অন্তরালের মানুষ
প্রকাশ | ২৪ মার্চ ২০১৭, ২১:৪১
‘শূন্য এ বুকে’ নামে একটা মুভি দেখলাম, চূর্ণীর। নারীবাদ এবং নারীবাদি আখ্যানের একটি গন্তব্য যদি হয় নির্যাতনের ব্যাখান এবং বিক্রয়যোগ্য নির্যাতন নির্মাণ, তাহলে এটি সার্থক মুভি। যদি তা না হয়, তাহলে কিছু কথা আছে। নামটা নিয়েই আমার বেদম আপত্তি, যার স্তন নেই তার বুক শূন্য? সেই হাহাকার মেনে নিয়ে তাকে পাখি মোর আয় ফিরে আয় করতে হবে?
চূর্ণী অভিনীত চরিত্রের যে মেয়েটিকে সমতলবক্ষা হবার জন্যে বাসরঘরেই পরিত্যক্ত হতে হয়েছে আর্টিস্ট স্বামীর দ্বারা, সে চিরদিন প্যাডেড ব্রা পরে এসেছে- মানে যা নেই তার একটা ভেলকি নির্মাণ করে এসেছে। যা নেই তা নেই তো কি, এমন মনোভাব কিন্তু তার নেই, বরং যা নেই তা নিয়ে তার প্রবল দ্বিধা আছে যা তাকে এতদিন কুমারী রেখেছে। খাজুরাহোতে গিয়েও সে বাতাসে আলগোছে হাত মেলে দেখে নারীমূর্তির বুকের মাপ (দৃশ্যায়নের সেই অংশটুকু ভারী সংবেদনে টনটনে)। যে তাকে বিয়ে করেছে, সে সেই নির্মিত ভেলকিকে সত্য বিশ্বাস করে বিয়ে করেছে। ভেলকিটা সব নয়, তবে ভেলকিটাও অংশ। ফলে প্রথম যখন তারা একে অপরের কাছে উন্মোচিত হয়েছে, মেয়েটিকে নির্দয়ভাবে ছুঁড়ে ফেলেছে পুরুষ। মর্নিং আফটারে মেয়েটির নিজের খামতিটুকু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা সত্যি বুকে এসে লাগে। আর গায়ে এসে লাগে তার স্বামী, তার শরীরের দোসর- সৌজন্য এবং সম্মানের ভাগীদার যখন বন্ধুর সামনে ক্যানভাসে এঁকে নিজের পুরুষ বন্ধুকে দেখিয়েছে স্ত্রীর স্তনের গড়ন। পুরুষবন্ধুটি সেই অস্বস্তিকর সময়টাতে একটা মেটাফিজিক্যাল উত্তর দিয়েছে সত্যি, কিন্তু পরে ফোনে অন্য পুরুষবন্ধুদের এই ঘটনার কথা জানাতে পিছপা হয়নি। তার মানে ইতরতাটা সংক্রামক।
স্ত্রীর শারীরিক গড়ন পছন্দ হয়নি বলে পুরুষ তাকে অস্বীকার করছে, এই নিয়ে চূর্ণীর সহকর্মী রূপা গাঙ্গুলি উচ্চকন্ঠ হয়েছেন। সত্যি তো, ভালবাসার মানুষ তো সবসময় পছন্দসই লেফাফায় আসে না। যদি তাই আসতো তাহলে সুমুখ আর সুদেহীরাই শুধু ভালবাসা পেত, বাকিদের যে কী হতো ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। সত্যি তো, একটি মেয়ে কি ভালবাসাবাসির শুরুতেই পুরুষকে জানিয়ে দেবে তার স্তন সমতল, ক্যানভাসে এঁকে দেখিয়ে দেবে সাইডভিউ?
কিন্তু এখানে আরো প্রশ্ন আছে। পুরুষের বা নারীর সঙ্গী নির্বাচনের বেলায় কেন এই ঘেরাটোপ? এই ঘেরাটোপের সুবিধা কি শুধু পুরুষ নেয়, নাকি নারীও নেয়? পুরুষ যদি নারীকে তার পছন্দসই গড়নে চায়, নারী কি তার পুরুষকে পছন্দসই শরীরে চায় না? নারী তার পুরুষের যৌনসক্ষমতা এবং সবলতা চায় না? নারী চায় না আজীবন বা আমৃত্যুর এই সামাজিক মুচলেকা যার নাম বিয়ে, সেখানে একটি সক্ষম মানুষ তার সঙ্গী হোক? শারীরিকভাবে সে আনন্দের দানপ্রতিদানে সক্ষম হোক, পোস্ট-কয়টাল আলিঙ্গন দেয়ার মতো হৃদয়বান হোক? শারীরিকভাবে অক্ষম উত্থানে অক্ষম পুরুষ যদি ঘেরাটোপে লুকিয়ে নারীকে বিয়ে করে, তাহলে কি নারী প্রতারিত বোধ করে না? শারীরিক অপরিচয়, এই অপরিচয়ের সাথে আরোপিত বনেদিয়ানা এবং সামাজিক মর্যাদাবোধ হতে পারতো এই মুভির সত্যিকারের কালপ্রিট। যে যার সাথে জীবন কাটাবে, তার সকল পরিচয় (শারীরিক পরিচয় যোগে) জানবার অধিকার তো তার আছে। স্ত্রী এবং পুরুষ নির্বিশেষে। রাস্তার ফুচকা খাওয়ার মতন সেটা সহজ হয়ে যাওয়া উচিত নয়?
