চোখ বন্ধ করার প্রেসক্রিপশন আর কতদিন?
প্রকাশ | ০৮ মে ২০১৭, ২০:৩১
যেখানে ভীতি কম সেখানেই ভয় বেশি, অন্তত শিশু যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে।
খুব ছোটবেলায় ইউরিন ইনফেকশনের চিকিৎসার জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সিলেটের সেই সময়ের একজন অন্যতম নামকরা চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসক হিসেবে তিনি যতটা প্রসিদ্ধ ছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি প্রশংসিত ছিলেন তার ধার্মিকতার জন্য। অবশ্য এই বিষয়গুলো আমি বুঝেছিলাম আরো বড় হবার পর।
সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত সেই মহান পুরুষ তার চেম্বারের পরীক্ষা কক্ষে যখন আমার চিকিৎসা করছিলেন, তখন আমার অর্বাচীন দুই বড়বোন অপেক্ষা করছিলেন ওয়েটিং রুমে। একটি মাত্র বাক্যব্যয় না করে তিনি যেভাবে আমাকে পরীক্ষা করেছিলেন, তার সাথে আমার রোগের কোন ধরণের সম্পর্কই যে ছিল না, তা বুঝতে আমার আরো অনেকদিন লাগলেও সেদিন আমি অনেক বেশি ব্যথা নিয়ে ফিরেছিলাম। রিক্সায় বোনের কোলে করে বাড়ি ফেরার সময় অস্বস্তিতে বারবার কোল থেকে পিছলে পড়ে যাচ্ছিলাম। আপা ধমক দিচ্ছিল, 'এতো নড়াচড়া করছ কেন?'
আরো অনেক বেশি নড়াচড়া করার প্রয়োজন ছিল সেদিন, প্রতিবাদে ফেটে পড়ার প্রয়োজন ছিল। অথচ এই কথাগুলো যে এভাবে অবলীলায় বলা যায়, এই সাহসটুকু অর্জন করতেই আমার একটা জীবন পার হয়ে গেছে। বিলেতে একটা স্কুলে কাজ করার সময় নোরা ওয়াইল্ড নামক একজন নাস্তিক মহিলা প্রথম আমাকে বলেছিল আমি যেন দেশে ফিরে গিয়ে নির্ভয়ে এই কথাগুলো প্রচার করি, দেরিতে হলেও সেই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার চেষ্টা করি। আমার দেশ, পরিবার, জাতি, ধর্ম আমাকে যে সাহস যোগাতে পারেনি তা দিয়েছিল এক অধার্মিক বিদেশিনী।
খুব ইচ্ছে ছিল আর কিছু না পারি, একদিন দেখা করে ডাক্তার সাহেবকে কিছু কথা বলে আসব, কিন্তু পরের বার দেশে গিয়ে জানলাম আমাদের পরম ধার্মিক সেই চিকিৎসক সত্তর জন হুরের সঙ্গ লাভের জন্য ইতিমধ্যেই ইহকাল ত্যাগ করেছেন।
আপনারা যারা একই সময় সিলেটে বড় হয়েছেন তারা সবাই এই বিখ্যাত চিকিৎসকের নাম জানেন, কিন্তু আমার একজন আইনজীবী বন্ধু পরামর্শ দিয়েছেন সচেতনতা সৃষ্টির জন্য এধরণের একটা পোস্ট লিখলেও আমি যেন কিছুতেই তার নাম উল্লেখ না করি, কারণ তার ছেলেমেয়েরা আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে পারেন। তাছাড়া আমার বিরুদ্ধে তার অপরাধ আমি কিছুতেই প্রমাণ করতে পারবো না। আমি নিশ্চিত তিনি আরো অনেক নারী এবং শিশুর বিরুদ্ধে একই অপরাধ করেছিলেন, কিন্তু আমাকে সমর্থন করতে তাদের মধ্য থেকে কেউ এগিয়ে আসবেন না। আমাদের দেশে নির্যাতিতের সম্মানহানি হয় সবচেয়ে বেশি তাই তারা নীরব থাকতেই বেশি স্বস্তি বোধ করেন।
বিলেতে দেখেছি মৃত নির্যাতকের বিরুদ্ধে মামলা হয়, কয়েক যুগ আগের শিশু নির্যাতনের খবর নিয়েও তোলপাড় হয়, প্রমাণও বেরিয়ে যায়। যৌন নির্যাতন একটা অসুস্থ প্রবৃত্তি যার প্রকোপ সারা বিশ্ব জুড়ে কিন্তু আপনারা যারা প্রায়ই দাবী করেন আমাদের দেশের তুলনায় ধর্ষণ আর যৌন নির্যাতন পশ্চিমা দেশে বেশি হয় তাদেরকে বলব আপনারা সেই চোখ বন্ধ করে মাংসের টুকরা লুকানো কাকের মতই হদ্দ বোকা। আপনাদের লুকিয়ে রাখা মাংসের টুকরাগুলো যখন চরম দুর্গন্ধ ছড়ায় তখনও দুই আঙুলে নাক টিপে ধরে আপনারা পশ্চিমা দেশের দিকেই ইঙ্গিত করেন।
এই সংক্রান্ত পোস্টে প্রায়ই মন্তব্য দেখি, 'এসব কথা বাদ দেন। ঠিকমত ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করেন, তাহলেই দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে'। আবার সেই চোখ বন্ধ করার প্রেসক্রিপশন।
যত ইচ্ছা সমাজ গড়ুন, ধর্ম মানুন, কিন্তু শিশু যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে সাবধানতা এবং শিশুদেরকে যথাযথ যৌন শিক্ষা দেবার যে বিকল্প নেই এটুকু মানতে এবং ধারণ করতে না পারলে আমাদের শিশুদের শৈশব আমাদের অজান্তেই হারিয়ে যাবে শ্মশ্রুমন্ডিত ধার্মিকদের হাতেই, এটুকু মনে রাখবেন। ধর্মহীন অনেক সমাজ এর সত্যতা এরই মধ্যে প্রমাণ করেছে।
(ক্ষেপে যাবার আগে লক্ষ্য করুন, আমি ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু বলিনি, তথাকথিত ধার্মিকদের বিরুদ্ধে বলেছি। ধর্ম একটা বিশ্বাস যার প্রোটেকশন প্রয়োজন নেই, কিন্তু নির্যাতিত মানুষের রয়েছে। নির্যাতিতের কথা ভাবুন, তাদের কথা বলুন, তাহলেই সত্যিকারের ধর্মরক্ষা হবে।)
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী শিক্ষক, নাট্যকর্মী, ও অনুবাদক