ফতোয়া ও সালিশ: সুবিধাবঞ্চিত নারীর উন্নয়নের অন্তরায়
প্রকাশ | ০৮ এপ্রিল ২০১৭, ১৩:৫৯
নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলেছে নির্যাতনের রকমফের। কিন্তু বদলায়নি বাংলাদেশের নারীদের ভাগ্য। নারীর ভাগ্য আজও রচনা করে সমাজ, সমাজের মানুষেরা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষেরা। ‘নারী নির্যাতন’ শব্দটাকে শুধুমাত্র নারী নির্যাতন না বলে ‘মানব নির্যাতন’ বলা যেতে পারে। কিন্তু হাজার বছর ধরে নারীর ওপর চলে আসা নির্যাতন যেন সামাজিক প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘরে-বাইরে প্রকাশ্যে নারী নির্যাতিত হচ্ছে। ৬৪ জেলার ৬৮ হাজার গ্রামের বাংলাদেশে নারীর দুঃখ ও দুর্দশার চিত্র সর্বত্রই স্পষ্ট প্রতীয়মান। ২০১৬ সালে নারী নির্যাতন যেমন বেড়েছে তেমনি এর মাত্রা ও ধরণ ছিল ভয়াবহ; পথে-ঘাটে, বাড়িতে উত্ত্যক্ত, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, হত্যা ও সালিশের মাধ্যমে নারীকে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা বিগত বছরগুলোর চেয়ে অনেক বেড়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা সত্ত্বেও কমছে না নারী নির্যাতন। নির্যাতনের অনেক ঘটনায় মামলা হলেও বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে নির্যাতিত পরিবারগুলো আপস-মীমাংসা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৬ এর একটি প্রতিবেদনে এমন তথ্যই প্রকাশ করেছে কিছুদিন আগে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৬ সালে ৭২৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন, ধর্ষণের পর ৩৭ জনকে হত্যা করা হয় এবং ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেন ৮ জন। সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে ১২ জন নারী নির্যাতনের শিকার হন; এর মধ্যে গ্রামছাড়া, সমাজচ্যুত বা একঘরে করা, মাথার চুল কেটে দেওয়াসহ শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৩৯ জন নারী, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৯৪ জন, নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় ৬৪ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হন ৩৪ নারী, এ ঘটনায় একজন মারা যান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মস্থলে যৌন নির্যাতন ও বখাটের উত্ত্যক্তের শিকার হন ২৪৪ জন। এর মধ্যে ৬ জন নারী আত্মহত্যা করেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় খুন হন ৭ জন নারী ও ৭ জন পুরুষ, বখাটেদের প্রতিবাদ করায় লাঞ্ছিত হয়েছেন ১৩৮ জন। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে ৫ ছাত্রীর। নারী ঘরে-বাইরে নির্যাতনের শিকার হয়, গ্রাম্য সালিশ বৈঠক ও ফতোয়ার মাধ্যমেও নারী মারাত্মক জখম ও নির্যাতনের শিকার হয়, যা নারীকে ভীত সন্ত্রস্ত করে ফেলে, নারীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় বর্বর নির্যাতনের শিকার হতে হয় গ্রাম্য সালিশ-বিচারে। যে পরিমাণে নারী নির্যাতনের শিকার হয় সে পরিমাণে মামলা বা আইনের আশ্রয় নেয় না নির্যাতিত নারীরা বা তাদের পরিবার। মামলা চালানোর মতো যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি নেই অনেকের, সামাজিক লোকলজ্জা বা সমাজের লোক দ্বারা হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে, প্রভাবশালী মহলের চাপ ইত্যাদি নানা কারণে প্রায় ৪ ভাগের ৩ ভাগই আইনের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ পায় না। ফলে নির্যাতিতের সংখ্যা বাড়ছে।
