আমাদের আর হারানোর কিছু নেই
প্রকাশ | ১৫ এপ্রিল ২০১৭, ১৯:৩৮ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৭, ১৯:৪৮
না, কোথাও খুব বড় কিছু একটা গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। মিলছে না কিছুই। বিশ্বাস করুন প্রাণপ্রিয় নেতা আমার, হিসেব মিলছে না। কিছুতেই মানতে পারছি না। মানা যাচ্ছে না। আমাদেরকে মেনে নিতে হবে সুপ্রিম কোর্টে স্থাপিত গ্রীক দেবীর ভাস্কর্য আসলেই অপছন্দ করেন আপনি? আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে আপনিও ভাস্কর্যকে ‘মূর্তি’ মনে করেন? বাঙালি নারীর অবয়ব আপনার পছন্দ হয়নি? হাস্যকর লেগেছে? এখন এই ‘মূর্তি’ সরানোর জন্য যা যা দরকার সবই করবেন আপনি!!! এও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে?
এই আপনিই তো শহীদ মিনারের যৌথ নকশাকারী ভাষ্কর নভেরাকে সম্মানিত করেছেন একুশে পদক দিয়ে, প্যারিসে বিশেষ দূত পাঠিয়ে নভেরার অভিমান ভাঙ্গিয়ে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগও আপনিই নিয়েছিলেন! আপনিই তো আমাদের সেই প্রিয় নেতা যিনি একজন কবি শহীদ কাদরীকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশে ফিরিয়ে এনে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করেছেন!! এই আপনিই তো সবার বড় আপা হয়ে সংস্কৃতিকর্মিদের নিয়ে গণভবনের ঘাসের উপর বসে একসুরে গলা মিলিয়ে গান করেন ‘ধন ধান্যে পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’!! প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল ভুলে গিয়ে লাইভ অনুষ্ঠানে প্রিয় শিল্পীকে ফোন করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে পারেন আপনিই তো! খেলার মাঠে গ্যালারিতে বসে শিশুসুলভ সারল্যে দাঁড়িয়ে প্রিয় খেলোয়াড়কে অভিবাদন জানাতে আপনার কোন অসুবিধা হয় না!!
অথচ, রাজনীতি কি এমনই অন্ধ ক্ষমতার খেলা যে, এমন আত্মঘাতী চাল দিয়ে খেলে যেতে হয় আপনার মতো দক্ষ ও রাজনীতিবিদকেও? প্রিয় নেতা, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভোটের রাজনীতির দাবার চালে হয়তো এমন আত্মসমর্পনের চাল আপনি দিতেই পারেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্যটির ভাস্কর মৃণাল হক যখন দাবী করেন, “এটি কোন মূর্তি নয় বরং বাঙালি নারীর ভাস্কর্য। ন্যায় বিচারকের ভূমিকায় বাঙালি নারীর অবয়ব দেখাতে চেয়েছি এই ভাস্কর্যে”, তখন আপনার কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আমাদের আশঙ্কা হয়, তবে কি আপনি নারীর ন্যায়বিচারের ক্ষমতাকেও অবিশ্বাস করলেন? আপনি কি আপনাকে অস্বীকার করলেন ?
ওদের এই অদ্ভুতুড়ে দাবী মেনে নেয়ার আগে কি আপনার মনে পড়েনি, এই মৌলবাদী চক্রই লালন ভাস্কর্য ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছিলো? এরা তো সেই পাকিস্থানি ঔরশজাত গোষ্ঠি যারা যুগ যুগ ধরেই সাংস্কৃতিক চেতনাকে ভয় পায়। তাই গণজাগরণের সময় একযোগে সব জেলায় শহীদ মিনারে হামলা করেছিলো। বায়ান্নতেও এরাই গুড়িয়ে দিয়েছিলো শহীদ মিনার। তারপর চার কোটি কারিগর বুকের রক্তে গড়েছে আজকের এই মিনার। এখন যদি পালটা চালে ওরা সেই শহীদ মিনার ভাঙ্গতে চায়, এক নদীর রক্ত পেরিয়ে আসা স্বাধীনতার স্মৃতিসৌধ গুড়িয়ে দিতে চায়, রায়েরবাজারে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ অপসারন করতে বলে, অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাষ্কর্য সরিয়ে ফেলতে বলে, তবে কিভাবে থামাবেন ওদের?
মানুষের আকৃতিতে তৈরি যেকোনো ভাস্কর্যকে ‘মূর্তি’ বলে যখন কাল কিংবা পরশু এ দেশ থেকে জাতির জনকের ভাষ্কর্য সরানোর দাবী নিয়ে আপনার সামনে দাঁড়াবে তখন রুখতে পারবেন তো এই ফ্রাঙ্কেস্টাইনের দৈত্যদের? চট্টগ্রামে চারুকলার সামনের দেয়ালে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আঁকা চিত্রকর্মে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে যে হুমকি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী দিয়ে দিলো, তাতে কি আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠেনি আপনার? এরপরে যখন বলবে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ফুল নিয়ে প্রভাতফেরী করা হিন্দুয়ানি পূজা, স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ ইসলামে বেদায়াত, তখন এসবও বন্ধ করে দিবেন তো মাননীয় নেতা?
