সিটে বসা নয়, অপরাধ গায়ে হাত দেওয়া
প্রকাশ | ৩০ মার্চ ২০১৭, ২০:০৩
মেয়েটি বাসে উঠলো এবং ধাক্কাধাক্কির মাঝে সে তার বুকে শক্ত থাবা অনুভব করলো। অথবা মেয়েটি বাসে উঠলো এবং নারী সিটে একজন পুরুষকে বসে থাকতে দেখলো, উঠতে বললো, সে সেখানে গিয়ে বসলো।
এখানে অপরাধ কোনটা ভারি? নারী সিটে বসা নাকি নারীদের শারীরিক লাঞ্ছনা করা? শারীরিক লাঞ্ছনা, শরীরে বুকে ইচ্ছাকৃত হাত দেওয়া অবশ্যই অপরাধ কিন্তু আমাদের দেশে পাবলিক যানবাহনে ঘটে যাওয়া এমন গুরুতর অপরাধের জন্য কোনো শাস্তির বিধান রাখা হয় নি। রাখা হয়েছে নারী সিটে পুরুষ বসলে! তাও ৫০০০ টাকার জরিমানা। এই আইন নিয়ে পুরুষদের উত্তেজিত আর নারীদের উল্লসিত হওয়ার কিছু দেখি না।
এক, এই আইন আদৌ কোনোদিন কেউ প্রয়োগ করবে কিনা সন্দেহ। দুই, বাসে কি এটাই নারীদের প্রধান সমস্যা?
না, নারীদের প্রধান সমস্যা সিটের স্বল্পতা এবং পুরুষদের অশ্লীল আচরণ। 'মহিলা সিট'-কে প্রতিবন্ধী এবং শিশু সিটের কাতারে ফেলা হয়। মানে নারীরা দুর্বল। কেমন দুর্বল? প্রতিবন্ধী আর শিশুরা যেমন দুর্বল! এই কয়েকটা সিট ফিলাপ হয়ে গেলে কন্টাক্টার আর নারী নিতে চায় না বাসে। যেন বাস তার পৈতৃক সম্পত্তি। এখন উপায়? অপেক্ষা করা পরবর্তী বাসের জন্য। অথবা ধাক্কাধাক্কি করে উঠো বাসে এবং এই সুযোগে পুরুষরা তাদের বিভিন্ন অঙ্গের সুব্যবহার করে। হয় খোঁচা দেয়, নয় ঘষে, নয় চাপ দেয়। এসব করে তারা কী বিকৃত মজা পায় তা একমাত্র পুরুষ সমাজই বলতে পারবে।
এটি একটি ভয়ানক অপরাধ। অথচ আমাদের প্রশাসন এই অপরাধকে পাত্তাই দিলো না। তারা আইন বানিয়েছে সেটার জন্য যার কোনো প্রয়োজন নেই। নারী সিটে বসা কোনো অপরাধ না। তাকে উঠতে বললে সে উঠবে, উঠে না এমন পরিস্থিতি কম। বা না উঠলেও তার জন্য তাকে জরিমানা বা শাস্তি দেওয়ার কিছু নেই। শাস্তির প্রশ্ন আসে তখন, যখন সে কারো সাথে অশ্লীল আচরণ করে। এমন ঘটনার সংখ্যা অগনিত। বাসে উঠেছে আর ছেলেদের কুদৃষ্টি এবং কুকর্মের কবলে পড়েনি এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। এখন এই ধরণের ঘটনা অহরহ ঘটে বলেই আমাদের আইন প্রণেতারা এটাকেই স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছেন। এবং স্বাভাবিক ঘটনার জন্য তারা কোনো জরিমানা বা শাস্তির ব্যবস্থা রাখেননি।