বছর বছর ধরে বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের অপ্রীতিকর ও ভয়ংকর চিত্র আমরা দেখি তার মধ্যে প্রচুর ঘটনা আছে যা গ্রাম্য সালিশ, ফতোয়া প্রদান ও তার প্রয়োগের ফলে ঘটছে। জুতোপেটা করা, দোররা মারা, পাথর নিক্ষেপ, হিল্লা বিয়ে দেয়া, একঘরে করে রাখা, মুখে চুনকালি মেখে জনসম্মুখে প্রদর্শন, জানাজা না দেয়া ইত্যাদির মাধ্যমে ফতোয়া দেয়া চলছেই। ফলে অনেক নারী তার পরিবার গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। ফতোয়া একটা সামাজিক ব্যাধি, যার মূলে আছে কিছু গোঁড়া ধর্মীয় মানুষ, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, প্রথামুখিনতা ও অপ্রগতিশীল চিন্তা ও চেতনা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফতোয়া প্রদানের করা হয় নারী-পুরুষের সম্পর্ককে ঘিরে। সেক্ষেত্রে প্রথম আক্রমণের শিকার হচ্ছে নারী এবং পিছিয়ে পড়ছে নারীরাই। আমাদের সমাজে কতিপয় লোক যেমন গ্রামের মাতবর, মাদ্রাসা শিক্ষক, মোল্লা, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, স্থানীয় চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, স্থানীয় প্রভাবশালী লোক, গ্রামের স্কুলশিক্ষক, গ্রাম্য ডাক্তার যার যেমন ইচ্ছেমত ফতোয়া দিয়ে গ্রাম্য সালিশ-বিচারের নামে নির্যাতিতের উপর চালাচ্ছে আরেক দফা নির্মম নির্যাতন। আর সমাজের বহু অসহায়, হতভাগ্য ও সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র শ্রেণীর নারীরা সেই ফতোয়ার শিকার হচ্ছে।
সালিশ হল মহল্লা ও গ্রামভিত্তিক স্থানীয় লোকসমাজের বিচার ব্যবস্থা এবং গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বার, মাতবর ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে বিচার সভা। প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলে গ্রামপ্রধান সমাজে প্রধানত যে দু’ধরনের বিচারব্যবস্থা প্রচলিত তার একটি হলো সালিশ, অন্যটি হলো সুনির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিচার বিভাগীয় শাখার কার্যক্রম। স্থানীয় পর্যায়ের ছোটখাট বিরোধগুলি এখন বর্ধিত হারে নিয়মিত গ্রামআদালতের বাইরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/সদস্যদের নিকট নিষ্পত্তির জন্য উত্থাপন করা হয়, স্থানীয় সরকার বা ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তাদের পরিচালিত ঘরোয়া সালিশে তা মীমাংসা করা হয়। কিন্তু গ্রামভিত্তিক সালিশের বেলায় তীব্র দলাদলি, রেষারেষি, রাজনৈতিক বিবেচনা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে স্থানীয় সরকার বা ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তাদের পরিচালিত ঘরোয়া সালিশে ব্যাপক দুর্নীতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অধিকাংশ সালিশ পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট আইন বা স্বীকৃত নীতিমালার প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হয় না। বিত্তবান ও প্রভাবশালী মহলের চাপ, অর্থের প্রভাব বা বিশেষ অনুগ্রহ, স্থানীয় সন্ত্রাসীদের ভয় এবং গোঁড়া ধর্মীয় অভিমতের আধিপত্য বিস্তার সালিশে ন্যায়বিচার পাওয়ায় মূখ্য অন্তরায় হয়ে ওঠে। আর ফতোয়া বিষয়টি হচ্ছে মান্য করার একটি বিষয়। আরবি শব্দ ‘ফতোয়া’ এর অর্থ ‘জিজ্ঞাসা’ বা ‘আইন সম্পর্কিত মত’। ধর্মীয় আইন বিশেষজ্ঞ বা মুফতি প্রদত্ত ও প্রকাশিত বিধানকে ফতোয়া বলে। কিন্তু বর্তমানে ফতোয়ার রূপ একেবারেই ভিন্ন। যেখানে সালিশ (কর্তাব্যক্তিরা) কখনো