আমি আমাকে ভালোবাসি !
প্রকাশ | ২৯ মার্চ ২০১৭, ০১:০২
ঘটনা ১.
স্বামীর হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে ধানক্ষেতে অচেতন পরে ছিলেন রাহেলা বানু। অনেকেই ঘিরে রেখেছেন তাকে। কিন্তু কেউ কাছে যাচ্ছে না। মায়ের পাশে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ১৫ বছরের নীতু। কিছুক্ষণ পরপর মায়ের শরীরে হাত দিয়ে মা মা বলে ডাকছে সে। আজই প্রথম নয়, সপ্তাহে একবার হলেও এই দৃশ্য চিত্রায়িত হয় এই গ্রামে নিয়মিত। রাহেলা বানুর বয়স তখন আনুমানিক ৩৫ হবে। তিন সন্তানের জননী তিনি। বড় দুইটি মেয়ে আর ছোটটি ছেলে। বড় মেয়ে তখন কলেজে পড়ে, বিয়ের কথা চলছে, মায়ের পাশে বসা মেয়েটি নবম শ্রেণিতে আর ছোট ছেলেটি পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। রাহেলা বানু গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা। একটু পরে জ্ঞান ফিরলে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন তিনি সেই পতিদেবের জন্য রান্না করতে। তার পতিদেব শহরে ভাল চাকুরী করে। প্রতি সপ্তায় একবার বাড়িতে আসে এবং মনের আর শরীরের শখ মিটিয়ে আবার কর্মস্থলে ফেরত যায়। রাহেলা বানুর বাবার বাড়ি অর্থশালী নয় বলে সেখানে ফেরার কথা তিনি ভাবতে পারতেন না। এর পরের কাহিনী নির্মম বাস্তব। বড় মেয়ের বিয়ের কিছুদিন পর তার স্বামী আরেকটা বিয়ে করে শহরে। এবং ধীরে ধীরে নিতুদের খবর নেয়া ছেড়ে দেয়। শুরু থেকেই সব ভবিতব্য বলে মেনে নিতে নিতে আজ হুইলচেয়ার সঙ্গি তার। বয়স ৬২ এখন, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কাউকে চিনতে পারেন না। নিতুই দেখাশুনা করে তার।
ঘটনা ২.
স্বামীর সাথে বহু ঝামেলা সহ্য করে ডির্ভোস নেয়ার পর দীর্ঘদিন একা ছিলেন আশা। একটা মেয়ে আছে, বয়স ছয় বছর। আলাদা হবার পর ঐ পক্ষের কেউ খোঁজ রাখে না বাচ্চাটার। ভালো একটা চাকুরি করেন আশা। তাতে মা-মেয়ের দিন ভালই চলে। মেয়েকে স্কুলে দিয়েছেন। অফিসে বদলি হয়ে আসা নতুন কলিগ আদিলের সাথে বেশ ভাব জমে উঠে তার। অত্যন্ত বন্ধুসুলভ আচরণে অল্পদিনেই বেশ কাছাকাছি চলে আসে দুজন। আদিল ব্যাচেলর, সুদর্শন, মিষ্টভাষী। মায়ের পাশাপাশি সে মেয়ের মনও দ্রুত জয় করে নিল। মাঝেমাঝে মেয়েকে সে বলতো আমাকে বাপি ডাকো তো মামনি। ছোট মেয়েটি বাবার আদর পায়নি কখনও। তাই সেও আদিলের ন্যাওটা হয়ে উঠলো। আশাও নতুন করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করে দিল মনের অজান্তেই। মেলামেশায় যখন আর কোন বাঁধন রইল না, তখন আশা চাইল আবার সংসারী হতে। কিন্তু সে অপেক্ষায় রইল প্রস্তাবটা আদিলের তরফ থেকে আসার জন্য, হাজার হোক মেয়ে সে! আদিল মুখে অনেক কথা বললেও সেভাবে সিরিয়াসলি বলত না। এভাবে বেশ কিছুদিন গড়ালো। আশা মনেমনে অস্থির। ভাবছিল এবার নিজেই বলবে মুখ ফুটে। হঠাৎ আদিল মায়ের অসুখের খবর পেয়ে বাড়ি গেলো। লম্বা ছুটি চেয়ে দরখাস্ত জমা পড়লো তার নামে। অফিসের সবাই বলাবলি করছিল আদিল বিয়ে করে ফেলেছে। আশা বারবার ফোন দিয়েও পাচ্ছিল না তাকে। বেশ কিছুদিন পর একদিন ফোন দিয়ে নিজেই বলল তাকে ক্ষমা করে দিতে। মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছে সে। মায়ের কথা ফেলার সাধ্য তার নাই। তাকে যেন আশা ক্ষমা করে। চাকুরি ছেড়ে দিয়ে সেই অফিস থেকেই চলে গেল আদিল। ছোট মেয়েটি প্রায়ই খুঁজে আদিলকে। মাকে জিজ্ঞেস করে, মা বাপি আসে না কেন? বাপি বলতে সে আদিলকেই দেখেছে।
ঘটনা ৩.
