সমতার ধারণাটি পরিষ্কার তো আমাদের কাছে?
প্রকাশ | ১৯ এপ্রিল ২০১৭, ১৮:৩৩ | আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৭, ০১:৩০
কোন এক প্রসঙ্গে কাবেরী গায়েন একটা কমেন্ট লিখেছিলেন, “আজকালকার নারীবাদীদের কাছ থেকে আমি একশ হাত দুরত্বে থাকি”-কথাটা কেন জানি না আমার খুব গায়ে লেগেছিল। দিন গেছে, ক্রমশই তার এই মন্তব্যর সাথে আমি একাত্ম হতে থাকি। আর পুরুষেরা কেন নারীবাদকে গ্রহণ করছেন না সেই প্রশ্নর উত্তরও আমার সামনে ধীরে ধীরে স্বচ্ছ্ব হতে থাকে।
পুরুষেরা কেন নারীবাদী হতে পারেন না? বিশেষত: বাঙালি পুরুষ? এই ভাবনাটা আমাকে অনেকদিন কুরে কুরে খেয়েছে। উনবিংশ শতাব্দী থেকে নারীরা অর্ধমানবের জীবন-যাপন থেকে বের হওয়ার লড়াইয়ে আছে। একশ'বছর লেগেছে এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে বের হতে। শিক্ষা, চাকরী ইত্যাদি ইত্যাদিতে মেয়েরা এগিয়েছে। কিন্তু আমাদের নারীদের সত্যিকার পাবলিক পরিসরে আসা মাত্র কিছুদিন আগে। লড়াইটা করেছেন অগ্রজরা। আমাদের আগের প্রজন্ম লড়াই করেছেন। আমরাও করছি। আমরা অন্তত পাবলিক স্পেসে নিজেদের অধিকার আর বঞ্চনার কথা বলতে পারছি। অনেকক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রজরা তা পারেননি। আর আমরাই বা কদিন বলতে পারছি বা শিখছি? আমি আমার বুঝে ওঠা জীবদ্দশায় তসলিমা নাসরিনের পরিণতি দেখেছি। নারীবাদ যারা ধারণ করেছেন তাদের পরিণতি দেখেছি। কিন্তু এইসব কিছুর মধ্যে কিছু পুরুষকে অন্তত আমাদের লড়াই এর সহযাত্রী ভেবেছি। দমবন্ধ একটা পরিবেশ থেকে আলো-হাওয়া খেলে যাওয়া একটা বারান্দায় আমরা পুরুষের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছি, আমরা সমতা চেয়েছি। এর বেশি এক ফোঁটাও নয়।
কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, ইদানিং আরও বেশি লক্ষ্য করি- পুরুষ আমাদের পক্ষ নন। আওয়ামী লীগ বিএনপি হওয়া যায়, বামদল-ডানদল হওয়া যায়, সত্যিকারের জ্ঞানী বা ভং ধরা আঁতেল হওয়া যায়, আস্তিক-নাস্তিক হওয়া যায় কিন্তু নারীবাদী হওয়া খুব কঠিন আসলে। নারীবাদ এরই মধ্যে হয় উঠেছে গালির সমার্থক। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমি পাই না। পুরুষ কেন নারীবাদী হয়ে ওঠে না বা নারীবাদকে সমর্থন করে না বা সহজে সমর্থন দিতে পারে না- এই প্রশ্নটা দুই পক্ষের কাছেই- যারা নারীবাদ সমর্থন করেন আর যারা করেন না। একজন মানুষ যদি সমতা চেয়ে থাকে এবং ‘নারীবাদ’ যদি সমতার কথা বলে থাকে তবে নারীবাদী হতে সেই পুরুষের সমস্যা কোথায়? নির্ভরযোগ্য সমতাবাদী বন্ধুদের চেহারা আমরা দেখছি। বন্ধুর চেহারায় লুকিয়ে থাকা ভয়াবহ সব পেসিমিস্টদের চেহারা বের হয়ে আসে। ছ্যাঁচ্চড় টাইপ পুরুষদের কথা বাদ দিলাম, খুব সংবেদনশীল পুরুষদেরও দেখেছি নারীর অধিকারের প্রশ্নে, নারীর সমতার প্রশ্নে তারা কেমন পাল্টে যান।
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখন জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর পুরুষের কাছে তো বটেই যারা নারীবাদী রাজনীতি করেন সেইসব নারীর কাছে খোঁজাও জরুরী। আমরা যারা নারীর মুক্তির কথা বলছি, নারীর সমতার কথা বলছি- তারা কি ঠিকভাবে বলতে পারছি? এবার বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ আইন পাস করার পরে এই প্রশ্ন প্রথম আমার মাথায় আসে। এই যে এতোদিনের নারীবাদী আন্দোলন, ইয়াসমিন ধর্ষণ মামলার রায় আনা, ফতোয়া ঠেকিয়ে দেওয়া, নারীর উচ্চশিক্ষার হার, নারীর জিডিপিতে অবদান- এই সব, সবকিছুকে স্রেফ বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আইনটা