কখনো নিজ স্বার্থে অমানবিক ‘ফতোয়া’ (যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়) কার্যকর করার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। আর এসব ফতোয়া জারি করেন স্থানীয় ধর্মীয় নেতারা। এরপরেও বাংলাদেশের অনেক এলাকায় ও গ্রামপর্যায়ে সালিশ সক্রিয় রয়েছে। ফতোয়া যেন একটি সামাজিক ব্যধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। একশ্রেণীর সুবিধাভোগী লোভী মানুষ নারীকে দমিয়ে রাখতে, নির্যাতন করতে, নারীর অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে, নারীর চলার পথকে সঙ্কীর্ণ করে তোলার জন্য নিজেদের মনগড়া কিছু আইন তৈরি করে নারীদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।
যদিও ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি ফতোয়া নিয়ে দেয়া আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। সে রায়ে বলা হয়েছে—
১. ধর্মীয় বিষয়ে যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তিরা শুধু ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে ফতোয়া দিতে পারবেন। এই ফতোয়া স্বেচ্ছায় গৃহীত হতে হবে। ফতোয়া মানতে কাউকে বাধ্য করা, জোর করা কিংবা অনুচিত প্রভাব প্রয়োগ করা যাবে না।
২. কোনো ব্যক্তির দেশে প্রচলিত আইন দ্বারা স্বীকৃত অধিকার, সম্মান বা মর্যাদা ক্ষুণ্ন বা প্রভাবিত করে, এমন ফতোয়া কেউ প্রদান করতে পারবে না।
৩. ফতোয়ার নামে কোনো প্রকার শাস্তি, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না।
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হওয়ায় পরেও সরকার ও মানবাধিকারকর্মীরা ফতোয়ার বিরুদ্ধে শক্তভাবে ও যথাযথ কোন পদক্ষেপ নিতে পারছেন না সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে। ফতোয়া প্রতিরোধের জন্য দরকার গণসচেতনতা ও সমাজের সকল প্রগতিশীল মানুষের সক্রিয় হয়ে ওঠা। নয়তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষের অত্যাচারের ফলে নারী মানবিকবোধের প্রকাশ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবে।
সংবাদ মাধ্যমে নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যানুসারে মৌখিক তালাক ও হিল্লা বিয়েতে বাধ্য করা, শত্রুতা, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব, ধর্ষণ, অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক, প্রেমের প্রস্তাব ইত্যাদি কারণে গ্রাম্য সালিশ ও ফতোয়ার শিকার হয়ে অনেক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালে গ্রাম্য সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে ঘটে যাওয়া কয়েকটি নারী নির্যাতনের চিত্র উল্লেখ করি (ঘটনার বিবরণ বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে সংগৃহীত)–
ঘটনা ১ : পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের ইছাদি গ্রামে প্রেমের অভিযোগে রাবেয়া বেগম নামের এক নারীকে সালিস বৈঠকে বেঁধে নির্যাতন করে মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়। স্থানীয়রা জানান, ইসাদি গ্রামের হাবিবুর রহমান রাঢ়ীর স্ত্রী, ১ ছেলে ও ১ মেয়ের মা, রাবেয়া বেগমের সাথে একই এলাকার ২ ছেলে ও ৩ মেয়ের বাবা মিজানুর রহমান রাড়ীকে একসাথে কথা বলতে দেখে স্বপনের অনুসারিরা ধরে নিয়ে যায়। এরপর সালিশের নাম করে নারীটির হাত-পা বেঁধে তার উপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। এক পর্যায়ে তার চুল কেটে ফেলা হয়।
