মেয়ে, নিজেকে ভালোবাসো!

প্রকাশ | ১৭ এপ্রিল ২০১৭, ২০:২৬

কাউন্সেলিং একটি স্বয়ংসম্পুর্ণ বিজ্ঞান। আমি যার কিছুই জানি না। তবে দীর্ঘদিন পাচারের শিকার নারী ও কিশোরীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার নারী ও পুরুষের মনোসামাজিক আচরণ পরিবর্তন নিয়ে কাজ করেছি অনেকদিন। নিজেও বিভিন্ন রকম মানসিক চাপ মোকাবেলায় বিভিন্ন সময় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং সাইকোলজিস্ট এর সাহায্য নিয়েছি। এর মধ্যে হয়তো কিছুটা অভিজ্ঞতা আমি অর্জন করেছি। কিন্তু দিনের শেষে আমি একজন লেখক মাত্র। লেখক কখনোই পরামর্শক নন, অতিজোর মোটিভেটর হতে পারে।

এতো কথা বলার কারণ হচ্ছে, আজকাল অনেকেই বিভিন্ন মানসিক চাপ নিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় আমার পরামর্শ চেয়ে ফোন করেন, কথা বলতে চান। বেশিরভাগ সমস্যাই পারিবারিক কিংবা ক্রিটিক্যাল রিলেশনশিপ এর। যেমন, মেয়েটি মোটা বলে স্বামী দুর্ব্যবহার করে, অন্যদের সাথে কম্পেয়ার করে, বয়ফ্রেন্ড ইগনোর করে, অন্য মেয়েদের নিয়ে সময় কাটায়, স্বামী মা বোনের পক্ষ নিয়ে মেন্টাল টর্চার করে, চাকরি নিয়ে কথা শোনায়, স্ত্রীর টাকা নিয়ে নেয়, সন্দেহ করে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে, আবার অনেক ছেলেকে বউ ডমিনেট করে, টাকা নিয়ে নেয় ইত্যাদি।

মানুষের এরকম ভয়ংকর আবেগিয় অবস্থার সাথে আমার খুব ভালো পরিচয় আছে। উপরে শোনা প্রত্যেকটি মানসিক অবস্থার মুখোমুখি আমি হয়েছি। এই এক জীবনে নিজে ইনফিরিয়র থেকে দেখেছি, সুপিরিয়র স্বামী কিভাবে উপেক্ষা করতে পারে, কতো ঠাণ্ডা মাথায় আমাদের কনফিডেন্স লেভেল শেষ করে দিতে পারে আমাদের স্বামীরা, সেটা আমার চাইতে ভালো কে জানে আর!! আবার এই এক জীবনেই নিজেকে সুপিরিয়র অবস্থায় নিয়ে এসে দেখেছি স্বামীরা ইনফিরিয়র কমপ্লেক্সে ভুগলে সে চাপও কিভাবে মেয়েদেরই নিতে হয়!!!

আজকে যখন মেয়েগুলো অঝোরে কাঁদে, আমি আগে চাই তারা কাঁদুক। তাদের সমস্যা সমাধান আমি করতে পারি না। সে চেষ্টাও আমি করি না। আমি শুধু আমার জীবনের গল্প তাদের শোনাই। তাতে একটা মেসেজ আমি তাদের শেষ পর্যন্ত দিতে পারি তা হলো দিনের শেষে মানুষ নিজেই কেবল নিজের সমস্যা সমাধান করতে পারে, অন্য কেউ না। এই সত্য আমি আমার জীবন থেকে শিখেছি। নিঃশর্ত আত্মসমর্পন না করে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে নেগোসিয়েশন করতে পারলে যে দাম্পত্য সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত বোঝাপড়া আর সমতার ভারসাম্য আনা যায়, সেও এই এক জীবনেরই শিখন।

"আমার শরীর, আমি মোটা থাকবো না কি শুকাবো সেটা একেবারেই আমার কনসার্ন, তোমার পছন্দে তা চলবে না" - এই উত্তর মুখের উপর দেয়াটা শিখতে হবে, মেয়ে! আবার নিজের ফিটনেস ধরে রাখতে হবে নিজের আত্মবিশ্বাসের জন্যই, স্বামী ধরে রাখার জন্য নয়। অন্য মেয়ের সাথে তোমার স্বামীর ইনবক্স চ্যটের যে স্ক্রিনশট তোমার আছে তা প্রকাশ করতে হবে যখন সে তোমার চরিত্র নিয়ে কথা বলে। যদি নিজে ডুবতে ডুবতেও স্বামীর মান সম্মানের কথা ভেবে অপু বিশ্বাস হয়ে যাও, তবে জীবনভর শাকিবের লাথি খাওয়ার দায় তোমার। ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে অন্যের সময় নষ্ট করো না প্লিজ।

