'বেলা বোস তুমি পারছ কি শুনতে?'
প্রকাশ | ২৩ মার্চ ২০১৭, ২০:৫৭
কবি, লেখক, গায়ক, গীতিকার, সাহিত্যিক, নির্মাতা, সর্বোপরি সৃষ্টিশীল মানুষদের নিজস্ব সৃষ্টির স্বত্ত্বাধিকার থাকে। কিন্তু সে সৃষ্টিগুলোর চরিত্রের স্বত্ত্বাধিকার তাদের থাকে না। সে চরিত্র হয়ে ওঠে পৃথিবীর যেকোন মানুষের নিজস্ব অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। একজন সাধারণ মানুষ তার অনুভূতিকে পৃথিবীর কাছে শৈল্পিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না। তার মনের গহীনের অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলো প্রকাশ করে দেয় সৃষ্টিশীল মানুষেরা। একজন সাধারণ মানুষ সে গান, কবিতা, গল্প পড়ে চমকে ওঠে- "আরে এতো আমার কথা, আমার কষ্ট, আমার অনুভূতি, আমার গল্প!"
এটা কি 2441139?
হ্যাঁ, বেলা বোসের কথা বলছি! গায়ক অঞ্জন দত্তের বেলা বোস! অঞ্জন নামটা আমি এখানে বেকারদের প্রতিনিধিত্বকারী একটা চরিত্র হিসেবে ব্যবহার করব। আর বেলা বোসকে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা নির্ভরশীল চরিত্রের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে ব্যবহার করব।
বেলা একজন প্রেমিকা। বেলা অঞ্জনের সাথে 'রাস্তার কত সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে' রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করেছে কোন একদিন দামী রেস্তোঁরায় ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের, যেখানে আবছা আলোয় মৃদু স্বরে বাজবে রোমান্টিক কোন গান।
বেলা আর অঞ্জন স্বপ্ন দেখতো কসবার এক নীল দেয়ালের ঘরের, সাদা-কালোর জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে তাদের লাল-নীল সংসারের।
অঞ্জন বেকার। বেকার অঞ্জনের কাছে বেলার মা কিছুতেই বেলাকে অঞ্জনের হাতে তুলে দিবেন না। বেলার সাথে লাল-নীল সংসার করতে অঞ্জনকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষা করতে হয় খেয়েপরে বেঁচে থাকার মত একটি চাকুরীর জন্য। কিন্তু অঞ্জনের ১১০০ টাকা মাইনের চাকুরী পেতে পেতে বেলাকে চলে যেতে হয় আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত অন্য কোন সুপাত্রের ঘরে, অন্য কোন সাদা-কালো সংসারে। যে সুপাত্র হয়তো সারাজীবন শুধু সুপাত্র হওয়ারই অধ্যাবসায় করে গেছে। বেলাকে বোঝার মত, ভালবাসার মত একটি প্রেমিক হৃদয় চর্চার ফুরসত তার কখনো হয়নি, হয়তো সে তার প্রয়োজনই মনে করেনি। তার কাছে বেলাদের সুখী করার একমাত্র উপায় হচ্ছে টাকা-পয়সা, সোনা-গহনা। কিন্তু বেলা তো এতে সুখী হওয়ার মত মেয়ে নয়! বেলার সুখ অঞ্জনের বুকে, বেলার সুখ অঞ্জনের সাথে বৃষ্টিতে ভেজার, বেলার সুখ জোছনায় কোন জীর্ণশীর্ণ ছাদে শীতল পাটিতে বসে দুজন মিলে "ভালবাসি ভালবাসি, সেই সুরে,কাছে-দুরে-জলস্থলে বাঁজায় বাঁশি"-গান গাওয়ায়, বেলার সুখ অলস সন্ধ্যায় ব্যালকনিতে বসে অর্কিড আর লাভ বার্ডগুলোর কিচিরমিচির শব্দে দু কাপ কফি পান করায়।
বেলাবোসের টেলিফোন নাম্বারটা অপরিবর্তিত থাকে ঠিক তার অপরিবর্তিত ইচ্ছেগুলোর মতই। কিন্তু ততদিনে বেলার ইচ্ছেগুলোতে নক করার সুযোগ আর অঞ্জনের থাকে না, তাকে নক করতে হয় শুধু সেই অপরিবর্তিত নাম্বারগুলোতে।
বাস্তবতা যে বড় কঠিন বেলা বোস! যে চাকুরীর সংবাদে তোমার খুশিতে আত্মহারা হওয়ার কথা, আনন্দে চোখে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ার কথা সেই তোমাকে টেলিফোনের ওপাশে নির্বাক শরীরে চোখের জল ফেলতে হয় একবুক পাথরচাপা কষ্টের আর্তনাদে। সে পাথরচাপা বুক নিয়ে তোমাকে স্বামী, সংসার, সন্তানদের সাথে হাসিমুখে সুখী সুখী অভিনয় করে যেতে হয় আজীবন!
আচ্ছা এই বেলা, এই অঞ্জন, এই সুপাত্র কি শুধু এই গল্পেরই চরিত্র? এই চরিত্রগুলো কী চিরন্তন সার্বজনীন নয়? হ্যাঁ আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এ তিনটিই কমন ক্যারেক্টার। এই চরিত্রগুলো শুধু অঞ্জন দত্তের গানের চরিত্র নয়।
আমাদের এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেলার অভাব নেই, যে বেলা তার প্রেমিকের হাত ধরে স্বপ্ন দেখে একটা জীবন পার করে দেয়ার। যে বেলা তার প্রেমিককে ছাড়া বেঁচে থাকার কথা কল্পনাও করতে পারে না। কিন্তু বাস্তবতা! বাস্তবতা তো বড় কঠিন। বেলাকে অপেক্ষা করতে হয় অঞ্জনের চাকুরীর জন্য।
অঞ্জনের কর্মহীনতার কারণে বেলাকে অন্যত্র পাত্রস্থ হতে বাধ্য হতে হয়। তারপরই বেলাকে একটি নিত্যস্ত্রীবাচক অপবাদগ্রস্ত শব্দের শিকার হতে হয়- বেলা তুমি ছলনাময়ী!
