বি বোল্ড ফর চেঞ্জ: আমাদের জন্য?
প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০১৭, ১৩:৩৪
'নারীবাদ' কিভাবে কিভাবে যেন গালিতে পরিণত হয়েছে। অবশ্য 'কিভাবে কিভাবে যেন' বলাটা ঠিক হলো না। আমি আসলে জানি, কিভাবে এটা গালি হয়ে উঠেছে। অথবা ট্রল। আপনি যখন যুক্তিতে পারবেন না, বুদ্ধিতে পারবেন না, তীক্ষ্ম বর্শার মতো আপনার যন্ত্রণাবিদ্ধ বেদনা যখন চিৎকৃত হবে তখন আপনাকে ট্রলেরও শিকার হতে হবে। কথাবার্তা অনলাইন কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে তো? স্যরি এইসবের বাইরেও আমার জীবন আছে। আমি মানুষ পড়ি, অন্তত: চেষ্টা করি।
মাত্র দু'একটা বছরের মধ্যে কিরকম চেনা মুখগুলো অচেনা হয়ে গেল। কবিতা লেখা, মুক্তমন ফলানো, ব্লগারদের পক্ষে লেখা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ইত্যাদি ইত্যাদি কাঙ্খিত সব প্রগতিশীলরাও নারী প্রসঙ্গে বদলে যান।
"শোনেন আসল নারীবাদ করছেন মুন্নী সাহা। নারী না পুরুষ তা নিয়ে ভাবেন না, ভূতের মতো কাজ করেন সারাক্ষণ। এইটাই আসল নারীবাদ। আপনারা বিভিন্ন পোর্টালে যা লেখেন তা আসলে অহেতুক খোঁচাখুঁচি।"
আশিকুর রহমান অপু নামে আমার এক সাবেক কলিগ বলছিলেন।
আর সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, সাংবাদিক, বড় ভাই বইমেলায় দেখা হলে বললেন, "আমি আর কোন কিছু নিয়ে লিখলেই এতো গালি খাই না যত গালি খাই নারী বিষয়ে লিখলে, নারীবাদ নিয়ে লিখলে। ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা কোনকিছু নিয়েই এতো জ্বালাপোড়া নেই, যত জ্বালাপোড়া হয় নারী নিয়ে লিখলে"।
গতবছর নারী দিবসে মুন্নী দি' (মুন্নী সাহা) আইডিয়া দিয়েছিলেন। "যে মেয়েটা পাহাড়ে উঠছে, প্লেন চালাচ্ছে, প্রশাসনের বড় পদে গেছে এইসব তো আসেই টিভিতে, পত্রিকায়। যে মেয়েটা প্রেগনেন্ট, বড় পেট নিয়ে প্রতিদিন ওঠে গণপরিহনে, যে মেয়েটা প্রতিদিন ১৪ ঘন্টা কাজ করে এসে আবার স্বামীর জন্য ভাত রাঁধে, চালায় পুরো সংসার সেই মেয়েদের কথা এবার লেখ" এই কথাগুলো আমাকে বলেছিলেন মুন্নী সাহাই। লিখেছিলাম আমি। খুব ভালো লেগেছিল আমার মুন্নীদির এই কনসেপ্ট। ক্ষমতায়ন আর স্বাধীনতা কাজের মধ্যে থাকে, থিসিস এর পাতায় নয়।
কিন্তু হয় কি এই যে এইটা নারীবাদ আর ওইটা নয়, ওইটা সঠিক নারীবাদ এইটা অশুদ্ধ - এইসব আমাদের কেন আর কারা শেখায়? পুরুষেরাই তো। না শুধু পুরুষ কেন? নারীরাও কি নন?
