নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতা
প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০১৭, ০৫:৪৫ | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৭, ১৪:৪৩
একবিংশ শতাব্দী একই সাথে মানুষের মানবিক উৎকর্ষ ও অপকর্ষের চূড়ান্ত সময়কাল বলে বিবেচিত হচ্ছে। এই হচ্ছে সেই সময় যখন মানুষ বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞানে পূর্বের যেকোন সময়ের মানুষের তুলনায় অগ্রসর, একইসাথে এটা সেই সময় যখন সম্পদ ও প্রযুক্তির অফুরন্ত যোগান থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে। একবিংশ শতাব্দীর নারী পূর্বের যেকোন সময়ের তুলনায় বেশি ঘরের বাইরে পা ফেলছে, কর্মসংস্থান আছে তার; আবার এই ২০১৭'র মত উত্তরাধুনিক সময়ে এসেও শুনতে হয় প্রায় ৮০ ভাগ নারী নির্যাতনের শিকার। তাই এখনো প্রায় সমান গুরুত্বের সাথে নারীমুক্তির প্রশ্ন আলোচিত হয়। নারী কি মুক্ত হতে পেরেছে সকল শৃঙ্খল ও পরাধীনতা থেকে? নারী কি মুক্ত হতে পেরেছে পুরুষ আধিপত্যের করাল থাবা থেকে? খুব প্রাসঙ্গিকভাবে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ভিত্তিও নিয়ে আলোচনা চলছে সমানতালে।
২০১৭-তেও এসে কেন নারী দিবস পালন করতে হবে? নারীর জন্য আলাদা দিবসের দরকার কী, পুরুষের তো কোন দিবস নেই! এমন প্রশ্ন ও প্রশ্নকারীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। তবে এমন প্রশ্ন যারা করে তাদের একটু ইতিহাসের দিকে মুখ ফেরানো উচিত।
আমরা এমন একটি পৃথিবীতে বসবাস করি, যে পৃথিবীর সভ্যতা-আধুনিকতার মানদণ্ড পশ্চিমাবিশ্ব। সেই ইউরোপে নারীরও যে ভোট দিতে পারা উচিত, নারীরও যে রাজনৈতিক মতপ্রকাশের অধিকার থাকা উচিত তা প্রতিষ্ঠা হবার শতবর্ষ পার হয়নি এখনো। এটা কি ভাবা যাচ্ছে? মানে ১৯৩২ সালেও ইংল্যান্ডে নারীর ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে। এই ভোটের অধিকার অর্জন করতে গিয়ে অনেক নারীনেত্রীকে জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।
যে ফরাসী বিপ্লবের কথা বলতে গিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর গোপন করতে পারে না ইউরোপ ও ইউরোপবাদীরা, যে ফরাসী বিপ্লব ইউরোপ সহ সারাবিশ্বে এনে দিয়েছে সাম্য-স্বাধীনতা-মৈত্রীর ধারণা, যে ফরাসী বিপ্লবে উচ্চারিত হলো- 'সব মানুষ জন্মসুত্রে স্বাধীন' (All men are born free), সেই ফরাসী বিপ্লবেরও সোয়া শ' বছর পরে ইউরোপ উপলব্ধি করলো নারীর ভোটাধিকার অর্থাৎ রাজনৈতিক অধিকার বলে কিছু থাকা উচিত। সেটাও শ্রমজীবী নারীদের চরম ত্যাগ-তিতিক্ষার পরে। তাহলে ফরাসী বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা মেনে নিয়েও আজ কিছু অস্বস্তিকর হলেও অনিবার্য প্রশ্ন সামনে চলে আসে। যে মুক্তির বাণী ওই মানবাধিকার সনদে ধ্বনিত-প্রতিধ্ববনিত হয়, তা কি সমভাবে নারীর জন্যও? 'All men are born free'- এই 'men' কি তবে শুধুই পুরুষ? যে মুক্তির বোধ, ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বপ্ন দেখায় ফরাসী বিপ্লব সেখানে নারীর স্থান কোথায়? নারী কি পুরুষের হাতে তৈরি, পুরুষালি মূল্যবোধ ও পুরুষালি ছকে সাজানো একটি বৈশ্বিক কাঠামোতে পুরুষের অধস্তন হয়েই থাকবে? নারীর কাজ কী হবে সমাজে - পুরুষের অনুপ্রেরণা,সহায়ক শক্তি হয়ে থাকা? নারী ও পুরুষ পরস্পরকে ভালোবাসবে না, শ্রদ্ধা করবে না সে কথা হচ্ছে না মোটেও, বলা হচ্ছে অসম ক্ষমতা সম্পর্ক ও একচ্ছত্র লৈঙ্গিক আধিপত্যের কথা। নারী কি সমাজ-রাষ্ট্রে 'অপর' হয়ে থাকবে? যার নিজের কোন সত্তা নেই, কর্তৃত্ব নেই এমন একটি প্রান্তিক অবস্থানে থেকে নারী কেবল পুরুষকর্তার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখবে?
