নারী-পুরুষ নয়; আমাদের পরিচয় হোক মানুষ
প্রকাশ | ২৪ মার্চ ২০১৭, ২৩:০১
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো ৮ মার্চ বাংলাদেশেও পালিত হয় ‘নারী দিবস’। আমি কখনোই এই দিবসের পক্ষে ছিলাম না, এখনও নেই, আগামীতে সমর্থন করবো বলেও সম্ভাবনা নেই। শুধু আমি কেন, যে কোনো সচেতন মানুষ, বিশেষ করে নারীবাদ আন্দোলনের সাথে যুক্ত রয়েছেন, এমন কেউ-ই ‘নারী দিবস’ সমর্থন করবে না বলেই বিশ্বাস করি। এই দিবসে অনেক নারী নেত্রী, বিশেষজ্ঞজনরা দাবি করে থাকেন, ‘নারী দিবস মানেই লিঙ্গবৈষম্য ঘুচিয়ে সমাধিকার প্রতিষ্ঠার ডাক’! কিন্তু সেটা কীভাবে, আমার বোধগম্য নয়। কেননা, এই নারী দিবসের মাঝেই ‘লিঙ্গবৈষম্য’ স্পষ্টত।
একটি দিন নারী দিবসের মাধ্যমে নারীকে সম্মানিত, মহিমান্বিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। নানা প্রশংসাসূচক বক্তব্য দেয়া হয়। ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকে বিশেষ আয়োজন। কোনো কোনো অফিসে এদিন নারীদের নেতৃত্বে সকল কাজকর্ম হয়। এতে করে অনেক নারীই খুশিতে ডগমগ। তারা ভাবে আমাদের কতটা সম্মানিত করা হচ্ছে! অথচ এর মাধ্যমেই রয়েছে বিরাট ফাঁকিবাজি, সে কথা নারী কতটা বুঝতে পারে? তারা কী কখনো ভেবে দেখেছে, নারী দিবস মানেই ‘লিঙ্গবৈষম্য’ স্পষ্ট হয়ে উঠে? নারীবাদ আন্দোলনের ইতিহাস জানা থাকলে, নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন নারী কখনোই ‘নারী দিবস’ পালন করবে না। কেননা, এ দিবসের মাধ্যমে নারীকে নারী ভাবতে শেখায়, পরিপূর্ণ মানুষ হতে শিক্ষা দেয় না।
বাংলাদেশে অধিকাংশ নারীই ‘নারীবাদ’ সম্পর্কে তেমন সচেতন অর্থাৎ প্রকৃত শিক্ষার অভাবে সঠিকভাবে অবগত নন। নারীবাদকে তারা নানাভাবে গুলিয়ে ফেলেন। যা বিকৃতরূপ। কেউ কেউ আছেন নিজেদের স্বার্থের জন্য নারীবাদ আন্দোলনটাকে বিকৃতরূপে উপস্থাপন করেন। মূলত এ কারণে নারীবাদ নিয়ে অনেকের মাঝে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। কারো কারো কাছে নোংরামি বলেও মনে হয়। কিন্তু প্রকৃত নারীবাদ তা নয়। নারীবাদে কোনো নোংরামির স্থান নেই। এখানে অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাই বলা আছে। নারী আন্দোলনের উদ্ভব পরাধীনতা শিকল ছেঁড়ার, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার। ইতিহাসও তাই বলে। নারী আন্দোলন কখনোই বলে না, ‘আমি নারী, নারী হিসেবে আমাকে সম্মান করো'। নারী আন্দোলন বরাবরই বলে, ‘নারী হিসেবে নয়; মানুষ হিসেবে আমার প্রাপ্য বুঝিয়ে দাও'। কিন্তু পুরুষতন্ত্র সে অধিকার দিতে নারাজ। আর নারীও চায় তা প্রতিষ্ঠা করতে। এই লক্ষ্য নিয়েই প্রায় চারশ’ বছর আগে তথা ১৬৪৭ সালে নারী আন্দোলনের সূত্রপাত। সেসময় মার্গারেট ব্রেন্ট ম্যারিল্যান্ডের অ্যাসেম্বলিতে প্রবেশের দাবি করেন, কিন্তু পুরুষতন্ত্র সে দাবি নাকচ করে দিয়ে নারীবাদ আন্দোলনকে উস্কে দিয়েছিল সেদিন। যার সূত্র ধরে ১৬৬২ সালে মার্গারেট লুকাস ‘নারী ভাষণ’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। যা ইতিহাসে প্রথম নারীবাদী সাহিত্য। এ গ্রন্থে তিনি নারীর পরাধীনতা ও অসম অধিকারের বিষয়গুলো অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তুলে এনেছিলেন।