ঘটনা ২ : কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলায় অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রাম্য সালিসে এক বিধবাকে ৫০ বার জুতাপেটা ও তার পা ভেঙে দেওয়া হয়। একই দিনে দুই দফায় সালিশ করে এ নির্যাতন চালানো হয়। পুলিশ ওই বিধবা নারীকে উদ্ধার করে কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। স্থানীয় সূত্র জানায়, উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের কাজীরমোড় এলাকায় ওই বিধবার সঙ্গে চা-দোকানদার জসিম উদ্দিনের অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সালিশে ডাকা হয়। সেখানে গ্রামের প্রভাবশালী সালিশকারী ব্যক্তিরা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ওই নারীর পা ভেঙে দেন, তাকে বাড়িতে অবরুদ্ধ করে রাখেন এবং সমাজচ্যুত করে একঘরে করা হয়। এরপরে আহত ওই নারীকে আবারও সালিশের মুখোমুখি করা হয়। ওই সালিশে লোহাজুরী ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্যসহ শতাধিক লোক উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে সাতজনকে দিয়ে জুরি বোর্ড গঠন করা হয়। ওই জুরি বোর্ডের সাতজনের মধ্যে ছয়জনই ফিরোজা খাতুনকে ৫০ বার জুতাপেটার নির্দেশ দেন এবং তা কার্যকর করা হয়।
ঘটনা ৩ : অপহরণের পর কথিত বিয়ের নামে ধর্ষণের শিকার হয়ে অনেক চেষ্টায় উদ্ধার পেলেও সমাজপতিদের রোষ থেকে রেহাই পায়নি খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙার এক কিশোরী। সালিশের নামে অপহরণকারী ও ধর্ষকের বিচার না করে উল্টো নির্যাতিত মেয়েটির ওপরই চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। আর বিচারের নামে কৌশলে নারী পেটানোর এ উৎসবে একসঙ্গে হাত চালিয়েছেন স্থানীয় দুই প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। অতি দরিদ্র পরিবারের ওই কিশোরীকে প্রতারণার মাধ্যমে মাটিরাঙা উপজেলার আদর্শগ্রাম থেকে অপহরণ করেছিল শাহ আলম নামে এক টাক্সিচালক, কিশোরীটির অমতেই তাকে জোর করে বিয়ে করে শাহ আলম। অনেক খোঁজাখুঁজির পর কিছুদিন আগে তার সন্ধান পেয়ে পরিবার সদস্যরা কিশোরীটিকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় কাউন্সিলর নুরুল মেয়েটিকে ডেকে পাঠান। এরপর বিষয়টি মীমাংসা করে দেওয়ার কথা বলে সেদিনই আদর্শপাড়ার নুরু মিয়ার দোকানে সালিশ বৈঠক ডাকেন তিনি। ওদিন বিপুলসংখ্যক জনতার সামনে কিশোরীটিকে দোষী সাব্যস্ত করে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করেন কাউন্সিলর নুরুল। এ সময় মেয়েটিকে দুই পা মেলে বসতে বাধ্য করে তার চুলের মুঠি ধরে বেত দিয়ে ইচ্ছামতো পেটান ওই নেতা। এতেও রক্ষা পায়নি কিশোরীটি। রাজনৈতিক বৈরিতা থাকলেও নারীকে পেটানোর সুযোগ পেয়ে একগোত্রে ভিড়ে যান ওই ওয়ার্ডের বিএনপির সভাপতিসহ আরো কয়েকজন আওয়ামী লীগ-বিএনপি ক্যাডার। তাদের ক্রমাগত নির্যাতনে মারাত্মকভাবে আহত কিশোরীটিকে মাটিরাঙা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এ সময় অপহরণকারী ও ধর্ষক শাহ আলমকে লোকদেখানো মারধর করে ছেড়ে দেয় সালিশের উদ্যোক্তরা। মীমাংসার নামে মারধর করা হলেও ওই সালিশে ঘটনাটির কোনো মীমাংসা করেনি সালিশকারীরা।
ঘটনা ৪ : অপহরণের পর ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনের বিচার চেয়ে বেকায়দায় পড়ে এক মেয়ের বড় ভাই। আদালতে মামলা করায় স্থানীয় চেয়ারম্যানের নির্দেশে গ্রাম্য সালিশে হাজির করা হয় মেয়ে ও তার মামা-বাবাকে। ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন কাজল এই সালিশ আহ্বান করেন। নির্যাতনের শিকার মেয়েটি জানায়, এমনিতে লজ্জায় ঘর থেকে সে বের হয় না, তার ওপর জনসমক্ষে সালিশে গিয়ে পাশবিক নির্যাতনের ঘটনাটির বর্ণনা দিতে হবে। এ অবস্থায় সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। আদালতে বিচার চাওয়ার জের ধর্ষণের গ্রাম্য সালিশ শিরোনামেই সংবাদটি ছাপা হয়।
