গৃহপরিচারিকাও কি স্বাধীন নয় তোমার চেয়ে!

প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০১৭, ০৪:৪১

নারী আন্দোলন-নারী মুক্তি-নারী স্বাধীনতা, শব্দ গুলোর অর্থ-ব্যবহার-পরিধি যেন একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি জানি আপনি জানেন, এই লেখা যারা যারা পড়ছেন তারাও জানেন। একটু খেয়াল করে দেখুন তো আমার আপনার বাসায় যে সব নারী শ্রমিক রয়েছে, যাদের আমরা “বুয়া” বলি তারা কি জানে এসব শব্দের মানে? বা ৮ মার্চ বলে একটি নারী দিবস আছে, যে দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে নারীদেরকে তাদের স্বাধীনতা আর অধিকারের স্বাদ দেওয়া; সে খবর তারা রাখে না, তাদের কাছে পৌছায় না। তবু তারাও কিন্তু নিজের অজান্তেই এই লড়াইয়ের অংশীদার। 

আমার বাসার আগের বুয়া এবং বর্তমান বুয়া দুজনই প্রায় একই পরিস্থিতির শিকার। এবং দুজনই নিজের অস্তিত্বের লড়াইটা লড়ে যাচ্ছে। এখন যিনি আছেন তার নাম আঁখি। তার প্রথম স্বামী মারা যাওয়ার পর আরেকটি বিয়ে হয়, এবং স্বামী তার প্রথম ঘরের মেয়েকে কাছে রাখতে দেয় না। এমন অবস্থায় আর্থিক কষাঘাতে জর্জরিত গরীব ঘরের মেয়ে স্বামীর কথাকেই প্রাধান্য দিবে, মেয়েকে ছেড়ে দিবে। কিন্তু তিনি তা না করে, স্বামী ছেড়ে এসে মানুষের বাসায় কাজ করে নিজে খায় মেয়েকেও খাওয়ায়, স্কুলেও পড়ায়। জিজ্ঞেস করলাম তার বাবা মা কেউ আছে কিনা। বাবা নেই, মা ভাইয়ের সাথে থাকে, সেখানে তারা যাবে না। তার আগের শ্বশুর বাড়িতেও তার মেয়ে ভাল থাকবে না, কারণ মেয়ে হওয়ায় সবাই ঝামেলা মনে করে। সেও যে স্বামী ছেড়ে এসেছে তাও কেউ মানতে চায় না। অর্থাৎ নিজের কথায় অটল থেকে এমন করুণ আর্থিক অবস্থা হওয়া সত্ত্বেও সে একাই লড়ে  যাচ্ছে।

এরপর আসি, আগের বাসার বুয়ার গল্পে। স্বামী মারধর করে, সংসারে টাকা দেয় না, মদ, জুয়ায় উড়িয়ে দেয়। মাজেদা বুয়া লুকিয়ে লুকিয়ে নাকি ব্যবস্থা করে শহরে চলে আসেন। বাসাবাড়িতে কাজ করে তিন সন্তানকে লালন করছেন। স্বামী খোঁজ পেয়ে হানা দেয়, বস্তিতে সবার সামনে নাকি মারেও। কিন্তু কেউ তাকে সেখান থেকে নিয়ে যেতে পারেনি। সেই মাজেদা বুয়া মানুষের বাড়িতে কাজ করে করে টাকা জমিয়ে একটা ভ্যান কিনেন, সেখানে রান্না করা খাবার বিক্রি করেন। এবং সেই ব্যবসার প্রসারে তাকে আর মানুষের বাড়িতে কাজ করতে হয় না, দুই ছেলেকে স্কুলে পড়ান, মেয়ের নাকি বিয়েও দিয়েছেন। বস্তি ছেড়ে এখন আরও একটু উন্নত জায়গায় বাসাও নিয়েছেন।
 
এই যে এমন অসহায় দুজন নারী, যাদের চাল ছিল না, চুলাও ছিল না। ছিল না পরিবারের সমর্থন, ছিল না একাডেমিক সার্টিফিকেট, যাদের জন্মই হয়েছিল অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকার জন্য। আজ তারা একমাত্র মনের তাগিদেই এতদূর আসতে পেরেছে। তাগিদ বেঁচে থাকার, তাগিদ অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে না থাকার, তাগিদ নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার, তাগিদ নিজের মত করে বাঁচার।