তবে; মার্গারেট লুকাস রচিত ‘নারী ভাষণ’ ইতিহাসে প্রথম নারীবাদীগ্রন্থ ধরা হলেও পলেইন ডি লা ব্যারকেকে ইতিহাসের প্রথম নারীবাদী ধরা হয়। ১৬৪৭ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে তার জন্ম। তিনি ১৬৭৩ সালে নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকার তথা নারীবাদ আন্দোলনের পক্ষে 'equality of the two sexes, speech physical and moral where it is seen the importance to demolish itself prejudge' এই প্রবন্ধটি লিখেন। যা সমগ্র নারী সমাজকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছিল। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘পুরুষ কর্তৃক নারী সম্পর্কে যা কিছু লেখা আছে, তার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে হবে। কারণ, পুরুষ একই সঙ্গে অভিযুক্ত এবং বিচারকের আসনে আসীন'।
ফরাসি বিপ্লবের সময়, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার যে আহ্বান করা হয়েছিলো ১৭৮৯ সালে, সে আহ্বানে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছিলেন বিশ্বব্যাপী নারী কর্মীরা। ধারণা করা হয়েছিলো, ফরাসি বিপ্লবের পর নারী স্বাধীনতা তথা নারীমুক্তি ঘটবে। কিন্তু, কাঙ্ক্ষিত সেই মুক্তি আসেনি। ফরাসি শাসকগোষ্ঠি নারীর সমঅধিকার দিতে কুণ্ঠাবোধ করে। একই সাথে নারীমুক্তি আন্দোলনের তীব্র বিরোধীতা শুরু করেন তারা। যার কারণে নারী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্তদের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে ফরাসি বিপ্লবের দুই বছর পর তথা ১৭৯১ সালে ফরাসি শাসকগোষ্ঠির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ‘নারী অধিকার এবং মহিলা নাগরিকদের ঘোষণা’ প্রকাশ করেন দেশটির নাট্যকার ও উপন্যাসিক ওলিম্পে দ্যা গগ্স। এ ঘোষণাতে তিনি বিশ্বব্যাপী নারীদের জেগে উঠার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘নারী জেগে উঠো; গোটা বিশ্বে যুক্তির সঙ্কেত ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। তোমার অধিকারকে আবিষ্কার করো। প্রকৃতির শক্তিশালী সাম্রাজ্য এবং পক্ষপাত, গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও মিথ্যা দিয়ে অবরুদ্ধ নয়। সত্যের শিখা পাপ ও অন্যায় দখলের মেঘকে দূর করে দিয়েছে।’
ওলিম্পে দ্যা গগ্স’র ঘোষণাপত্রে নারী সমাজ জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিচালিত ফরাসি শাসকগোষ্ঠি। যার ফলে তিনি এই শাসকগোষ্ঠির চক্ষুশূলে পরিণত হন। এমনকি এই আন্দোলনের কারণে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছিল তাকে। ১৭৯৩ সালে নারী আন্দোলনের সাহসী এই মানুষটিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে ফ্রান্সের শাসককূল। তবে অসীম সাহসী ওলিম্পে ফাঁসির কাষ্ঠে যাওয়ার আগে দুরন্ত সাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘নারীর যদি ফাঁসি কাষ্ঠে যাবার অধিকার থাকে, তবে পার্লামেন্টে যাবার অধিকার থাকবে না কেন?’ ওলিম্পে দ্যা গগ্সকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েই ক্ষান্ত হয়নি ফরাসি শাসকগোষ্ঠি। পাশাপাশি তার সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তাই বলে নারী আন্দোলন দমে যায়নি, বরং আরও বেশি বেগবান হয়েছিল, শক্ত হয়েছিলো নারীমুক্তি আন্দোলনের ভিত।