ভার্জিনিয়া উলফ নারীর অবস্থানকে মনে করতেন 'আয়না' (mirror)। পুরুষ নারীর ভেতরে নিজেকে দেখতে পেয়ে পূর্ণতা লাভ করে বলে মনে করতেন তিনি। কথাটি যে সর্বাংশে সত্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ একটি পিতৃতান্ত্রিক ও কর্তৃত্বপরায়ন ব্যবস্থায় নারীর ভূমিকা কন্যা, স্ত্রী ও মা। এর বাইরে নারীর নিজের পরিচয় দাঁড়ায় না। এই লিঙ্গজ ভূমিকাগুলো পালন করার মধ্য দিয়ে নারীকে চরিতার্থতা পেতে হয়। এইরকম একটি ব্যবস্থার ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, দৃষ্টিভঙ্গি-মূল্যবোধ সবই পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিফলিত করে। অর্থাৎ,একজন পুরুষ যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন সে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। পুরুষকে তার বিকাশের পথে কিছুই ত্যাগ করতে হয় না, কেবলমাত্র একাগ্রতা ও অধ্যবসায় থাকলেই চলে,অথচ একজন নারীকে বিকশিত হতে গেলে সমাজ নির্ধারিত লিঙ্গজ ভূমিকাকে অস্বীকার করতে হয়, জীবনের কিছু না কিছু ক্ষুণ্ণ করতেই হয়। একজন নারী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাহিত্যিক যাই হোক না কেন তাকে ঘরের কাজ করতেই হয়। ঘরের কাজ না করা বা করতে না পারা তার জন্য 'নারীত্ব'কে খারিজ করার সামিল। কিন্তু একজন কর্মজীবী পুরুষের জন্য তার কর্মস্থলের বাইরে ঘরের কাজ করাকে ঠিক পুরুষালি আচরণ বলে মনে করা হয় না।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও পৃথিবীর শ্রমের সিংহভাগই নারীর অবদান। নারী ঘরে বাধ্যতামূলক যে অনানুষ্ঠানিক শ্রম দেয়,তাকে আনুষ্ঠানিক শ্রম বলে গণ্য করলে অর্থনীতিতে নারী ও পুরুষের অবদানের অনুপাতটা কত হতে পারে সেটি বোধহয় ভাবার সময় হয়েছে। অথচ এতকিছুর পরেও পৃথিবীতে সম্পদে নারীর অধিকার যৎসামান্য।
কর্পোরেট পুঁজিবাদের যুগে নারীমুক্তির প্রশ্ন আরো বেশি জীবন্ত, প্রাসঙ্গিক। নারী এখন কেবল ধর্মীয় মৌলবাদের শিকার নয়। নারী এখন বাজার মৌলবাদেরও ভয়াবহ টার্গেট। নারী নিজেই এখন বিশাল এক বাজার। তার নিজের ঘরবাড়ি, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবার-প্রসাধনী কোনটাই তার নিজস্ব ঐতিহ্য বা রুচিবোধের প্রকাশ নয়। সমস্তটাই ভোগবাদী সমাজে বহুজাগতিক প্রতিষ্ঠানের বাজারনীতি দ্বারা নির্ধারিত। এছাড়াও পণ্যের মডেল হিসেবে নারীর যৌন উপযোগ ব্যবহার করাও বাজার মৌলবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ধর্মীয় মৌলবাদ যেমন নারীকে ধর্মের অনুশাসনের নামে পর্দায় ঢেকে দিতে, ঘরের চার দেয়ালে বন্দী করতে চায়, তেমনি বাজার মৌলবাদ নারীমুক্তির নামে নারীকে স্রেফ ভোগ-বিলাসের পণ্যে পরিণত করতে চায়।
বলা বাহুল্য, এই দুইয়ের উদ্দেশ্যই নারীকে পুরুষের আজ্ঞাবহ ক্রীড়ানক ও মুনাফার মাধ্যমে পরিণত করা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনী 'জাপানযাত্রী'তে বলেছেন,"কেবল বাইরে বেরুতে পারাই যে মুক্তি তা নয়, অবাধে কাজ করতে পাওয়া মানুষের পক্ষে তার চেয়ে বড় মুক্তি"। 'অবাধে' কাজ করতে পারা বলতে রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে নারীর সত্তার স্বাধীন বিকাশের কথা বলেছেন এবং সেটা সম্ভব পুরুষাধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমেই। এই বিদ্রোহে সংবেদনশীল ও বিবেকবান পুরুষ নারীর সহযোদ্ধা হবে। নারী যদি নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সর্বক্ষণ হীনমন্যতায় না ভোগে, সংকীর্ণ হয়ে না থাকে তবেই সে মহীয়সী ও প্রেয়সী দুটোই হতে পারবে। নিজের ভালোমন্দের সিদ্ধান্ত নারী নিজেই নিবে, তাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে জোরপূর্বক ঘরে আটকে রাখা কিংবা পুরুষতান্ত্রিক শঠতা ও প্রলোভনের মাধ্যমে পণ্য হিসেবে উন্মুক্ত করা- এর কোনটাতেই নারীর প্রকৃত মঙ্গল নেই।
তাহলে একুশ শতকে এসেও কেন নারীমুক্তির কথা বলে যেতে হয়? কেন নারীদিবস অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে প্রাসঙ্গিক? প্রবন্ধের শুরুতেই যে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে,এমন আরও অজস্র প্রশ্নের আন্তরিক সমাধান এবং পুরো প্রবন্ধ জুড়ে যে অবস্থা-পরিস্থিতি-ফ্যাক্ট আলোচিত হয়েছে, তেমন আরো বহু বহু শর্ত-পরিস্থিতি যতদিন বলবৎ থাকবে, যতদিন নারী-পুরুষের অসম ক্ষমতা সম্পর্ক বিদ্যমান থাকবে, যতদিন পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি থাকবে, যতদিন নয়া সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদ বহাল থাকবে, ততদিন নারীমুক্তি সার্বিক মুক্তির অংশ বলে বিবেচিত হবে। প্রকৃত কল্যাণকর সংস্কৃতি মানে নারী-পুরুষের সম-অংশদারিত্বের মাধ্যমে গড়ে ওঠা মুক্ত সংস্কৃতি। সে সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারী-পুরুষ উভয়েরই মানবিক বিকাশ আবশ্যক।
লেখক: সাবেক আহ্বায়ক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, শাবিপ্রবি