দিয়ে বোঝায় তাৎক্ষণিক অবস্থা অর্থাৎ ওই ঘটনার সময় ব্যক্তির মানসিক তথা শারীরিক সম্মতি ছিলো কি না।
পেশা যার বেশ্যাবৃত্তি, একটি সংসর্গে যদি তার সম্মতি না থাকে, সেটাকে ধর্ষণ না বলার কোনো সুযোগ কিন্তু নেই আইন অনুসারে। খেয়াল করুন, ফুটনোট দিয়ে ধর্ষণের সংজ্ঞার কোথাও বলা নেই যে "দি ওয়ার্ড পার্সন এক্সক্লুডস প্রস্টিটিউটস, গার্লফ্রেন্ডস এন্ড ওয়াইভস"! কানুনের সংজ্ঞায় কোথাও বলা নেই পূর্বপরিচিত এমনকি সম্পর্কে জড়িত থাকলেও তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংসর্গ জায়েজ!
কাজেই আপনার সোনার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য যে সোনার মতবাদ আপনি দিচ্ছেন, তা সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে তাতে সোনার শিকল পরিয়ে সোনায় ঝুলিয়ে রাখেন, 'আপন জুয়েলার্স'- নামের মতো আপন করে!
দুজন ছাত্রীর সবচেয়ে বড় পরিচয় তারা ভিকটিম। তাদের জাত বংশ চরিত্র ক্ষমতা স্থান কাল পাত্র পোশাক আইনের বিবেচ্য বিষয় নয়, হওয়া উচিতও নয়।
আর যদি তাই হয় তো আমি বলবো, বাংলাদেশের আইন আর বিচার ব্যবস্থাই ধর্ষণের সবচেয়ে বড় শিকার। অথবা 'মিউচুয়াল কনসেন্ট'-এ প্রতিরাতে ক্ষমতাবানদের শয্যাসঙ্গী বনে যাওয়াই এর অস্তিত্বের অংশ। এই বারবনিতা আইনের মুখে থু ... ওয়াক থু..।
লেখক: প্রকৌশলী ও প্রবাসী বাঙালি