"আজকাল নারীবাদ নিয়ে লেখালেখি অনেকটা চটি লেখা হয়ে গেছে" - এই বাক্য আমি অন্তত: তিনজন সহযোদ্ধা নারীর ফেসবুক ওয়ালে পেয়েছি। কেউ মুখোমুখি বলেননি। কিন্তু বলেছেন। আমি তাদের ভাষা বুঝতে পেরেছি। মেয়েদের 'মুখ ছোটানো' 'হ্যাডম দেখানো' 'ছেলেদের মতো অকারণে অশ্নীল কথা বলা' তাদের মানতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। তারা লড়াই করতে চান সুশীলভাবে, একেবারে সহীহ শুদ্ধভাবে। কিন্তু এই ছদ্মলড়াকুরা ইতরদের জবাব দেবার ভাষাটা বলে দেন না। রাস্তায় হাঁটতে গেলে পুরুষ যখন জিহ্বার টাকরায় শব্দ তুলবে, চোখ দিয়ে চাটবে আপনাকে অথবা বলবে 'কতবড় দুধ রে' বাসে-ট্রেনে গণপরিবহনে, ভিড়ে-ভাট্টায় আপনি যে শ্রেণীর নারীই হোন না কেন, হিজাব পড়েন আর বোরকা - আপনার শরীরে ঘষবে পুরুষাঙ্গ, হাত দেবে স্তনে বা নিতম্বে - এইটা আপনি ছাপার অক্ষরে লিখলে আপনাকে বলা হবে চটি লিখছেন।
নারী বিষয়ক যেকোন লেখা, যেকোন ভাবনাই অশ্নীল লাগে অনেকের কাছে। পিরিয়ড অশ্নীল, ব্রার ফিতা অশ্নীল, জরায়ু অশ্নীল, সন্তান জন্মদান অশ্নীল, যৌনতা অশ্নীল - এককথায় নারীর শরীরই অশ্নীল। কারণ নারী মানুষ নয় সেক্স অবজেক্ট। এই কথাগুলো বললে, লিখলে - বলা হবে, "আসছেন আরেক তসলিমা নাসরিন!" পুরুষের মতো এসব শুনে অনেক নারীও মুখে কাপড় দিয়ে লজ্জা ঢাকেন। যারা এসব কথা বলেন, ট্যাবু ভাঙতে চান নব্বই এর দশকে তসলিমাকে যে চোখে দেখা হতো, প্রায় দুই দশক পেরিয়ে এসে তাদেরকে সেই একই চোখে দেখা হবে। যত যা কিছুই হোক বৈপ্লবিক কথাবার্তা আর আচরণ বা জীবনযাপন এখানে সহ্য করা হয় না। আপনি নারীবাদ যদি জীবনে চর্চা করেন অথবা মানবতাবাদ - আপনাকে অবিরাম ক্রিটিসাইজ করা হবে। সমাজ সইয়ে সইয়ে, মিষ্টি করে বলে বলে আপনাকে সমাজ পাল্টানোর সবক দেওয়া হবে। ইউরোপের মেয়েদের মতো ঋতুস্রাবের রক্ত পাবলিকলি ছিটিয়ে আপনি বলতে পারবেন না, সি, দিজ ইজ মাই ব্লাড, দিজ ইজ নট আনহোলি। (অশ্নীলতার দোষে দুষ্ট হবেন)। আপনি বলতে পারবেন না, আমার শরীর আমি বুঝবো, সেক্স করবো কি করবো না বা কার সাথে করবো বা করবো না ('পরকীয়া'কে উৎসাহিত করছেন বলা হবে)। বলতে পারবেন না, আমার শরীর বাচ্চা উৎপাদনের যন্ত্র নয় (মানবসৃষ্টি প্রক্রিয়াকে ব্যহত করছেন বলা হবে)। আর এইসব বিষমাখা তীর কারা ছুঁড়বে আপনার দিকে? শুধুই নারী? মোটেই না, পুরুষতন্ত্রের তৈরি নারী চেহারার পুরুষেরাও।
আর এরই মধ্যে নারীর তথাকথিত ক্ষমতায়ন হয়েছে। আসেন তৃণমূলে। তৃণমূলের নারীরা নাকি ক্ষমতায়নের শীর্ষে উঠছে। এই সরকার এই কথা শতমুখে প্রচার করে। সেদিন কথা হচ্ছিল, দেবাহুতি চক্রবর্তীর সঙ্গে। রাজবাড়ী নামে একটা ছোট্ট জেলা শহরের একজন উইম্যান অ্যাকটিভিস্ট। বললেন, তৃণমূলে নারীরা নতুন মোড়কে পণ্য হচ্ছে। পুরুষেরা রাজনৈতিক হয়রানিতে অনেক সময় পদে আসতে পারে না, গুটির চালের মতো তারা বোরখা আর হিজাবে আবৃত স্ত্রী বা বোনকে পাঠিয়ে দেয় রাজনীতিতে। এখানে ওই নারীটির তেমন কিছু করার থাকে না, অলংকার হওয়া ছাড়া। আর যেসব নারীরা প্রকৃতপক্ষেই ইউনিয়ন পর্যায় বা গ্রাম পর্যায়ে রাজনীতি বা লোক প্রসাশনের পদে আসেন তাদেরকে এমন সব প্রতিবন্ধকতা পার করতে হয় যে বেশিদিন তারা টিকবে কি না সন্দেহ। দেবাহুতি চক্রবর্তী বাজে কথা বলেন না। তার ফাইন্ডিংস-এ আমার যথেষ্ট ভরসা।
আর এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এবারের নারী দিবসের স্লোগান হলো, বি বোল্ড ফর চেঞ্জ। বাংলাদেশের জমিনে এই অক্ষরগুলো পাতলে আমার খুব হাস্যকর লাগে। যেখানে জীবনযাপনের প্রতিদিনের প্রতিবন্ধকতার কথা বললে, বলা হবে, এইসব অহেতুক খোঁচাখুঁচি। অশ্নীলতার প্রতিবাদ করলে বলা হবে, চটি লিখছেন। নারী বিষয়ে কিছু লিখলে পুরুষ হয়েও আপনাকে গালাগালি খেতে হবে। এখন এইসব সূর্যের আলোয় চকচক করে ওঠা খঞ্জরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নারী এবং পুরুষ-যারাই চান সমতা, সাহসী তো হতেই হবে। হাঁটতে গিয়ে পশ্চাৎপদদের আক্রমনের শিকার হবেন, নানান কায়দায় ছদ্ম প্রগতিশীলরা আপনারা ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলবে - তবু উদ্ধত রক্তাক্ত রডোডেনড্রন এর মতো আমাকে - আপনাকে মাথা তুলতেই হবে।
লেখক: সাংবাদিক