ফলস নিড
প্রকাশ | ২৮ এপ্রিল ২০১৭, ১৬:৪৩ | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৫৬
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি অন্তত ঢাকা শহরের দূর সম্পর্কের কোন বিয়েতে আমি আর যাবো না। আজ থেকে বছর দশেক আগে তবু যাওয়া যেতো। এমনিতে শহরের বিয়ের সৌন্দর্য বলে কিছু নেই। বউ-বর সেজেগুজে স্টেজে বসে থাকে। আরেক দিকে ভারী শাড়ি-গয়না পড়া নারী আর মোটা সোফার কাভারের মতো কাপড়ের পাঞ্জাবী পড়া পুরুষেরা গরম হোক শীত হোক তেলজবজব পোলাও-মাংস বা কাচ্চি খায়। আগে তবু বয়স্করা অভ্যাগতদের সাথে বর বা বউ এর পরিচয় করিয়ে দিতেন। অতিথিদের সাথে তাদের সামান্য হাসি বিনিময় হতো, এখন অবস্থা দিনদিন মারাত্মক হয়ে উঠছে।
বিয়ে মানে এখন নট লেস দ্যান শ্যুটিং! ছাতা-ফাতা এনে, দুইতিনজন ক্যামেরাপার্সন বা ভিডিওগ্রাফার রীতিমতো পরিচালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে একটা সিনেমার শ্যুটিং করে ফেলে। বর-বউ কে যেভাবে পোজ দিতে বলে তারা সেভাবে দেয়। পোজ দেয়ার ফাঁকে একটু এদিক-ওদিক হলে, বর বা বউ পরিচিত কারো সাথে একটু কথা বলতে গেলে পরিচালক কষে ধমক দেন। বর বউ আবার সম্বিত ফিরে পেয়ে সিনেমার শ্যুটিং-এ ফেরেন। এরমধ্যে পরিচিত কেউ যদি বর বা বউ এর সাথে কথা বলতে যান তবে তাদেরও যথেষ্ট হেনস্থার শিকার হতে হয়। “আরে ভাই/আপা সরেন তো সামনে থেকে, আমাদের কাজ করতে দেন” টাইপ ধমক খেতে হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আজকাল লোকে বিয়েতে ছবি তোলে না, ছবি তোলার জন্যই বিয়ে করে! আর বিয়ের ছবি তোলার রেট যদি শোনেন! ওয়েডিং ফটো, ইয়োর ড্রিম ইত্যাদি ইত্যাদি নাম দিয়ে রীতিমতো লাখ খানেক টাকার মামলা বানানো হয়। বিয়ের কথাবার্তা পাকা হওয়ার পর থেকে শুরু হয় ছবি তোলা, বাসরঘরে লাইট বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত ছবি তোলা চলে। বর-কনের জুতা, হাতঘড়ি, পার্স- কোনকিছুই ছবি তোলার সাবজেক্ট থেকে বাদ যায় না। এবং এই নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে অনেকসময় অনেক ধরণের ভুল বোঝাবুঝি, দরকষাকষিও হয়।
প্রায় একই অবস্থা বার্থডে পার্টির ক্ষেত্রেও। ইদানিং শুরু হয়েছে থিম পার্টি। শিশুকে সিন্ডারেলা বা বার্বিডল বা এইজাতীয় কোন ক্যারেক্টার বানানো হয়। ওই ধরনের পোশাক পরানো হয়। অভ্যাগতদেরও ওই রঙ পরতে বলা হয় অনেকসময়। শিশুটিকে এই ফিলিং দেওয়া হয় যে সে রাজকুমারী বা রাজপূত্র। আমার এক পরিচিত গর্ব করে বলছিলেন, তার মেয়ের জন্মদিনে ছয় লাখ টাকা খরচ করেছেন। জন্মদিনে আমন্ত্রিত ছিলেন মন্ত্রী-এমপিরা। শিশু সন্তানের জন্মদিনের আয়োজন কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে সম্ভবতঃ ভাবনা-চিন্তা করা উচিত। নীল বা গোলাপী জামা পড়ানো মেয়েশিশুকে যে সিন্ডারেলা অথবা রাজকন্যা বানাচ্ছেন, ছেলেশিশুকে প্রিন্সের অনুভূতি দিচ্ছেন- এই শিশুটি বড় হয়ে বঞ্চিত, দুঃখী মানুষের বেদনা বুঝবে? আপনার সন্তান আপনার কাছে অবশ্যই প্রিন্স কিন্তু সেটা জানানোর জন্য ঢাক-ঢোল পেটানো কেন? আগে এই ধরণের থিম পার্টির আয়োজন করতো উচ্চবিত্তরা। এখন মধ্যবিত্তর হাতে পয়সা আসায় তারাও এইসব ফলো করছে। পয়সা হলেই রুচি হয় না অথবা পয়সা হলেই সেটা দেখানোর জায়গা হিসেবে এইসব পার্টি ফার্টি বেছে নিচ্ছেন তারা।
ইদানিং শুরু হয়েছে আরেকটা ফেনোমেনা। সেহেরী পার্টি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত গয়না পড়ে এবং মুম্বাই বা পাকিস্তান থেকে আনা পাঞ্জাবী-শেরওয়ানী পড়ে সংযমের মাস উপলক্ষে পার্টি দিচ্ছেন উঠতি পয়সাওয়ালারা।
বিয়ের কথা শুরুতে বলছিলাম। আগে শুনতাম পানচিনি তথা এনগেজমেন্ট বা কাবিন অনুষ্ঠানের কথা। এখন শুনি পানচিনি (যেটাকে ফ্যাশনেবল মুসলমানরা ওয়ালিমা বলে থাকেন) মেহেদী সন্ধ্যা, সংগীত সন্ধ্যা, ব্যাচেলর পার্টি তারপর আসে বিয়ের মূল অনুষ্ঠান- গায়ে হলুদ, বিয়ে, বউভাত। এইসব সংস্কৃতি কোথা থেকে এলো তা কারো অজানা নয়। গ্রামে আগে বিয়ের গীত গাওয়া হতো, রঙ খেলা হতো। এইসবের মধ্য দিয়ে হতো আনন্দ আর নিজস্বতা উদযাপন। এখন যেহেতু বাংলাদেশে গ্রাম বলেই কিছু নেই ফলে এসবও আছে কি না জানি না। আর শহর তো নিদারুণভাবে অনুকরণ করছে পশ্চিমকে অথবা ভারতের মিডিয়াবাহিত সংস্কৃতিকে। আর তা করতে গিয়ে, শো অফ এর সংস্কৃতি যেসব ফলস নিড তৈরি করছে পুঁজিবাদ তা খুব চমৎকার কাজে লাগাচ্ছে। অথবা বলা যায়, পুঁজির কাজই হলো নানান ধরনের ছদ্ম প্রয়োজন তৈরি করা যাতে তার বাজার এক্সপানশন করা যায়। পুঁজি সবসময় এমন প্রয়োজন তৈরি করে যাতে মানুষের মনে হয়, এগুলো ছাড়া জীবন অচল, ‘পাখী জামা’র জন্য গ্রামের কিশোরী মেয়েদের আত্মহত্যার খবর তো ডালভাত আমাদের কাছে।
তো পুঁজিবাদ নিশ্চয়ই তার কাজ করবে। আমাদের সংস্কৃতির গ্রাফের ফিতা যত নামছে এসবও তত বাড়ছে। এর কারণ কি? এসবের কারণ তো সীমাহীন ভোগবাদিতা। সবার আজকাল সবকিছু চাই। অল্পে খুশি হওয়ার দিন গেছে। তো এইসব ফলস নিড মেটাতে গিয়ে আমাদের সংস্কৃতি আর সমাজে যেসব ফাঁক তৈরি হচ্ছে তা পূরণ করার জন্য বা রুখে দেবার জন্য কেউ কিন্তু তেমন তৈরি হচ্ছে না। হচ্ছে না বলেই পাশের দেশ ভারত পর্যন্ত এদেশে মেহেদী সন্ধ্যা, সঙ্গীত সন্ধ্যা রপ্তানী করে ফেলল আর আমরা আমাদের দারুণ এট্রাকটিভ বিয়ের গীত, রঙ খেলাকে হারিয়ে ফেললাম। এভাবে প্রতিনিয়ত সবকিছু হারাতে হারাতে অন্তঃসারশূণ্য নিঃস্ব একটা জাতি আমরা কি শুধুই টাকা চিবিয়ে খেয়ে বাঁচবো?
লেখক: সাংবাদিক