এদিকে ওলিম্পে দ্যা গগ্সকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আগের বছর তথা ১৭৯২ সালে ইংল্যান্ডের নারীবাদী লেখক ও দার্শনিক মেরি ওলস্ট্যানক্রাফট ‘A Vindication of the Rights of Woman’ শিরোনামের একটি গ্রন্থ রচনা করেন। নারীবাদ ইতিহাস বলছে, মেরির হাত ধরেই নারীবাদ আন্দোলন প্রথমে সুসংগিঠত হয়েছিল। মেরি তার বইয়ে নারীর ওপর পুরুষের নির্যাতন, নিপীড়নচিত্র ব্যাপকভাবে তুলে ধরেন। তার লেখার মূল বিষয়বস্তু ছিল, ‘নারী কোনো ভোগের সামগ্রী বা যৌনবস্তু নয়। তারা বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। তাই তাদের স্বাধিকার দিতে হবে'।
১৮৪০ সালে আমেরিকার দাসপ্রথা বিলুপ্তির আন্দোলনের মাধ্যমে উনবিংশ শতাব্দীতে এসে নারীবাদী চেতনা বিকশিত হয়। এ সময় নারী আন্দোলন ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছিলেন, এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন, লুক্রেশিয়া মটো, সুশান বি অ্যান্টনি, লুসি স্টোন, অ্যাঞ্জেলিনা এম গ্রিমকে, সারা এম গ্রিমকে প্রমুখ। এরমধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ গোষ্ঠীর দুই বোন অ্যাঞ্জেলিনা এম গ্রিমকে এবং সারা এম গ্রিমকে’র ভূমিকা ছিল সব থেকে বেশি আলোচিত। তারা দুজন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম যুগের নারীবাদী সংগঠক। এই দুই বোন দাসপ্রথা বিলুপ্তিসহ নারী অধিকারের জন্য যুগপৎ আন্দোলন করেন। তবে দাসপ্রথার আন্দোলনের শুরুটা ছিল ১৮৩৭ সালে। সেসময় আমেরিকায় দাসপ্রথা বিরোধী প্রথম নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ১২টি রাজ্যের ৮১ জন ডেলিগেট অংশ নিয়েছিলেন। ওই সম্মেলনের মধ্য দিয়েই মার্কিন মুল্লুকের নারীরা প্রথমবারের মত পুরুষের পাশাপাশি রাজনীতির সুযোগ পায়।
নারী-পুরুষের অভিন্ন অধিকারের ব্যাপারে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে ১৮৬৮ সালে এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন ও সুশান বি অ্যান্টোনি যৌথভাবে নারীবাদী সাময়িকী ‘দ্য রেভ্যুলেশন’ প্রকাশ করেন। শুধু তাই নয়; ১৮৯১ সালে কেডি স্ট্যান্টনসহ আরও ২৩ জন নারী সম্মিলিতভাবে রচনা করেছিলেন ‘নারীর বাইবেল’। বিশ্বের প্রথম নারী অধিকার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৮৪৮ সালের ১৯ ও ২০ জুলাই। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল নিউইয়র্কের সেনেকা ফলস-এ। ওই সম্মেলন থেকে আমেরিকার ঘোষণার অনুরূপ ‘দ্য ডিক্লারেশন অব সেন্টিমেন্ট’ ঘোষিত হয়। এর ফলে আমেরিকার সংগ্রামী নারীদের লড়াই-সংগ্রাম এবং নারীবাদ চেতনাকে ত্বরান্বিত করেছিল।