এখন প্রশ্ন আসে মহিলা সিট কেন? মহিলা সিট দিয়ে কি সম অধিকার আদায় সম্ভব? মহিলা সিটের আসলে কোনো দরকার নেই। বাসের অন্য জায়গায় একজন পুরুষের যেমন অধিকার আছে বসার নারীদেরও অধিকার আছে বসার। সিট না থাকলে পুরুষ যেমন দাঁড়িয়ে যেতে পারে নারীরাও পারে। এর জন্য কুস্তিগীর হওয়া লাগে না। পারার পরও নারীরা পারছে না বা পারতে দিচ্ছে না কারা? আপনারা পুরুষরা! দাঁড়িয়ে গেলে তাদের শরীর নিয়ে তামাশায় মেতে উঠেন, পাশে বসলেও একই কাণ্ড। এ থেকে তখন পরিত্রানের উপায় হয়ে উঠে এদের ধরে কষে চড় মারা। মারেও অনেকে। প্রতিবাদ ছাড়া এ থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই। মুখ বুজে যত সহ্য করবে ততই এদের নির্লজ্জতা বেড়ে যায়।
সমস্যা হলো সবার পক্ষে প্রতিবাদ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। যারা করছেন না তাদের যে আমি সমর্থন করছি তা নয়। একেক মানুষের পারার ক্ষমতা একেক রকম। কেউ যেমন প্রতিবাদ করে চড় থাপ্পর মেরে বাস থেকে নামিয়ে দেয় আবার কেউ আছে লজ্জায় অপমানে লাল হয়ে হীনমন্যতায় ভুগে। হয়ত বাসে উঠাই ছেড়ে দেয়। তাদের কথা ভেবে এবং নারীদের অবলা ভেবেই এমন 'মহিলা সিট' এর আবির্ভাব। যেহেতু প্রশাসনই নারীদের অবলা ভাবে!
আমরা যারা সম অধিকারের কথা বলি তারা কখনোই নারী সিটের পক্ষে ছিলাম না। বরাবরই বলে এসেছি এই সিট প্রথা শুধুমাত্র শিশু আর প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ হোক। নারী পুরুষ যার যেখানে খুশি বসবে। এবং অতি অবশ্যই সবাই সভ্য ব্যবহার করবে। কিন্তু আমাদের কথা কোনটাই গ্রাহ্য করা হয়নি। ঠিকই আমরা বাসের অন্য সিটে বসি, জায়গা না পেলে দাঁড়িয়েও যাই এবং বুকে, পেছনে কিছু অনুভব হলে এর প্রতিবাদও করি। তাই যারা সুযোগ পেলেই সম অধিকারকে কটাক্ষ করেন তারা নিজেদের ভাইদের ব্যবহারের কথাও উল্লেখ করবেন। আমাদের সম অধিকার চাওয়া পূরণ হবে সেদিন, যেদিন পুরুষদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে। হয় পরিবর্তন হবে নয় চড় থাপ্পড় খেয়ে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া চলতে থাকবে।
নারী বান্ধব রাষ্ট্র বানানোর জন্য আমাদের সরকার, প্রশাসন অনেক কথার ফুলঝুড়ি সাজান। তার ফলস্বরুপ তারা মাঝে মাঝে যে আইন বানান তাতে প্রশ্ন জাগে নারী বান্ধব বলতে তারা আসলে কী বুঝেন? নারীর প্রতি হওয়া অন্যায় অবিচার অপমান অত্যাচার যেন কমে, নাকি নারী যেন এসবের সাথে আরো বেশি করে মানিয়ে চলতে শিখে! দয়া করে এসব হাস্যকর নিয়ম না বানিয়ে কঠোর আইন বানান যেন রাস্তা ঘাটে বাসে গাড়িতে কেউ নারীর সাথে অশ্লীল ব্যবহার করলে জেল জরিমানা হয়। 'সিটে বসলে জরিমানা' এসব আইন দিয়ে নারীদের সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ব্যবহারের ইতি ঘটবে না। আপনাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক: ব্লগার