নারী দিবস কেন?
প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০১৭, ২১:৫২ | আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৭, ০১:৪৩
নারী দিবস। নারীর জন্য দিবস নিয়ে আমাদের অনেকেরই অনেক প্রশ্ন আছে। নারী কী মানুষ নয়! কেন নারী দিবস? পুরুষের জন্য তো দিবসের প্রয়োজন নেই। উত্তরটা এই প্রশ্নগুলোর মধ্যেই রয়েছে। নারী আজও তার মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার পূর্ণাঙ্গ অধিকার থেকে বঞ্চিত। আজও স্বাধীনভাবে পথচলার জন্য প্রতিনিয়ত লড়ে চলেছে নারী। প্রকৃত মানবজীবন যেদিন নারী অর্জন করবে সেদিন হয়তো আর নারী দিবসের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু আমরা কি হাঁটছি সেই উত্তরণের পথে?
আজ বাংলাদেশে বিবাহের বয়স, বিবাহ যোগ্যতা, বিশেষ পরিস্থিতি ইত্যাদির মতো নানা শর্তে নারীকে বাঁধা হচ্ছে নতুন নতুন বজ্র আঁটুনিতে। ১৮৩৯ সালের আইন বহাল রাখছি এই একবিংশ শতকেও। বলা হচ্ছে নারীর বিয়ের বয়স হবে ১৬ বছর, যা ছিল ১৮ বছর। কিন্তু ইউনিসেফ ১৮ বছর পর্যন্ত মানুষকে শিশু বলেছে। তবে কি বাংলাদেশ শিশু বিবাহকে অনুপ্রাণিত করছে? উস্কানি দিচ্ছে বাল্য বিবাহে? এক্ষেত্রে কি চুক্তি ভঙ্গ হচ্ছে না? আবার বিশেষ ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে ১২ বছরের কন্যাশিশুকেও বিবাহ দেয়া যাবে। এর কারণ হিসাবে কন্যার নিরাপত্তার দোহাই দেয়া হয়েছে। বাবা মা অনিরাপদ বোধ করলে কন্যাকে ১২ বছর বয়সেও বিয়ে দিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে মা বাবা, মধ্যস্থতাকারী বা বিবাহ যিনি করছেন তাদের শাস্তির কোন বিধান থাকবে না। একটা প্রশ্ন এখানে করতে চাই, রাষ্ট্রের নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব কার? রাষ্ট্রের না পরিবার পরিজনের? যদি রাষ্ট্রের না হয় তবে কোন প্রশ্ন নেই, যদি বাংলাদেশের সংবিধান মানি তবে রাষ্ট্রের নাগরিককে নিরাপত্তা দেয়ার ভার রাষ্ট্রেরই। তাহলে কেন, কার ভয়ে কন্যা সন্তানের পিতা অনিরাপত্তায় ভুগবেন? রাষ্ট্রের চেয়ে ক্ষমতাধর কে আছে? তবে কি রাষ্ট্র তার দায় এড়াতে চাইছে? না কি কোন বিশেষ গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে এই আইন?
হয়তো দেখবো পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তনের মত এই আইন রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেলে আবারও হেফাজত আর চরমনাইয়ের পীর সরকারকে ধন্যবাদ, সাধুবাদ দেবে। আমি অবাক হবো না। আমরা দু চারজন রাস্তায় মার খাবো প্রতিবাদ করে আর বাকিরা রবে সয়ে নেবেন রাষ্ট্রধর্মের বা পাঠ্যপুস্তকের মতো। ‘বিশেষ পরিস্থিতি’র দোহাই তুলে বলা হচ্ছে, কোন নারী ধর্ষণের শিকার হলে ধর্ষকের সাথে তার বিবাহ দেয়া হবে। এবার জিজ্ঞাস্য ধর্ষক যদি বিবাহিত পুরুষ হয়, সেক্ষেত্রে নারীটিকে এক অমানুষের কাছে তো হাত পা বেঁধে দিচ্ছেনই আবার সতীনের ঘরে! আবারও জানতে চাই বাংলাদেশে কি বিবাহিত নারী ধর্ষিতা হন না কখনোই! তার বেলায় কি করবেন? আমার অর্বাচীন মনের প্রশ্ন এগুলো। পুরো বিষয়টি এমন যে, “যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই”। যার বিবাহ ব্যবস্থা নিয়ে এত আইন, তর্ক, সেমিনার তার মতামতের কিন্তু কোনই তোয়াক্কা করা হয়নি। নারী এখনও পুরুষের হাতের পুতুল। পিতা থেকে স্বামী, স্বামী থেকে পুত্রের কাছে হাত বদল মাত্র। এই শতকের মানুষ জ্ঞান আহরণের জন্য কী না করছে! নারী বিমান চালাচ্ছে, নানা গবেষণা করছে, নভোচারী হচ্ছে, চিকিৎসা, শিক্ষা, রাষ্ট্র পরিচালনা কোথায় না যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। বাংলাদেশের সাধারণ নারীর কি সেসব অধিকার নেই? তবে শিক্ষা সমাপ্ত করার আগেই কেন তাকে সংসার নামক জোয়ালের সাথে যুতে দেয়ার আইন পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে? সাধারণ পরিবারের কতজন নারী সংসার-স্বামী-সন্তান সামলিয়ে পড়াশুনার সুযোগ পান? কজন নারীই বা স্বাধীন কর্মসংস্থানের সুযোগ পান? বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্মজীবী নারীকে বিবাহ পরবর্তী সময়ে চাকরিটি ছেড়ে সংসার করতে বাধ্য করা হয়। নারী কি সমাজে এখনও মানুষ! একজন নারী শ্রমিক কি একজন পুরুষ শ্রমিকের সমান মজুরি পান? পান না। অফিসে সহকর্মী কিংবা উধ্বর্তন কর্মকর্তার কাছে নারী কি তার কর্মের যথাযথ সম্মান বা স্বীকৃতি পান? উত্তর- না পান না।
এখনও নারীকে অবলা, রমনী, মহিলা ইত্যাদি অসম্মানজনক শব্দে সম্বোধন করা হয়। নারী যদি অবলা হয় তবে আজকের কৃষি ব্যবস্থার উদ্ভাবন তার পক্ষে সম্ভব হতো না। আজকের দশভুজা নারী শহরে কিংবা গ্রামে আমরা দেখতাম না। নারী কি রমনযোগ্য বস্তু মাত্র? তার কি কোন স্বকীয় সম্মানজনক অস্তিত্ব নেই পৃথিবীতে! আসলে পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজই চায় নারীকে অবলা, রমনী বা মহলবাসিনী করে দেখতে; অথচ নিজের প্রয়োজনে বাজার, সন্তানের স্কুল বা কোচিং আনা নেয়া, বিভিন্ন বিল দেয়ার লাইন কোনখানে পাঠাতেই দ্বিধা নেই। কোন প্রশ্ন নেই। তাই বলি পৃথিবী আর কোথায় কি দরকার জানি না তবে এই বাংলাদেশে নারী দিবস নারীর মানুষ হয়ে ওঠার অধিকার আদায়ের জন্য এখনও প্রাসঙ্গিক।
লেখক: সহ-সাধারণ সম্পাদক, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