তবে তাবৎ বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক সিমন দ্য বোভোয়ার। ১৯০৮ সালের ৯ জানুয়ারি ফ্রান্সের প্যারিসে জন্ম নেয়া এই লেখক ১৯৪৯ সালে দুই খণ্ডে প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠায় রচনা করেন নারীবাদীগ্রন্থ ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’। যা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোড়িত হয়। তার মতো করে এতটা প্রখর যুক্তি নির্ভর নারীবাদীগ্রন্থ ইতিপূর্বে আর কেউ লিখেননি। অলিম্পে দ্য গগ্স’র শহরেই তার মৃত্যুর ঠিক একশ’ এক বছর পর তার জন্ম। অনেকের কাছে তিনি ছিলেন গগ্স’র যোগ্য উত্তরসূরি। প্রচণ্ড মেধা আর দুরন্ত সাহসের অধিকারি সিমোন অত্যন্ত ধারালো যুক্তিসহ তার গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে নারী।’ তার লেখায় তিনি পুরো পৃথিবীতে নারীবাদ তত্বের নতুন এক প্রতিবাদী জোয়ার সৃষ্টি করে। মানুষ নারীবাদ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। সিমোনের ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ গ্রন্থ এখনও নারীবাদীগ্রন্থ হিসেবে অদ্বিতীয় পুরো পৃথিবীতে।
পুরুষতন্ত্র নারীকে সমঅধিকার দিবে না। নারীকে ভোগের সামগ্রী, যৌনবস্তু, কৃতদাসী, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। এই তন্ত্র নারীকে কড়াই-খুন্তির মাঝে আবদ্ধ রাখতে চেয়েছিল। পুরুষতন্ত্রের বিভিন্ন টোপ বহু নারী গিলেছিল। অনেক নারী চায়নি স্বাধিকার। পরনির্ভরশীল হয়ে থাকতে চেয়েছিল। যার কারণে নারীমুক্তি আন্দোলন পুরোপুরি বিকশিত হয়নি। এখানে ধর্মীয় গোঁড়ামি আর পুরুষকে প্রভুর আসনে বসিয়ে স্বেচ্ছায় দাসত্ব বরণ করেছে বহু নারী। যার কারণে পুরুষের তৈরি নিয়মের বাইরে আসতে পারেনি নারী। ভাঙতে পারেনি পুরুষতন্ত্রের নাগপাশ। তবে যারা পেরেছিলেন, লড়েছিলেন নারীমুক্তি নিয়ে, তাদের সেই লড়াইয়ের ফলে পৃথিবীতে আজ অনেকাংশে নারীমুক্তি ঘটেছে। তবে তা এতটা সহজেই আসেনি। শতকের পর শতক ধরে চলা নারীমুক্তি আন্দোলনে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলে এতটুকু স্বাধীনতা অর্জন করেছে নারী সমাজ।
একটি দিবস আর এই দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আয়োজনের জন্য শতকের পর শতক নারীমুক্তি আন্দোলন নয়। নারীমুক্তি আন্দোলনের মূল সারাংশ লিঙ্গবৈষম্য ঘুচিয়ে সমতার সমাজ সৃষ্টির দাবি। যা আজও পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। নানা কৌশলে পুরুষতন্ত্র আজও নারীকে ঘরবন্দি রাখতে চায়। ক্ষমতা, সমতা থেকে বঞ্চিত করতে চায়। যার কারণে নারীবাদ আন্দোলনের ধারাও আজ বিভক্ত। পুরুষতন্ত্রের নাগপাশ থেকে নারী যেন মুক্ত হতে না পারে, সে লক্ষ্যকে স্থির রেখে পুরুষতন্ত্রের ছকে আঁকা নারীবাদ আন্দোলনে জড়িয়ে যাচ্ছে নারী সমাজ। নারী নেতৃত্ব যারা দিচ্ছে তারা অনেকেই পুরুষতন্ত্রের থিউরি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। তাদের অনেকেই স্বাধীন নন; পরাধীনতার শিকলে তারাও আবদ্ধ। তাই প্রশ্ন তুলতেই পারি, পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ থেকে আপনি কী করে নারীমুক্তির কথা বলেন? প্রশ্ন তুলতেই পারি, পুরুষতন্ত্রের মস্তিষ্ক দিয়ে ভেবে, কী করে আপনি নারী নেত্রী হতে পারেন? কজন নারীর প্রতিনিধিত্ব করাই কী নারীবাদ?
