'পুরুষতন্ত্র' সবচেয়ে নিকৃষ্ট, ঘৃণ্য ও কালো একটি শব্দ
প্রকাশ | ১৯ জুন ২০১৬, ০৩:৩১ | আপডেট: ১৯ জুন ২০১৬, ০৩:৪১
একজন নারীকে জন্মের পর থেকেই শিক্ষা দেওয়া হয় সে মানুষ হিসেবে পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট, কম শক্তিশালী, কম অধিকার পাওয়ার জন্য সৃষ্ট। সমাজ, রাষ্ট্রের বা পরিবারের আর দশটা অধিকার যা ছেলেরা খুব সহজেই পায়, তা নারীকে পেতে দেওয়া হয় না বিভিন্ন অন্যায় নীতি প্রয়োগ করে। একজন মানুষের মানুষ হিসেবে সমস্ত অধিকার পাওয়ার বৈধতা থাকলেও নারীর ক্ষেত্রে তার প্রাপ্ত অধিকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত করেছে পুরুষের সৃষ্ট পুরুষতন্ত্র নামক অত্যাচারী তন্ত্র। নারী যেখানে জন্ম দান করে মানব জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে, পুরুষ সেখানে নারীকে মেরে, পেশী শক্তির জোরে টিকিয়ে রেখেছে 'পুরুষতন্ত্র' নামের বিশ্বব্যাপী দুর্বল ও সবলের নামে নারী ও পুরুষে (মানুষে মানুষে) বৈষম্য।
নারীর প্রজনন ক্ষমতাই নারী জাতির অগ্রগতির পথে এক প্রধান অন্তরায়। কোন নারী না চাইলেও তাকে মেনে নিতে হচ্ছে প্রজনন দাসত্ব। নারীর গর্ভধারণ তার গুণ নয়, এটা প্রকৃতিগত ভাবে তার শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। গর্ভধারণ নারীর কাজের সামর্থ্যকে কমিয়ে দেয়। কাজের সামর্থ্য কমার দরুণ খাদ্য, নিরাপত্তা ও শারীরিক অক্ষমতার জন্য তাকে হতে হয় পুরুষের উপর নির্ভরশীল। যে নারী যত বেশি গর্ভধারণ করে, তার শারীরিক শক্তি ততো বেশি কমে যায়, এর পাশাপাশি বেড়ে যায় সন্তান লালন পালনে সময় দানের ব্যস্ততা।
যেহেতু শারীরিক শক্তি মানসিক শক্তির ধারক, তাই এই শারীরিক দুর্বলতা স্বভাবতই একটা মানুষকে মানসিক ভাবে অসহায় করে তোলে। এসব ক্ষেত্রে নারী তার জীবনসঙ্গীর সকল ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও বেশি করে চায়। যুগের পর যুগ নারীর এই সহায়তাকে নারীর সকল ক্ষেত্রের দুর্বলতা ভেবে পুরুষ তাকে পর করেছে। তার উপর চালিয়েছে আধিপত্যের খড়গ। যেখানে সম্পর্ক হওয়ার কথা ছিল বন্ধুত্বসুলভ। তা না হয়ে সম্পর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে শাসক ও শোষিতের।
আদিম যাযাবর শ্রেণীতে নারীর সন্তান ধারণকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো না। এমনকি নারী নিজেও সন্তান ধারণ ও স্তন্যদানকে পবিত্র জ্ঞান করে নিজের কর্তব্য মনে করতো না। সন্তান ধারণ তাদের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়, প্রতিকূল ও প্রকৃতির বিঘ্নিত দুর্ঘটনা। সেই শ্রেণীর কাছে শিশু হত্যা ছিল অতি সাধারণ ঘটনা। যারা বেঁচে যেতো তারা বাঁচতো খুব অযত্ন আর অবহেলায়। কারণ তখন তাদের কাছে সম্পত্তির কোন মূল্য ছিল না, ছিল না উত্তরপুরুষের জন্য সম্পত্তি রক্ষার চিন্তা।