আজ যখন চমৎকার একটি মেয়ে কাঁদছিল আর বলছিলো, "আমাকে কেউ ভালোবাসে না, আমার একলা দুপুরে কোন ফোন আসে না, আমার একজনও বেস্ট ফ্রেন্ড নেই" - আমি কি তখন ওকে বলছিলাম না নিজেকে বলছিলাম জানি না, তবে বলছিলাম, "জানো, আমাকে কেউ ভালোবাসে কিনা, আমি তা থোড়াই কেয়ার করি। কারণ, আমাকে আমি ভালোবাসি। আমার একটি ফোন না এলেও আমার একলা লাগে না, কারণ ওই সময়টুকু আমি নিজেকে কাছে পাই। আমারও কোন বন্ধু নেই, কিন্তু তাতে কিছুই এসে যায় না আমার। আমার ল্যাপটপ, আমার কাজ, আমার লেখালেখি, আমার সন্তান, একটা ভালো বই, প্রিয় গান আর একটা লং ড্রাইভ....ব্যস!! সময় কোথায় আমার বন্ধু খুঁজে বেড়ানোর? আর বেস্ট ফ্রেন্ড বিষয়টাই একটা ধাপ্পা। আমার চাইতে বিশ্বস্ত বন্ধু তো কাউকে দেখিনা আমি!! সবাই ছেড়ে গেলেও যে আমাকে ছেড়ে কখনো যাবে না সে তো এই আমিই!!!

শোন মেয়েরা, আমি যা বলি তা আগে আমি বিশ্বাস করি। আমি ভয়ংকর দুঃসময়েও নিজের সাথে কথা বলি। নিজেকে নিজে সাহস দিই, একা লাগলে নিজেকে নিজে সময় দিই। নিজের সাথে কথা বলার কোন বিকল্প নেই, বিকল্প নেই নিজেকে ভালোবাসার। যেদিন নিজেকে, আবার বলি, শুধুমাত্র নিজেকে ভালোবাসতে পারবে সেদিন তোমার জীবনের অর্ধেক সমস্যার সমাধান এমনিতেই হবে।

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বাবা, মা, স্বামী, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন, কেউই আমার নয়, আমিই কেবল আমার, এই সত্য, কেবল এই একটি সত্যের জোরে আমি আমাকে নিয়ে বাঁচতে শিখেছি। যখনই আঘাত এসেছে, যার কাছ থেকেই হোক না কেন প্রতিরোধ করেছি। নিজেকে ভালো না বাসা অবধি সে প্রতিরোধ আসেনি, জানো? নিজেকে না সম্মান করলে, না ভালোবাসলে সব মেনে নিতে ইচ্ছে করে কেবল। অতএব, নিজেকে ভালোবাসো। নিজের হাত ধরো, নিজেকে এপ্রিশিয়েট করো এতোদূর আসতে পারার জন্য।

বয়ফ্রেন্ড উপেক্ষা করে? স্বামী অন্য মেয়ের সাথে সময় কাটায়? তোমার চাইতে মা বোনের প্রায়োরিটি বেশি? সন্দেহ করে? কম্পেয়ার করে? অপমান করে? ধুর!! যেতে দাও। উপেক্ষা করো। উন্নাসিক হও, উড়িয়ে দাও। নিজের চারপাশে দূর্গ গড়ে তোল। নিজেকে কনসেন্ট্রেড করো। যোগ্য করে তোল, দুর্মূল্য করে তোল। দিন শেষে নিজের যোগ্যতা আর সক্ষমতার চেয়ে বড়ো অস্ত্র আর কিছু নেই। নিজেই যদি নিজেকে তুচ্ছ করে তোল, এভেইলেবল করে ফেল তাহলে কার ঠেকা পড়েছে তোমার মূল্য দেবার?

কারো জীবনে তোমার জায়গা নেই এটা বোঝার সাথে সাথে তার জায়গাটাও সরিয়ে দাও। প্রয়োজনে শুন্যস্থান থাক, কিন্তু কাঁচে যে খুশি হয় তাকে হীরার খনি তুলে দিও না। একটা মানুষের জীবনে জায়গা করে নেয়ার জন্য সর্বশক্তি ব্যয় না করে বরং পুরো জীবনটাই নিজের করে নেওয়ার লড়াই করো। তাই কাওকে আঁকড়ে ধরো না। জানি আপাতত কষ্ট হবে। কিন্তু পারবে শেষ পর্যন্ত। পারবেই। কারো জন্য কিছু থেমে থাকেনা। যে মা সন্তান হারায় সে মাও কিন্তু ঠিকই বাঁচে। সময়ই সব ক্ষত মুছে দেয়। তাই সময় দাও, সময় নাও।

আর হ্যাঁ, বাঁচতে চাইলে উপেক্ষা করতে শেখো। মনে রেখো, উপেক্ষার চেয়ে বড়ো শাস্তি আর হয় না। উপেক্ষার অপমান কতো তীব্র হয়ে বাজে তা যেমন আমি জানি, এও জানি কেবল নিজেকে প্রমাণ করেই এই অপমানের জবাব দেয়া যায়। লড়াইটা জারি রাখতে পারলেই কেবল জয়ের মঞ্চে উঠে দাঁড়ানো যায়।

লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী সংযোগ বাংলাদেশ