তারা নিজেদের মতো করে স্বাধীন ভাবনা কখনো ভাবতে পারে না। তারা যা ভাবে তা পুরুষতন্ত্রের মস্তিষ্ক দিয়ে। যার জন্য ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ আয়োজিত ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের অর্জন ও ব্যর্থতা’ শীর্ষক সেমিনারে মহিলা ও শিশু বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান রেবেকা মোমেন তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘নারী তার শালীনতা, নৈতিকতা ও পারিবারিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে চললে দেশে ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের মাত্রা কমে যাবে। নারীর অশালীন চলাফেরাই নারী নির্যাতনের মূল কারণ!’ তার এই বক্তব্যটি কখনোই সচেতন ব্যক্তির হতে পারে না। এই বক্তব্যটি পুরুষতন্ত্রের মস্তিষ্ক দ্বারা পরিচালিত একজন মানুষের, এটুকু নি:সন্দেহে বলা যেতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাকে বা তার মতো আরও যারা নারী নেত্রী আছেন, তাদের কী নারীবাদী বলা যায়?
নারীবাদ হচ্ছে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। লিঙ্গবৈষম্য ঘুচিয়ে সমতার সমাজ সৃষ্টির প্রয়াসে এই আন্দোলনের উদ্ভব। ‘আমি নারীবাদী’ দাবি করাটা যতটা সহজ, ‘নারীবাদী’ হওয়াটা কী এতই সহজ? আবার জেন্ডারগতভাবে নারী হলেই যে নারীবাদী আর পুরুষ হয়ে নারীবাদী হওয়া যাবে না, তাও কিন্তু নয়। অনেক নারী আছেন, নারীবাদ শব্দটি শুনলেও বিরক্ত হয়ে উঠেন। আবার অনেক পুরুষ যুগযুগ ধরে নারীবাদ আন্দোলনের সাথে যুক্ত রয়েছেন। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছেন। সমতার পৃথিবী হবে, এমন স্বপ্ন দেখছেন, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কাল মার্কস, ডা. লুৎফর রহমান, হুমায়ূন আজাদ প্রমুখ।
নারী-পুরুষের মাঝে যে বিভাজনের দেয়াল, তা আরও প্রকট আকারে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যই নারী দিবসের নামে এতো আয়োজন। নারীমুক্তির জন্য নারীকে পরাধীনতার দেয়াল টপকাতে হবে। এর জন্য চাই নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি। অর্থনৈতিক মুক্তি না ঘটলে পরিপূর্ণভাবে নারীমুক্তি সম্ভব নয়। পরনির্ভরশীলতা কখনোই স্বাধীন হতে দেয় না। এখানে ইচ্ছের মূল্য থাকে না। যা থাকে, তা হলো মানিয়ে নাও, মেনে নাও। চাপিয়ে দেয়া অনেক কিছুই মুখ বুজে মেনে নিতে হয়। সেই সাথে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন প্রয়োজন। তা না হলে অর্থনৈতিক মুক্তিতেও নারীমুক্তি বাধাগ্রস্থ হবে। এক্ষেত্রে কাল মার্কস বলেছিলেন, পুরুষ তার ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য ঘরের বাইরে সময় কাটায়। সে যখন ঘরের ভেতরে ঢোকে, তখন ঘরটিকে ছোটখাটো রাজ্য ভেবে সে রাজ্যের রাজা হতে চায়। তখন সে নিজের বউ ছেলেমেয়েদের দাস-দাসীর চেয়ে বেশি কিছু মনে করে না। তবে এর কারণ যে পুরোপুরি অর্থনৈতিক নয়; তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না'।
সর্বপোরি কথা হচ্ছে, নারী দিবস পালনের আগে একবার গভীরভাবে ভাবুন আর নিজেকে প্রশ্ন করুন, এই দিবস পালনের জন্যই কী চারশ’ বছর আগে নারীমুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত? মনে রাখতে হবে, নারী দিবসের মাঝে নারী অধিকার আবদ্ধ রাখার প্রয়াস ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই দিবসের মাঝে নারীকে নারী হিসেবেই প্রমাণ করার হীন চেষ্টা লুকিয়ে আছে। নারীকে নারী হিসেবে নয়, ‘মানুষ’ হিসেবে মহিমান্বিত করা হোক। নারী-পুরুষ নয়; আমাদের পরিচয় হোক মানুষ।
লেখক: ব্লগার