পাশ করে ফেলল সরকার। কেউ কিছু করতে পারল না। না নারী না পুরুষ- দাঁড়ালো এই আইনের বিরুদ্ধে। আমার তখন মনে হলো, কোন আদর্শ আর প্রেরণার দ্বারা পরিচালিত হয়ে আমরা নারীবাদের কথা বলছি? - এই প্রশ্নটা নিজেকে করা জরুরী। নারীবাদ তো একটা আদর্শিক জায়গা, একটা ফিলিং- এই অনুভুতি নারী-পুরুষ উভয়েরই তো আসা উচিত। এই আন্দোলনে পুরুষকে বাদ দিয়ে তো ভাবার কোন অবকাশ নেই। পুরুষরা কেন এই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন না তার কারণ খোঁজার আগে নারীরও বোধহয় আয়নার সামনে দাঁড়ানোর প্রয়োজন আছে।
একজন নারী কেন নারীবাদী হয়ে ওঠেন? ব্যুভেয়ার যেমন বলেছিলেন,‘নারী হয়ে কেউ জন্মে না, বরং ক্রমশ হয়ে ওঠে নারী’ তেমনি যে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো আর সংস্কৃতির মধ্যে একজন নারীকে বেড়ে উঠতে হয়, যে প্রতিবন্ধকতা তাকে পার হতে হয় শুধু এই অনুভূতি থেকেই একজন নারী ক্রমশ হয়ে উঠতে পারেন নারীবাদী। গ্রামের হাজারো সালমা-রহিমারা গরু পেলে, বাড়ির উঠানে সবজি ফলিয়ে, কাঁথা সেলাই করে, ক্ষেতে নিড়ানি দিয়ে ফসল ফলিয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড় করিয়েছেন। তারা কোন নারীবাদের পাঠ নেননি, কিন্তু তারা অনেক বড় বিপ্লব করে ফেলেছেন। তারা প্র্যাকটিসিং নারীবাদী, সংসার এবং সমাজের অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা আছে কিন্তু তার বদলে যে ফ্রিডমটা তার পাওয়ার কথা ছিল সেটা তারা পাচ্ছেন না কিন্তু। আমরা যারা শহরে বসে নারীবাদ চর্চা করি, তারা কি এই নারীদের কথা বলতে পেরেছি?
এই যে নারীবাদ প্রশ্নে প্রগতিশীল পুরুষদেরও টিপ্পনী- এর পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে আমি একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করলাম। সেটা হলো প্রদর্শন বাতিকগ্রস্ত নারীবাদের চর্চা। সামাজিক গণমাধ্যম নামে শক্তিশালী এক বিভ্রম থাকার কারণে এই প্রদর্শন বাতিকগ্রস্থ নারীবাদ চর্চা আরও প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। নারীবাদের সাথে সামাজিক স্ট্যাটাস মিলে-মিশে এক অদ্ভুত রূপ দাঁড়াচ্ছে। আমি অন্তত কয়েকজন নারীবাদী পুরুষকে চিনি, যারা নারীবাদকে একেবারেই ভেতর থেকে ধারণ করেন। কিন্তু নারীবাদের ঝান্ডাধারীরা তাদের ঠিকমতো হজম বা গ্রহণ করতে পারেননি। যে নারীবাদ চর্চা আমি বা নারীবাদীরা করছি তা আবার সমাজে প্রদর্শনযোগ্য কি না, সেই নারীবাদ দিয়ে আমি স্ট্যাটাস কামাতে পারছি কি না সেটা অনেকটা বিবেচ্য হয়ে উঠছে দু:খজনকভাবে। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে যে প্রগতিশীল পুরুষটি নারীবাদ ধারণ করতে পারছে না বলে কান্নাকাটি করছি তার সাথে এইসব নারীবাদীর পার্থক্য কি? সমতার ধারণা তো তাহলে এদের মধ্যেও পরিষ্কার নয়। এই নারীবাদ চর্চায় ব্যক্তি নারীর লাভ হতে পারে, সার্বিকভাবে নারী অধিকারের কোন লাভ হচ্ছে বা হবে কি?
পুরো লেখাটা পড়ে যদি কারো মনে হয় যে পুরুষদের নারীবাদী না হওয়ার পেছনের একমাত্র কারণ হিসেবে আমি নারীকেই দায়ী করছি- তাহলে খুব অবিচার করা হবে। তবে আমার ক্ষুদ্র বোঝা এবং চর্চায় এটুকু বলতে পারি যে, আমাদের সবাইকে মিলেই আসলে ভাবতে হবে আরও। পুরুষের অংশগ্রহণটা আসলেই বাড়াতে হবে এই চর্চায়। এবং তার জন্য ফিলিংটা ভেতর থেকেই আসতে হবে। ভাবনার জায়গাটা প্রসারিত এবং চর্চার জায়গাটা প্রশস্ত করার জন্য যে ক্ষেত্রটি দরকার- সেটিও তো আমাদেরই তৈরি করার দায় এখন। আফটার অল, আমরা একটা যুদ্ধে আছি- এটা ভুলি কেমনে!
লেখক: সাংবাদিক