কর্মজীবি নারী, ঘরে ও বাইরে
প্রকাশ | ০১ মে ২০১৭, ১৮:১৭
একজন কর্মজীবি নারী হিসাবে প্রতিদিন নানান ঝামেলার সম্মুখীন হই। ঘরে বাইরে নানান হ্যাপা সামলে তারপর চাকুরিটাও টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ করি। যেসব মায়েরা সারাদিন বাসায় থাকেন তাদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, গৃহিণী মায়েদের চেয়ে দ্বিগুণ কাজের বোঝা নিয়ে একজন কর্মজীবি মায়ের চলতে হয়। বাইরে যেমন তাকে প্রমাণ দিতে হয় তিনি যোগ্য, তেমনি ঘরেও সারাক্ষণ একই প্রমাণ দিয়ে যেতে হয়।
যখন পরিবারটি হয় যৌথ তখন চাপের বোঝা মাঝে মাঝে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। খুব কম ফ্যামিলিতেই চাকুরিরত মেয়েদের মন খুলে সাহায্য করা হয়। ঘরে থাকা বউমার কাছ থেকে শাশুড়িমা যতটা সেবা যত্ন আশা করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি আশা করেন যে বউমা প্রতিদিন ঘরের বাইরে যাচ্ছেন তার কাছ থেকে। সংসারের বাকি সদস্যদের কথা বাদই দিলাম। অবশ্য সবাই এইরকম না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিত্র ভিন্ন, যদিও পরিমাণ ক্ষীণ।
এখনও এই সমাজে চাকুরী করা মেয়ে মানেই সুবিধার না। এদের সামলানো খুব মুশকিল। অনেক কাছের বন্ধুদের দেখেছি বলতে, চাকুরী করতে হবে কেন? আমি কি খাওয়ানোর যোগ্যতা রাখি না? বিয়ের সময় শর্ত থাকে বিয়ের পর জব ছেড়ে দিতে হবে। এভাবে ঝরে পরে কত শত মেধাবি নারী! হয়ত একটু সহযোগিতা পেলেই তার ক্যারিয়ারটা সাফল্যের চূড়া ছুঁতে পারতো। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাদের সেই সুযোগ দিতে বরাবরই ভীত। এই সমাজে এখনও পর্যন্ত মেয়েদের সাফল্য উদারচিত্তে মেনে নেয়ার উদাহরণ খুবই কম।
কোনভাবে স্বামী বা শ্বশুরবাড়ি ম্যানেজ করে যেই মেয়েটা আপ্রাণ চেষ্টা করে চাকুরী করে যেতে, সেই মেয়েই আবার নতুন করে বিপদে পড়ে যখন মা হয়ে যায়। এখানেই চিত্র ভীষণ রকমের কষ্টদায়ক ও দুঃখজনক। পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে নিতে ক্লান্ত মেয়েটিকে ঘরের শান্তি বেছে নিতে হয় অবশেষে। খুবই কম মেয়ে এইরকম পরিস্থিতি সামলে নিয়ে আবার শুরু করতে পারে। ফলে চোখের সামনে দেখছি ঝরে যাচ্ছে কত শত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার অথবা খুব উজ্জ্বল একাডেমিক ক্যারিয়ারের মেয়েটি।
আর যারা একক ফ্যামিলিতে আছেন, তারা যদিও চাকুরীটা টিকিয়ে রাখতে পারেন কখনো স্বামীকে মানিয়ে, কখনো বা জোর করে, কিন্তু বাচ্চা হবার পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আর সম্ভব হয় না চাকুরীটা চালিয়ে যাওয়া। আমাদের দেশে মাতৃত্বকালীন ছুটি চারমাস (সরকারিভাবে ছয় মাস) করা হলেও, খুব কম প্রতিষ্ঠান এটা মানে। বেশিরভাগ সময় এই ছুটি পাওয়া যায় বিনা বেতনে। তারপর থাকে ফিরে আসার অনিশ্চয়তা। কখনোবা অফিস থেকেই বলে দেয়া হয় রিজাইন দিয়ে যেতে। অথবা ফিরে আসতে চাইলেও নিশ্চয়তা দিনে চায় না অনেক প্রতিষ্ঠান।
এবার বাচ্চা হবার পরের চিত্র। সব ঠিকই আছে, অফিসে জয়েন করবে। তবে বাচ্চা রাখবে কে সারাদিন? এটা এতই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে এখানে এসে আর কোন যুক্তি খাটে না। যে মা দিনরাত ঝগড়া করে যান চাকুরী করে যাবার জন্য, সেই মাও এই জায়গায় এসে অসহায় হয়ে পড়েন। শেষে নিরুপায় হয়ে চাকুরী ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। চারপাশে এত অঘটন ঘটছে প্রতিনিয়ত, এখন কোন মা আর সাহস পান না তার আদরের মানিককে কাজের মানুষের হাতে ছেড়ে দিয়ে সারাদিন নিশ্চিন্ত থাকতে। বাসায় সাহায্যর জন্য নির্ভরযোগ্য কেউ থাকাটা ভাগ্যের ব্যাপার। কেউ কেউ ছোট বোন, কিংবা মা বা দূরসম্পর্কের কোন আত্মীয়া পালাক্রমে এনে রাখতে চান নিজের কাছে। উদ্দেশ্য বাচ্চার নিরাপত্তা এবং চাকুরীর নিশ্চয়তা।
যাদের এইরকম কেউ নেই খুঁজেন একটু পরিচিত বা স্বস্তিদায়ক আশ্রয়। সেটাও না পেলে অগত্যা চাকুরীটা ছাড়তেই হয়। কারণ আমাদের দেশে এখনও সেভাবে বেবি সিটিং এর কালচার গড়ে উঠেনি। বাইরের দেশগুলিতে যদিও এটা একটা সরকার নিবন্ধিত প্রফেশন। অনেকেই পর্যাপ্ত ট্রেনিং নিয়ে কর্মজীবী মায়েদের বাচ্চা প্রতিপালন করেন, যার অপরনাম ডে কেয়ার সেন্টার। আমাদের দেশে নামমাত্র কিছু ডে কেয়ার সেন্টার আছে। যেইগুলি কতটা মান সম্পন্ন তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
এক একটা দিন ভীষণ ম্যানেজ করে পার করার পর রাত্রি নামলে ভাবি, এই সময়ের অবসান ঘটবে খুব শিগগীরই। যেখানে দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের প্রতিদান অস্বীকার করার নয় সেখানে কি আমরা পারি না আর একটু উদার হতে চিন্তাধারায়? ঘরে বাইরে সবার সহযোগিতা আর আন্তরিকতা পারে এই পরিস্থিতির চিত্র পালটে দিতে। আশা করি সেদিন আর দূরে নয় যেদিন এই সমস্যা শুধু নারীদের সমস্যা হিসাবে দেখা হবে না, দেখা হবে সমাজের সমস্যা, রাষ্ট্রের সমস্যা হিসাবে। তাহলেই বুঝব, জাতি হিসাবে আমরা আমাদেরকে সত্যিকারের গর্ব করার মত স্থানে নিয়ে গেছি।
লেখক: স্কুল শিক্ষক