এই চরিত্র হল প্রথম ঘটনার মেয়েটি, নীতু। মেডিকেলে পড়ার সময়ই তার বড় বোনের ভাল ঘর আর ভাল বর জুটে যায়। ছাত্রী হিসাবে তারা তিন ভাই বোন অসাধারণ ছিল। বড় বোনটি স্বামীর সহযোগিতায় একসময় ডাক্তারি পড়া শেষ করে। এখন তিনি একজন নামকরা ডাক্তার বটে! নীতু ও তার ছোট ভাই দুজনই বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বের হয়। তারপর নীতু একটি প্রাইভেট ফার্মে ঢুকে, আর তার ভাই বিদেশে, খুব ভাল জব করে। একসময় নীতুর বিয়ে হয়। বর নামী কোম্পানির দামি পোস্ট সামলায়। বিয়ের কিছুদিনের মাঝে সে টের পায় বরের অন্য নারী আসক্তি। ততদিনে সে এক কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে ফেলেছে। বরকে অনেক করে ফেরাতে চাইলো। লাভ হলো না কিছুই। তাকে ডির্ভোস লেটার ধরিয়ে দিয়ে সেই নারীকে বিয়ে করে ভদ্রলোক এখন দিব্যি খুব সুখে আছেন, দুই সন্তানের জনক সেই পরিবারে। নীতুর সেই একবছরের মেয়েটি আজ ১৮ বছরের তরুণী। নীতুর আর সংসারে ফেরা হয়নি। আত্মীয়রাই তার আরেকবার সংসারের বিপক্ষে ছিল। কারণ দেখিয়েছিল, তার মেয়েটার ভাল বিয়ে হবে না। মেয়ে আদর পাবে না, ইত্যাদি নানান কিছু। এরপর অনেকেই এসেছে তার জীবনে, কিন্তু মেয়ের কথা ভেবে সে সাহস পায়নি এগুতে। এবং অসহায় মা তার, তার কাছেই আছে। বলে রাখা ভাল, বড়বোনটি অনেক বেশি সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও কোনদিন মায়ের দায়িত্ব নেয়নি, না মৌখিকভাবে না আর্থিকভাবে।
আমার ভাবনা
উপরের তিনটি ঘটনাই আমার দেখা নির্মম সত্যি ঘটনা। শুধুমাত্র নাম পরিবর্তন করেছি। আশা আর নীতু দুজনকেই চিনি কাছ থেকে, নীতু নিজেই চেয়েছে তার কথা নিয়ে লিখি কিছু। সামাজিকতার ভয়ে যদিও পরিচয় গোপন রাখতে হচ্ছে। এই ঘটনাগুলি কি বিচ্ছিন্ন বলে মনে হচ্ছে খুব? মোটেই না। চারপাশে অহরহ ঘটে যাচ্ছে। আমার প্রশ্ন ছিল নীতুর কাছে, খালাম্মা চাকুরী করতেন, তোমরা এত সইলে কেন? তার উত্তর ছিল, মা ভাবতেন, মেয়েদের এইসব সইতে হয়। তাছাড়া, মায়ের ছিল প্রচণ্ড ভয়। মা খুব ভয় পেতেন, যদি আমাদের ভালো বিয়ে না হয়, যদি আমরা বাবার সবকিছু থেকে বঞ্চিত হই! কি পেয়েছ? ছিল আমার জিজ্ঞাসা। কিছুই পাইনি, সার্টিফিকেটে বাবার নাম ছাড়া, নীতুর জবাব।
আমাদের সীমাবদ্ধতা হল আমরা ভাবতে পারি না, মেয়েরাও মানুষ হয়। আমাদের স্বকীয়তাই আমাদের অহংকার হতে পারে। জন্ম থেকেই শেখানো হয়, বিয়েই ঠিকানা। তারপর যাই ঘটুক জীবনে সব সহ্য করতে হবে। বিয়ে হয়ে গেলে উপায়হীন। স্বামী মারুক কিংবা পিটুক, সে ছাড়া কোন গতি নেই। ব্যাপারগুলি আমাদের রক্তে মিশে গেছে। আমরা কিছুতেই ভাবতে পারি না নিজস্বতা হারালে কিছুই বাকি থাকে না। ভালবাসার নামে ব্যবহার হওয়া মেয়েগুলি কবে বুঝবে কোনটা ভালবাসা আর কোনটা প্রতারণা? কেন কোন মেয়েকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার জন্য এত প্রশ্নের সম্মুখীন হবে? এত কিছু ভাবতে হবে?
কর্মে, বাক-স্বাধীনতায় কিংবা নিজের জন্য মতামতে মুক্তি চাইলে মেয়েদের সবার প্রথমে নিজেদের ভালবাসতে হবে, সম্মান দিতে হবে। মেয়েমানুষ না ভেবে নিজেকে মানুষ ভাবতে হবে এবং তার প্রমাণও দিতে হবে। যে কোন অন্যায়-অসম্মানের বিরুদ্ধে চুপ না থেকে মুখ খুলতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিবাদের প্রথম পদক্ষেপই হল প্রতিনিয়ত নিজেকে বলা, “আমি আমাকে ভালবাসি। আমি আমার সাথে কোনরকম অন্যায় হতে দিবো না”। যে নিজেকে ভালবাসতে পারে না, সম্মান দিতে পারে না, অন্য আরেকজন কিভাবে ভালবেসে তাকে সম্মান দিবে? নিজেকে ভালবাসা আজ তাই অস্তিতের লড়াই। আসো নারী, দীপ্ত কণ্ঠে বলি, আমার সাথে কোন অন্যায় আর আমি হতে দিবো না, কারণ “আমি আমাকে ভালবাসি”।
লেখক: শিক্ষক