স্বার্থপরতা আর লোভের সংমিশ্রনের অপবাদে তুমি পুরুষদের চোখে হয়ে ওঠো ছলনাময়ী।
অথচ অঞ্জনরাও স্বার্থপর হয়, লোভী হয়, ছলনার চূড়ান্ত সীমা পার করে বেলাদের চাইতেও অধিক পরিমাণে। কিন্তু অঞ্জনদের জন্য 'ছলনাময়ী' শব্দের পুরুষবাচক শব্দ নেই। কারণ শব্দগুলো তৈরীই করেছে পুরুষেরা নিজেদের শক্ত অথচ মিথ্যে আত্মবিশ্বাসে।
কিন্তু হে বেলা, তুমি কেন অঞ্জনকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হলে তা কি কেউ ভাবে? তুমি নিজেও কি ভাবো? হ্যাঁ এবার তোমাকে ভাবতে হবে। তোমার ভাবার সময় এসেছে।
একজন বেলা যার নিজের ভরনপোষণের জন্য নির্ভর করতে হয় একজন অঞ্জনের উপর, সে কেন আর্থিকভাবে শক্তিশালী সুপাত্রের সাথে সংসার করতে বাধ্য হবে না? সে কেন বাবা মায়ের বাস্তব অভিজ্ঞতার বোঝাপড়ায় নিজেকে বাবা মায়ের সিদ্ধান্তে আত্মসমর্পন করবে না?
আর বাবা-মা-ই বা কেন তাকে জোর করে হলেও অধিকতর পয়সাওয়ালা ছেলের হাতে তুলে দিতে চাইবে না?
এ সবকিছুর কারণ ঐ একটাই। মেয়ে তুমি অন্যের উপর নির্ভরশীল। যদি তুমি নিজে নিজের ভরনপোষনের দায়িত্ব নিতে পারতে, যদি তুমি প্রেমিকের চাকুরীর জন্য অপেক্ষা না করতে, যদি তোমরা দুজনই স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করতে তাহলে তোমাকে টেলিফোনের ওপাশে বসে কাঁদতে হত না, বাবা-মা জোর করে তোমাকে অন্যত্র পাত্রস্থ করতে পারত না। তুমি প্রেমের সর্বোচ্চ শক্তিতে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারতে।
কিন্তু এ সমাজ তোমাকে সে শক্তিতে শক্ত হওয়ার পথ সুগম করে রাখেনি, অথচ তোমাকে অপবাদ দেয়ার পথটাকে করে রেখেছে মসৃন, সাবলীল। তাই লড়াই যা করার তোমাকেই করতে হবে। তোমার অপবাদের পথ তোমাকেই ঘোচাতে হবে।
আর এই অঞ্জন? এই অঞ্জনরা যদি পুরুষতান্ত্রিকতার ধারক বাহক না হয়ে একটি সমতার সমাজ দেখতে চাইত, শুধু নিজের চাকুরীর উপর নির্ভরশীল না হয়ে বেলাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করত তাহলে তাদেরও টেলিফোনের ওপাশে বেলাদের একটিবার পাওয়ার জন্য হাহাকার করতে হত না।
আর অন্যায়ভাবে বেলাদের মিথ্যা অপবাদ দিতে হত না। বেলাকে ছলনাময়ী, স্বার্থপর,লোভী অপবাদ দেয়ার আগে অঞ্জন তোমাকে বুঝতে হবে এজন্য তুমিই দায়ী, তোমার এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজই দায়ী। বেলাদের কোন দোষ নেই। বেলারা বাস্তবতার শিকার।
আর ঐ সুপাত্র? সুপাত্রেরই বা কি দোষ! সে জানে টাকাওয়ালা সুপাত্র হতে পারলেই বেলাদের পাওয়া যাবে। তাই সে হৃদয়ে প্রেমানুভুতির চর্চা না করে টাকা কামানোর চর্চা করেছে। সে বেলাকে পায়, কিন্তু বেলার ভালোবাসা পায় না। এতে কি সে সুখী হতে পারে? পারে না। সেও তো মানুষ।
তাহলে ভেবে দেখেন তো অন্তত এই টপিকে একজন ছেলের বেকারত্বের কারণে তার প্রেমিকা হারানোর জন্য এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজই দায়ী কি না? বেলা, অঞ্জন, সুপাত্রের সারাজীবন অসুখী হওয়ার পিছনে এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজই দায়ী কিনা?
ইতিহাসে বেলার টেলিফোন নম্বরের প্রতিটা ডিজিট একটি বিচ্ছেদের সাক্ষী হওয়ার জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজই দায়ী কি না?
ভাবেন,একটু গভীরে চিন্তা করেন, উত্তর পেয়ে যাবেন।
আর বেলাদের বলছি, তোমরা শুধু একটা টেলিফোন নাম্বারে পরিচিত না হয়ে একটা ক্যারিয়ারে পরিচিত হও।
স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক বেলা, বাস্তবায়িত হোক বেলা-অঞ্জনের লাল-নীল সংসার।
লেখক: সাংবাদিক ও তরুণ লেখক