পিরিয়ড নিয়ে লুকোচুরি খেলা বন্ধ করুন

প্রকাশ | ১৪ জুন ২০১৬, ১৬:৪১

১. আমেরিকার ফ্লোরিডায় সমকামীদের ক্লাবে মুসলমান জঙ্গির বন্দুক হামলায় নিহত ৫০ আর আহত ৫৩। ফ্রান্সে বোমা হামলা, বেলজিয়ামে হামলা, বাংলাদেশে প্রতিদিন সংখ্যালঘু-নাস্তিক-প্রগতিশীলদের হত্যা। প্রতিদিন এত এত মানুষের মৃত্যুর খবর, অসহনীয় হয়ে উঠছে দিন দিন। ধর্ম নামক একটি রূপকথা প্রতিষ্ঠা করতে এই হত্যাযজ্ঞ! ভাবা যায় না, একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষ এসব রূপকথায় বিশ্বাস করে সহিংসতা করে বেড়াচ্ছে। অনেকে হয়তো বলবেন, এর পেছনে ধর্ম নয়, আছে রাজনীতি। আমেরিকা আলকায়দা-আইএস সৃষ্টি করেছে নিজেদের স্বার্থে, ধর্মের কোন দোষ নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কি ভারতের সৃষ্টি ছিল? বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ শুরু করার পরই ভারত বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে। ঠিক একই ভাবে সব দোষ রাজনীতির উপর দিয়ে ধর্মকে মহান কিছু বানানোর উপায় নেই। সমকামীদের ক্লাবে হত্যার প্রসঙ্গে যারা বলছে, ইসলামে হত্যার কথা বলা নেই। তাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন সমকামীতার শাস্তি ইসলামে কী আছে। তাহলেই বুঝে যাবেন। প্রকৃতিতে ৪৫০ থেকে মতান্তরে ৪৮০ প্রজাতির মধ্যে সমকামীতা পরিলক্ষিত হয়।  ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী আলফ্রেড কিন্সের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি দশ জন ব্যক্তির একজন সমকামী। এটিকে জটিলভাবে দেখে ধর্মের নিয়ম মেনে তাদেরকে আপনি হত্যা করছেন। পশুপাখিদের ধর্ম নামক রূপকথাটির অস্তিত্ব নেই বলে, ধর্মের বর্বর নিয়ম মেনে তাদের কাউকে হত্যা করার প্রয়োজন হয় না। এদিক থেকে পশুপাখিরা আমাদের চেয়ে অনেকটাই সভ্য বলা যায়।
 
২. নাস্তিকদের ভিন্নমতের কারণে তাদের খুন করাকে প্রশ্রয় দিয়েছি আমরা। এখন তাদের হত্যার লিস্ট আর নাস্তিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ভিন্ন মতের জন্য যদি হত্যা করাকে আপনি প্রশ্রয় দেন, তাহলে একদিন হত্যাকারীরা আপনাকেও হত্যা করতে আসবে, কারণ হত্যাকারীদের সব মতের সাথে আপনিও একমত নন, একমত হওয়া সম্ভব না। একসময় দেখা যাবে হত্যাকারীরা নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করছে, কারণ তাদের মধ্যেও মতের পার্থক্য দেখা যাবে। আমাদের সকলেরই বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের আলাদা মত রয়েছে। নাস্তিকদের মধ্যেও নানা বিষয়ে একেক জনের একেক মত, এ নিয়ে প্রতিনিয়ত অনলাইনে যুক্তি তর্ক হচ্ছে। আমি নিজের কথা বলতে পারি, আমি অনলাইনে এসে অনেক কিছু জেনেছি-শিখেছি এই যৌক্তিক তর্কে অংশ নিয়ে। দেশের চলমান অবস্থায়, প্রত্যেকেই আতংকিত। নাস্তিক হত্যার সময় আপনার নীরব সমর্থনই আপনাকে আজকের এই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আমরা আসলে একটা স্বার্থপর জাতি। যতদিন নিজের ঘাড়ে কোপ না আসে, ততদিন বুঝি না কোপের যন্ত্রণা।

৩. ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুললেই মন্তব্য আসে, ‘সকল মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত’। আমি স্বাধীনভাবে আমার মত প্রকাশ করব, আপনিও আপনার মত প্রকাশ করবেন। আপনার মত আমার কাছে যত জঘন্যই মনে হোক না কেন, আপনার মত প্রকাশে আমি বাধা হয়ে দাঁড়াব না, এটিই হলো বাকস্বাধীনতা, এখানেই আপনার মতের প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিহিত। অথচ আমরা মনে করি, আপনার মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মানে, আমার মত প্রকাশ করলে আপনার অনুভূতিতে আঘাত লাগবে এজন্য এখন আমাকে চুপ থেকে আপনার মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে!