তারা অন্যের বাসায় এঁটো বাসন পরিষ্কার করে, ময়লা কাপড় ধোয়, মেঝে ঝাড়ু দেয়, কিন্তু কাজ শেষে যখন নিজের টাকায় ভাড়া দেওয়া ছোট বস্তির রুমে ফিরে যায় ভাল করে তাকিয়ে দেখবেন তাদের কপাল বেয়ে নেমে যাওয়া ঘাম শুধু রোদে না অহংকারেও চিকচিক করে। যে মাথাটি অন্যায়ের সামনে মাথা নত করে নি, সে মাথা একটু উঁচু হয়েই থাকবে।

এদের আমরা অবজ্ঞা করি, ছোটলোক বলে গালিও দেই। গৃহকর্ত্রীরা তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়ে আবার তাদের উপর নানা রকম জোর জুলুমও করে। তাদের একটু আয়নায় নিজের দিকে তাকানো উচিত। যাদের কাজের লোক বলে অবজ্ঞা করছেন তারা কিন্তু কারো খায়ও না, পরেও না। সে মাস শেষে যা’ই আয় করে সেটা পুরোটাই নিজের এবং সৎ উপার্জন। যাদের ঘরে তারা কাজ করে সেখানেই হয়ত স্বামী অত্যাচার করছে তার স্ত্রীকে। কিন্তু সেই স্ত্রী এর প্রতিবাদ করছে না, স্বামীর মার খেয়ে কান্নাকাটি করে দিন শেষে তার জন্যই ভাত রান্না করছে। ভাতের হাঁড়িটা যে মেজে দিচ্ছে সে কিন্তু স্বামীর মার সহ্য করে থেকে যায়নি। লোক লজ্জার ভয় উপেক্ষা করে, নিজের দায়ে নিজেই পথ করে নিয়েছে। অথচ ঐ মার খাওয়া গৃহকর্ত্রীর  অবস্থা কিন্তু বুয়াদের মত দৈন্য না। সব দিক থেকে তারা ওই বুয়াদের চেয়ে যোগ্যতা সম্পন্ন। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি, আর্থিকভাবেও কপর্দকশূন্য নয়। তবুও তারা সহ্য করে যায়। কেন? তাদেরও কি তাগিদ নেয়? 

বুয়ারা জানে না নারী মুক্তি-স্বাধীনতা কী জিনিস। আর এরা জেনেও দেখেও বুঝেও কেন চুপ থাকে, কেন বের হয়ে আসে না? আসে না কারণ তারা ভীতু। একা পারবে কিনা, সমাজ কী বলবে, পরিবার কী বলবে এসব চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারে না। তারা কপট সম্মানের জন্য ক্ষুধার্ত। অথচ জানে না সব কিছু তুচ্ছ করে শুধু একবার নিজের অস্তিত্বের সম্মানের জন্য বের হয়ে আসা কত শান্তির, কত সম্মানের, কতটা আত্মতৃপ্তির। পথটা কঠিন, ভীষণ কঠিন কিন্তু যদি আপনার বাসার বুয়াটি নিজেকে মুক্ত করতে পারে তবে আপনি কেন মার খান, অপমান সহ্য করেন? বুয়া আপনার চেয়ে নিচু স্তরের? ভেবে দেখুন তো কে আসলেই নিচু!

আপনার পাশ দিয়েই হয়ত কোনো আন্দোলন ঘটে যাচ্ছে, আপনি দেখছেন, শুনছেন, বুঝছেন যে এসবই নারীদের তাদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার জন্য, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য, তাদেরকে অত্যাচার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। আর আপনি এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দেন। আর আপনার ঘরে কাজ করা বুয়াটি এসবের ধারে কাছেও নেই, কিন্তু সে তার নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নিয়েছে। 

নিজের জন্য বাঁচতে যেদিন শিখবেন সেদিন ঠিকই স্বামীর মার খাওয়া ছেড়ে মুক্তির স্বাদ নিতে আর কোনো ভয় থাকবে না। শুধু এটুকু মনে রাখুন, স্বামীর মার খাওয়ার জন্য আপনি পড়ালেখা করেন নি, সমাজ পরিবার কী ভাববে এই চিন্তা আপনাকে মার খাওয়া থেকে দূরে রাখতে পারছে না। শুধুমাত্র আপনার একটা পদক্ষেপই আপনাকে অত্যাচার থেকে মুক্তি দিবে। প্রতিবাদ করুন, যদি আপনার বুয়াটি পারে আপনি কেন পারবেন না? আর কত দুর্বল হয়ে থাকবেন? না হয় বুয়াটির দিকে তাকিয়ে সাহস এবং শিক্ষা নিন। 

নিজের জন্য বাঁচো, নিজেকে বাঁচাও।

লেখক: ব্লগার