ঘটনা ৫ : হিল্লা বিয়ের ‘ফতোয়া’ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার আশেকপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ চকজোড়া গ্রামের মানুষ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদে রাগের মাথায় ‘তালাক’ শব্দ উচ্চারণ করলেই ওই দম্পতির ওপর নেমে আসছে সমাজপতিদের ‘ফতোয়া’। হিল্লা বিয়েতে রাজি না হলে করা হচ্ছে সমাজচ্যুত। একাধিক দম্পতিকে গ্রামও ছাড়তে হয়েছে। দক্ষিণ চকজোড়া গ্রামের এই সমাজপতিদের একটি সংগঠনও আছে, নাম ‘একতাবদ্ধ সমাজ’। গ্রামের প্রায় ১০০ ঘরের লোককে ওই সমাজের ‘ফতোয়া’ মানতে হয়। গ্রামের একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন, গত ১৭ বছরে মাতব্বরদের ‘ফতোয়া’র শিকার হয়েছেন অন্তত ২০ দম্পতি। সর্বশেষ ‘একতাবদ্ধ সমাজের’ হিল্লা বিয়ের ‘ফতোয়া’ না মানায় গ্রামের আখতার হোসেন ও ঝর্না বেগম দম্পতিকে একঘরে করে রাখা হয়েছে।
ঘটনা ৬ : শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানাধীন চামটা গ্রামে ধর্ষিত হয় ১৫ বছরের কিশোরী হেনা আক্তার। পরে গ্রাম্য সালিশে ফতোয়ার শিকার হয়ে দোররার আঘাতে তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। নির্দোষ ও ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বিচার করতে স্থানীয় প্রভাবশালী ইউপি মেম্বার ইদ্রিস ফকির স্থানীয় মসজিদ ও মাদ্রাসার দু’শিক্ষকের সমন্বয়ে ইদ্রিস মেম্বার গঠন করে দোররা বোর্ড। হেনার বাড়িতেই তৎকালীন স্থানীয় ইউপি মেম্বার ইদ্রিস ফকিরের নেতৃত্বে বসে দোররা বোর্ড। হেনাকে ১০১টি দোররা মারার ফতোয়া দেয় ও ফতোয়াবাজদের রায় কার্যকর করা হয়। বোর্ডের নেতৃত্ব দেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম হাফেজ মোঃ মফিজ উদ্দিন ও স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষক সাইফুল ইসলামসহ স্থানীয় মাতবররা। স্থানীয় জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও সালিশ বোর্ডের হুমকীর মুখে হেনাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয় এবং সে মারা যায়।
পাঠক, মাত্র কয়েকটি ঘটনা এখানে দেখছেন, এরকম শত শত ঘটনার বিবরণ দেয়া যাবে। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি যে, নারীও মানুষ কিন্তু নারী অত্যাচারিত হচ্ছে, নিষ্পেষিত হচ্ছে, অবদমিত হচ্ছে আরেকজন মানুষ (পুরুষ) দ্বারা। নারীর বস্ত্র হরণ করা হয়, সম্ভ্রম লুট করে নেয়া হয়; আবার নারীর সব কেড়ে নিয়েও সেই নারীকে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শাস্তি মাথা পেতে নিতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু কেন? কার স্বার্থে? প্রতিদিন সংবাদপত্রে গ্রাম্য সালিশ বিচার-মীমাংসার নামে ফতোয়াবাজদের ফতোয়ার মাধ্যমে নারী নির্যাতনের অনেক খবর পত্রিকায় ছাপা হয়। প্রকৃতপক্ষে ঘটনার সংখ্যা আরো বেশি, পত্রিকার পাতায় সব খবর আসে না, অনেক ঘটনা গোপন রাখা হয়। এসব ফতোয়াবাজ ও সালিশকারীরা পুরুষের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে প্রভাবশালী নির্যাতনকারীর কাছ থেকে অর্থকড়ি নিয়ে নির্যাতিতার বিপক্ষে রায় ঘোষণা করে থাকে। সালিশ-বিচারের নামে যে