ধার্মিকেরা অন্য ধর্মের নিন্দা শুনতে পছন্দ করে, নিজের ধর্ম নিয়ে কিছু বললেই অনুভূতিতে আঘাত লাগে। হিন্দুরা অনেকে বলে থাকেন, হিন্দু ধর্মে পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। কারও কিছু মানতেই হবে এরকম কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এই ধর্মে এমন কোন কথা বলা নেই যা সরাসরি ঈশ্বর বলেছেন, এই ধর্মের সব গ্রন্থই মুনিঋষিরা নিজেদের অর্জিত জ্ঞান থেকে লিখেছেন, যা সবাইকে মানতে হবে এমন কোন কথা নেই। এখন প্রশ্ন হল, যেহেতু তাদের নির্দিষ্ট কোনও নিয়ম বা বাধ্যবাধকতা নেই, কাজেই তারা তো নিজেদের মত নিজেরা স্বাধীন থাকতে পারে, 'সনাতন ধর্ম’কে ব্যানার করে আলাদা একটা গোষ্ঠী বানানোর কী প্রয়োজন? 

আমরা অনেক সময় বলি, ‘লোকটা খুব ভালো’ প্রমাণ হিসেবে বলি, ‘৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন’ নামাজ রোজা করার সাথে কারোর ভালো হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। ধর্মের সাথে নৈতিকতার কোন সম্পর্ক নেই। নামাজ রোজা কাদের মোল্লা, কামারুজ্জমান সহ সকল যুদ্ধাপরাধীরাও করতো। নামাজ-রোজা জঙ্গিরাও করে। বরং সাধারণের চেয়ে একটু বেশিই করে। আমি বরং ধার্মিক ব্যক্তির কথা শুনলে সাবধান হই। কারণ তার নিশ্চিয়ই ধর্মানুভূতি নামক একটা তীব্র অনুভূতি আছে, যেটা কথায়-কথায় আহত হয়, আর এই অনুভূতি আহত হলে সে আমাকে খুন পর্যন্ত করতে পারে। 

পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ইফতারের আগে খাদ্যগ্রহণ করায় এক অশীতিপর বৃদ্ধ হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে পাকিস্তানের এক পুলিশ কনস্টেবল ও তার ভাই তাকে বেধড়ক পিটিয়েছে। এই ঘটনায় কনস্টেবল পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তার ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই ঘটনা যদি বাংলাদেশে ঘটতো, তবে কাউকে গ্রেফতারের প্রশ্নই আসে না। উল্টো ইফতারের সময়ের আগে রোজাদারদের সামনে বিরিয়ানী খেয়ে ধর্মানুভুতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতো। 

৪. রোজার মাসে আরেকটা কমন প্রশ্ন, আপনি কি রোজা? মেয়েদেরকে সাধারণত এই ধরণের প্রশ্ন করা হয়। ‘না’ উত্তর শুনে ‘না’ এর কারণটা কল্পনা করে অনেকে সুখ পায়। কী নোংরা আমাদের মানসিকতা! পিরিয়ডের মত স্বাভাবিক একটি বিষয়কে ট্যাবু বানিয়ে রেখেছি। 

আমাদের কলেজে স্টুডেন্টদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা ছিল। এক বান্ধবীর পিরিয়ড হলে আমরা মেডিকেলে গেলাম প্যাড আনতে। মেডিকেল রুমে ডাক্তারের সামনে বসে ছিল আমাদেরই একজন ছেলে সহপাঠী। তার মাথা ব্যথা জাতীয় কোন সমস্যা। নার্সকে জানালাম প্যাড লাগবে। উনি আমাদেরকে চুপ থাকতে বললেন। ওই ছেলে চলে যাওয়ার পরই নার্স প্যাড দিলেন। ওই ছেলের সামনে প্যাড হাতে নিতে তিনি লজ্জা পাচ্ছিলেন।

প্রতি মাসে মেয়েদের শরীরে একাধিক ডিম্বাণু বড় হতে থাকে এবং মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি পরিণত অবস্থায় স্ফুরিত হয়। ডিম্বাশয় থেকে বের হয়ে আসা ডিম্বাণু শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হলে ভ্রূণ তৈরি হয়, আর তা না হলে ডিম্বাণু ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে মিলিয়ে যায়। আবার নতুন ডিম্বাণু বড় হতে থাকে। ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণুটি বের হওয়ার সময় কিছুটা তরল পদার্থ বের হয়ে আসে, সেটিই পিরিয়ড। আর এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা নিয়ে যারা মুচকি হাসতে পছন্দ করে, আপনি বরং তাদের অজ্ঞতা নিয়ে হাসতে পারেন। রোজা রেখেছেন কিনা জিজ্ঞেস করলে অনেকে বিব্রত হয়ে যান। সবচেয়ে ভালো হয় ধর্মমুক্ত হয়ে এসব ট্যাবুর বিরুদ্ধে যাওয়া, কারণ এসব ট্যাবু ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রের সৃষ্টি। যদি তা না পারেন অন্তত স্পষ্ট কন্ঠে জানান, আপনার পিরিয়ড চলছে। পিরিয়ড চলাকালে অনেকে পরিবারের সাথে সেহেরী খেতে উঠে। সারাদিন কিছু খায় না। কারণ পরিবারের বাবা-ভাইয়েরা যদি বুঝতে পারে যে, সে আসলে রোজা রাখে নি, তার পিরিয়ড চলছে। তবে এটা খুব লজ্জার ব্যাপার হবে। লজ্জা ভাঙ্গুন। পিরিয়ড নিয়ে লুকোচুরি খেলা বন্ধ করুন।