প্রাক কৃষি যুগে সকল ক্ষেত্রে কাজ ও শক্তির প্রয়োগে নারী ছিল পুরুষের চেয়ে এগিয়ে। বোঝা বহন ও শিকারে নারী ও পুরুষের ছিল সমান অংশগ্রহণ, কোথাও কোথাও নারীর অংশগ্রহণের মাত্রা ছিল পুরুষের চেয়ে বেশি। ধীরে ধীরে বন্য পশু ও বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, গোষ্ঠীর লোক বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার দরুণ বেশি বেশি সন্তান উৎপাদন জরুরী হয়ে উঠে।
নারী প্রকৃতিগত ভাবেই সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে। সন্তান উৎপাদনে নারীর সহযোগিতার অংশকে দুর্বলতা ধরে পুরুষ গড়ে তুলেছে তাদের রাজ্যের ইতিহাস, এ ইতিহাসে পুরুষ তৈরি করেছিল নিজেদের সুবিধেমত নিজেদের জন্য আলাদা এক রাজ্য। তারা তাদের সুবিধের রাজ্যে তৈরি করে রেখেছে যেখানে পুরুষ সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন ও মুক্ত, তৈরি করেছে নারীর জন্য বৈষম্য মূলক ধর্মীয় অনুশাসন, টিকিয়ে রেখেছে বহুবিবাহ, পতিতা-প্রথার নামে বহুগামিতা, উত্তরাধিকারের নামে নিজেদের অস্তিত্বের মূল্য বাড়িয়েছে টাকার অংকে। অন্যদিকে নারীর জন্য তৈরি করেছে আলাদা আরেক রাজ্য সেখানে সে পরাধীন, সীমাবদ্ধ, বন্দী, শোষিত, নিগৃহীত, নির্যাতিত, অবমূল্যায়িত।
শারীরিক শক্তি শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয় তা তো আমরা এখন জেনে গেছি (যদিও মানি না)। দাস প্রথায় বাঘের মত শক্তিধর নিগ্রোরা দাসত্ব করেছে শ্বেতাঙ্গদের। বর্ণপ্রথা এখনো আমাদের শিরায় শিরায় বহমান। আমরা এখনো ফর্সা ও কালো দিয়ে মানুষের মর্যাদা বিবেচনা করি, শারীরিক শক্তির বিবেচনা এক্ষেত্রে নগণ্য। প্রযুক্তির অগ্রগতিতে গাড়িতে হুইল ঘুরিয়ে আমরা এখন ঘণ্টায় একশো কিলোমিটার বেগে গাড়ি দৌড়াই। এখানে নারী পুরুষের শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব বিচার্য নয়। পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে স্পেসশিপে চড়ে নারী পুরুষ উভয়ে একই সাথে মঙ্গলগ্রহে পাড়ি জমায়। এখানেও শারীরিক শক্তি মুখ্য নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কাছে পেশীশক্তি তুচ্ছ, তা পারমাণবিক শক্তির দাপটে প্রকাশ্য। চাইলে পারমাণবিক বোমের সুইচ নারী অথবা পুরুষ যে কেউ চাপতে পারে।
সবচেয়ে বড় সত্য হল নারী কখনো পুরুষের বিপরীতে তার মূল্যবোধ তৈরি করেনি, যেটা পুরুষ করেছে শুরু থেকেই। আজও একইভাবে গড়ে উঠছে নারী আর পুরুষের বৈষম্য ভিত্তিক নিয়মকানুন। ইতিহাস বদলে যায়, ইতিহাস বদলাবেও। ভবিষ্যৎ মানব প্রজাতির কাছে ইতিহাসের পাতায় এই 'পুরুষতন্ত্র' নামক শব্দটি হবে সবচেয়ে নিকৃষ্ট, ঘৃণ্য ও কালো একটি শব্দ এবং নিঃসন্দেহে এই বিশাল কালক্ষেপণের অধ্যায়টি হবে সবচেয়ে বড় কালো একটি অধ্যায়।
লেখক: প্রবাসী লেখক