পরিমাণ টাকা জরিমানা করা হয় তা নির্যাতিত নারী বা তার পরিবারকে না দিয়ে অথবা সামান্য কিছু দিয়ে বাকী বা পুরো টাকা নিজেদের মধ্যেই ভাগাভাগি করে নেয়, এমন কথাও পত্রিকায় প্রায়ই প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ধর্মীয় কুসংস্কার টিকিয়ে রাখতে ও সমাজে পুরুষেরই একচ্ছত্র নেতৃত্ব, ক্ষমতা, শক্তি ধরে রাখতে ও বুঝাতে নারী নির্যাতন করে। যেন পুরুষেরা হল জীব আর নারী জড় পদার্থ–যেভাবে রাখা হবে সেভাবেই নারীকে বেঁচে থাকতে হবে। নারীর বলার কোন ভাষা থাকলে যেন সে ভাষা পুরুষের বিরুদ্ধে উচ্চারিত না হয়, হলে সমাজের কুসংস্কারকে প্রথা বানিয়ে ছলে, বলে, কৌশলে নারীকে নির্যাতিত হতে হবে সমাজের পুরুষ দ্বারা। যেমন কোনো নারী একা একা পরকীয়া বা ব্যভিচার করতে পারে না, ব্যভিচারী করলে একজন পুরুষের সাথেই করতে হয়; কিন্তু শাস্তির বেলায় পুরুষকে লঘুদণ্ড আর নারীকে গুরুদণ্ড দেয়া হয়। ব্যভিচারীর শাস্তি যদি ১০১ দোররা হয় তবে পুরুষকে কেন সেই দণ্ড থেকে বাঁচিয়ে দেয়া হয় সুকৌশলে। কোনো নারীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হলে ধর্ষণের শিকার নারীকেই আবার দোররা বা বেত্রাঘাত সহ্য করতে হয় আর ধর্ষক সামান্য কিছু অর্থদণ্ড দিয়েই মুক্তি পেয়ে যায়। এমন ঘটনাও ঘটেছে ধর্ষণের মীমাংসার নামে ধর্ষককে বিবাহ করতে বাধ্য করা হয়েছে ধর্ষণের শিকার নারীকে, এক্ষেত্রেও নারীর ইচ্ছে বা অনিচ্ছার মূল্য দেয়া হয় না কেননা আমাদের সমাজে নারীর ইজ্জত, সম্ভ্রম বাঁচিয়ে রাখতে হবে, নারীর সম্ভ্রম নারীর শরীরে থাকে, কোনো পুরুষের স্পর্শে নারীর শরীর নষ্ট হয়ে যায়। এমন নানা রকম কুসংস্কার একাবিংশ শতাব্দীতে আজো টিকে আছে। নারী-পুরুষ উভয়েই মানুষ, পুরুষের ছোঁয়ায় নারীর শরীর নষ্ট হলে পুরুষকেও নষ্ট বলা হয় না কেন?
সাধারণ মানুষেরা ধর্মীয় অনুশাসনের বিপক্ষে মতবাদ ব্যক্ত করে না। আমাদের দেশের সাধারণ ধর্মভীরু মানুষ ধর্ম পালন করেন বটে, কিন্তু ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও আইন-কানুন জানেন না। ফলে সরল বিশ্বাসে তারা এসব ধান্ধাবাজ ধর্ম ব্যবসায়ীদের কথা বিশ্বাস করে নিজেরাই ঠকে চলেছেন প্রতিনিয়ত এবং নিজেদের সর্বনাশ জিইয়ে রাখছেন। এভাবে নির্যাতন করে যদি সমাজে নারীকে অবমূল্যায়ন করে কোণঠাসা করে, মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয় তবে সমাজ পিছিয়ে যাবে, কেননা আমাদের দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী এবং এর কুপ্রভাব থেকে সমাজের অন্যান্য নারী, পুরুষ, শিশুরাও রেহাই পাবে না। মানুষের সচেতনতাবোধ, মানবিক ও প্রগতিশীল চিন্তাই পারে ফতোয়ার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে। এসব অপরাধমূলক গ্রাম্য সালিশ-ফতোয়া ও কুসংস্কারাচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে সমাজের বিবেকবান মানুষ ও মানবাধিকারকর্মীদের সচেতন-সজাগ থাকতে হবে, মাঠ পর্যায়ে প্রতিবাদ করতে হবে, প্রশাসনের তৎপরতা বৃদ্ধি ও জোরালো আইনি সহযোগিতা দিতে হবে। আসুন, আমরা নারীর প্রতি সহিংসতাকে রুখে দাঁড়াই, রুখে দাঁড়াই অনৈতিক সালিশের রায় ও অমানবিক ফতোয়ার বিরুদ্ধে। কেননা সালিশ-বিচারে মীমাংসার নামে ফতোয়ার মাধ্যমে কোনো মানুষের মানবিক ও সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা যাবে না এবং ফতোয়ার নামে গ্রাম্য সালিশে কাউকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি। সুবিধাবঞ্চিত নারী উন্নয়নের অন্তরায় ফতোয়া সালিশ কবে বন্ধ হবে!
লেখক: নারীবাদী সংগঠক ও লেখক