আপনি আমার চাইতে অনেক বেশি ভালো করেই জানেন, মানুষের পরিচয় ধর্মে হয় না। মানূষের পরিচয় হয় তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর উক্তিতেই বলি, “প্রকৃতি নিজেই মা হয়ে আমাদের চেহারায় পরিচয়ের চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন। সেটি বাঙালির এক আসল ও অকৃত্রিম অবয়ব। সে কারণে আমাদের দেশে ধর্ম ও সংস্কৃতি চলে হাত ধরাধরি করে"। যে ধর্মের দোহাই দিয়ে ওরা আজ আপনাকে দিয়ে ভাষ্কর্য সরানোর আয়োজন শুরু করলো, ওরা কি জানে যে, মধ্যপ্রাচ্যের কত দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নানা ধরনের ভাস্কর্য? দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়ায় কত ‘মূর্তি’ তারা জানে? এমনকি তাদের জাতীয় বিমানের নামও রাখা হয়েছে রামায়ণের এক পাখির নামে ‘গরুড়’? ইন্দোনেশিয়া নিজেদের পরিচয়েও সংস্কৃতি বা অতীত বাদ দেয়নি বলেই তাদের সরকার প্রধানের নাম হয় সুকর্ণ সুহার্তো কিংবা মেঘবতী।
ওরা কি জানে যে, মহানবী (সা.) মক্কা বিজয়ের পর সেখানে থাকা ৬২টি মূর্তির একটিও নিজ হাতে সরাননি? তার জীবদ্দশায় ৫৮টি মূর্তি সরানো হয়েছিল সেসব গোত্রের ইচ্ছায়, আর বাকি চারটি সরানো হয়েছিল তার মৃত্যুর পর। ইসলামের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে যদি এতোগুলো ‘মূর্তি’ রেখে ইবাদত করা যায়, তাহলে এখন ভাস্কর্য রেখে ওদের ইবাদত হয় না? আরবে নারীরা এখনো আনন্দে উলুধ্বনি করেন, পুরুষরা হাত ধরাধরি করে নাচ করেন, সেও ওই ঐতিহ্যের জন্যই, তাতে তাদের ধর্ম যায় না। আর আজকে নারীমূর্তি দেখলেই তাদের ধর্ম চলে যায়? এই ইসলাম কোত্থেকে, কি উদ্দেশ্যে এলো?
থাক, আর বলতে ইচ্ছে করছে না। কেন বলবো? কাকে বলবো? কি বলার আছে আর? এই ভাষ্কর্য, মূর্তি সব কিছু ছাপিয়ে মগজের প্রকোষ্ঠে আটকে গেছে কেবল একটি ছবি। হেফাজতের কান্ডারী শাফির সামনে নতজানু বঙ্গবন্ধু কন্যা, দক্ষিণ এশিয়ার আয়রন লেডি শেখ হাসিনা, আমার বাংলাদেশ। এটি আমার দেখা সবচেয়ে অসুন্দর ছবি। ছবিটি দেখতে আমার খুব কষ্ট হয়। তবু আমি বারবার ছবিটি দেখি। মৃত স্বজনের লাশের ছবি দেখতে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়, তবু সবাই হাত বুলিয়ে দেয় ছবিটির উপর পরম মমতায়। ঠিক সেভাবেই আমি ছবিটি দেখি। বারবার হাত বুলাই আমার নেতার মুখের উপর।
এই তো, এখানেই তো তিনি। এই তো সেই শেখ হাসিনা, যিনি শর্টকাট গেম খেলেননি রাজনীতির মাঠে। সেই শেখ হাসিনা, আশির দশকের নিষিদ্ধ আওয়ামীলীগ এর কাণ্ডারি। এই তো সেই লৌহমানবী, অবিচল দৃঢ়তায় হিলারি-কেরি-বান কি মুন উড়িয়ে দিয়ে একে একে কার্যকর করেছেন যুদ্ধাপরাধের মৃত্যুদন্ড। এই তো সেদিন দু’হাত মুষ্ঠিবদ্ধ নতজানু জন কেরি'র পাশে উন্নতশির নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি! আহা!!
আর আজ! অনেক চক্রান্তে, অনেক ষড়যন্ত্রে, অনেক কিছু হারিয়ে আবার সব গড়বো বলে যার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম, আজ তিনিই আমাদের বলে দিলেন, আমাদের আর হারানোর কিছু নেই......!!
লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী সংযোগ বাংলাদেশ