মুভির শেষে এসে খুব অপ্রয়োজনীয়ভাবে মেয়েটি এক্স হাসব্যান্ডকে জানায়, মেয়েটির পরবর্তী সংসারে আসা সন্তান এক্সক্লুসিভলি ব্রেস্টফেড ছিল (আকারে কিছুই আসে যায় না এটা প্রমাণ করবার দুর্মর জেদ তো তার থাকতেই পারে, অতএব অতিরিক্ত তথ্য হলেও এটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে।)। মেয়েটির বর্তমান স্বামী, যে কিনা প্রথম স্বামীরই আর্টিস্ট সহপাঠী, যে বহুকাল হয় মেয়েটির প্রেমে পড়েছিল, মেয়েটির প্রেম এবং বিয়ে নিয়ে যার হৃদয়জ্বালার অবধি ছিল না এবং বিচ্ছেদে যার ইন্ধন ছিল, সেই লোকটি এসে এক্সকে বলে, সে তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে যা প্রথম জন মানতে পারেনি তা আসলে মানতে যে কারো কষ্ট হবে, তবু মানিয়ে নিতে হয়। বিশ্বাস করুন, এই কথাটা আর ঐ যে বহুকাল আগে ক্যানভাসে ছবি এঁকে স্তনের মাপ বোঝানোটা আমার কাছে সমান লেগেছে। তার মানে, মেয়েটির সৌজন্য- সৌন্দর্য্য- ভালবাসা- বিশ্বাস এইসব মিলিয়ে কোনো সর্ববিলোপী ছবিই তৈরি করতে পারেনি দ্বিতীয়জনের কাছেও। দুঃখিত, দ্বিতীয় লোকটিকে আমার সুযোগসন্ধানী মানুষ ছাড়া কিছুই মনে হয়নি, যার মেনে নেয়াটাকে মেয়েটি সাংসারিক জয় হিসেবে দেখে নিজের অজান্তেই ঠকে যাচ্ছে।
মুভি শেষ হলে আবারও ‘প্রাক্তন’ মুভিটার মতনই ‘যে সহে সে রহে’ মার্কা মেসেজ পেয়ে বিরক্ত লেগেছে, সহিষ্ণুতা সবসময় উদারতা নয় তো, সহিষ্ণুতা ভালবাসাও নয় সবসময়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কাদামাটি নিয়ে কাজ করতে হয়েছিল, হামিদুজ্জামান স্যারের অধীনে। আমার এক পুরুষ ক্লাসমেট নারীদেহ বানাচ্ছে, আমি উঁকি দিয়ে দেখি কাদামাটির নারী পীবরস্তনী এবং তার কটি মুষ্টিতে ধরবার যোগ্য, হেসে ফেলে বলেছিলাম, “দোস্ত এই পুতুল দাঁড়াবে না রে!” সে বিরক্ত হয়ে বল্লো, “তরে কইসে!”, আরো মাটি যোগ করতেই থাকলো সে। দাঁড় করাতে গেলে মাটির পুতুল ল্যাগবেগিয়ে কটিভঙ্গ হয়ে পড়ে গেল। খাজুরাহোর মূর্তি থেকে শুরু করে আমার সেই নওগাঁপ্রেরিত ক্লাসমেট অব্দি পুরুষের ফ্যান্টাসি কতটা পথই না পাড়ি দিল। প্যালিওলিথিক ভেনাস অবশ্য তুঙ্গস্তনী ছিলেন না।
মুভিতে মেয়েটির আহাম্মক ও ইতর এক্স এবং সুযোগসন্ধানী দ্বিতীয় স্বামী দু’জনই আর্টিস্ট, তার মানে নারীশরীর তাদের কাছে শুধু ফ্যান্টাসি নয়, নারীশরীর এবং অনেকপ্রকারের নারীশরীর তাদের দু’জনেরই কারিকুলামের অংশ। তারা এত ফ্যান্টাসিখোর হবে সেটা গিলতে অসুবিধা হয়।
ফ্যান্টাসির দুনিয়া যা মানুষের সত্যিকারের আকার এবং তার বিচিত্রতা অস্বীকার করে তা দূরে যাক এবং এই অপরিচয়ের ঘেরাটোপে সংঘটিত সব চতুরালি সরে যাক, প্রিয় মানুষকে জানবার পথ ঘৃণ্য নয়।
লেখক: প্রবাসী তরুণ লেখক