আমার দুঃখিনী বর্ণমালা
প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৪:৪৭ | আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০১:১৬
এক বিদেশী মিশনের ভিনদেশী, ভিন্নভাষী প্রেস এটাশ্যেঁর প্রেমে আমি প্রায় পড়েই গিয়েছিলাম। সে ছোকরা কতটা কি পড়েছিল আমার মনে নেই, আমি কিন্তু বেশ খানিকটা…। পরে নিজেকে টেনে ধরেছি, কেন জানেন? 'অভিমান' শব্দের ইংরেজি জানি না বলে। অভিমানের ইংরেজি কি? আমি অন্ততঃ জানি না। 'অভিমান' ছাড়া বাঙালির প্রেম জমে বলেন? আচ্ছা অভিমান ছেড়েই দিলাম, অভিসারের ইংরেজি কি? বলবেন, ডেটিং? ছিঃ! মোটেই না। অথবা অভিলাষ? অনুযোগ? হয় না। এসব শব্দ একান্তই বাঙালির, বাংলার।
বাংলা এমনই এক ভাষা। এমনই ঋদ্ধ, পূর্ণ। আচ্ছা হাজার বছর আগেও কি এমনই পূর্ণ আর ভর-ভরন্ত ছিল বাংলা ভাষা? নাকি এই ভাষাটিকে আপন করে ধীরে ধীরে উপরে তুলেছে এরই ভাষাভাষীরা? ভাষা খুব প্রবাহমান। বদলে যাওয়াই তার রীতি। আগে প্রায়ই ডিজুস ভাষা নিয়ে ক্ষুব্ধ আর শংকিত হতাম। কিসব শব্দ! কান টান লাল হয়ে যেতো।
ল জাইগা
আবার জিগায়
আবার জিগস
আজীব
পুরাই পাখনা
মাথা আউলা
এই শব্দবন্ধ বা বাক্যগুলি ঠিক আঞ্চলিকও নয়, একটা বিশেষ বয়সের ছেলে-মেয়েরা নিজেদের চৌকষতা প্রমাণ করতে কখনো বা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতো এগুলো। এখনও করে। ভাষার প্রতি মমতা বা দায়িত্ববোধ তাদের কতটা কি আছে তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে। কিন্তু শুধু টিনএজারদের ভাষার প্রতি দায়িত্বের প্রমাণ নেয়ার আমি বা আমরা কে? তার আগের এবং তার আগের এবং তার আগের প্রজন্ম কি করেছে?
কত ভাষা হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। মৃত্যুবরণ করেছে কত কত শব্দ। খুব উন্নত নাক উঁচু করা গ্রীকভাষা অথবা ল্যাটিন ভাষা বা মন্ত্র পড়ার সংস্কৃত ভাষায় এখন আর কথা বলে কেউ? বোধগম্যতার অভাবের পাপ তাদের শরীরে। কম্যুনিকেটিভ না হলে সে ভাষা বুঝি টেকে না।
বাংলা ভাষা কিন্তু টিকেছে। খুব উন্নত ভাষা এইজন্য টিকেছে? আমার তা মনে হয় না। ভাষাটা উন্নত, ঋদ্ধ তার চেয়েও বড় কথা টিকেছে কারণ জাতীয়তাবোধ। টিকেছে কারণ বাংলাভাষীরা এই ভাষাটাকে টেকাতে চেয়েছে। রূপান্তর হয়েছে, আরও হবে, কিন্তু টিকবে। এই ভাষার শক্তিকে মানতে পারেনি পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা। বুলেট দিয়ে থামাতে চেয়েছিল কণ্ঠের গান। পেরেছে কি?
প্রতিবছর বইমেলা এলে ভাবি, এই যে এত এত বই প্রকাশ হচ্ছে, কটা পৌঁছাচ্ছে বিশ্বদরবারে? এতো এতো কথা লেখা হচ্ছে, এতো এতো চিন্তা করা হচ্ছে সেগুলো কি অন্যভাষাভাষীর কাছে পৌছে দিতে কোনরকম উদ্যোগ কেউ নিচ্ছে? নাকি ফিবছর বাংলা একাডেমীর বটতলায় বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেই খুশি থাকছি আমরা? কেন খুশি থাকছি? সাহিত্যে, শিল্পে আমাদের কি এখনও সে সামর্থ্য হয়নি যাতে আমরা তুলে ধরতে পারি নিজেদের, বুকটা সটান রেখে? যদি হয়, তো কেন আমাদের ভাষার সাহিত্য নিয়ে আমরা যাচ্ছি না বিশ্বদরবারে? কেন সেগুলো সঠিক অনুবাদ করার উদ্যোগ এই প্রায় বড়লোক দেশটার কর্ণধারেরা নিচ্ছেন না? না কি এইসব লেস ইমপরটেন্ট ব্যাপার? গুরুত্ব কিসে দেওয়া উচিত আর কিসে কম তা ঠিক না করতে পারার ফলভার বইতে হবে অনেকদিন, আমাদেরকে। একটা অদ্ভুত গভীরতাহীন লোকদেখানো প্রজন্ম যেমন গড়ে উঠেছে, তেমনি কেউ বলতে পারবেন যে এক হুমায়ূন আজাদ ছাড়া এই ভাষাটিকে নিয়েই খুব সিরিয়াসলি কেউ ভেবেছে? গত কয়েক দশকে?
আমার জানা নেই। কারো জানা থাকলে জানিয়ে দেবেন। ভাষার জন্য মমতা কিভাবে তৈরি হয়? ঐ সেই দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবোধ। একটা ছোট্ট দেশ, একটাই ভাষা, তাও যে ভাষাটার জন্য রক্ত দিতে হয়েছিল, সবকিছুর পরও সে ভাষাটা নিয়ে যদি আমরা গর্ব করতে না পারি, ভাষাটার জন্য কিছু করতে না পারি, ভাষাটা নিয়ে বুকটান করে দাঁড়াতে না পারি, তাহলে ভাই, সমস্যাটা আমাদের দেশপ্রেমেই, আর কি বলবো!
হুমায়ূন আজাদের এই লেখাটা আমার ভাষা বুঝতে পেরেছে। তুলে দিচ্ছি।
বাঙলা ভাষা: তোমার মুখের দিকে আমি সবসময়ই তাকিয়ে আছি।
যখন জেগে থাকি তখন তোমার দিকে স্থির করে রাখি চোখ। স্থির করে রাখি অস্ত্বিত্ব।
তুমি আর আমি একই গোত্রের। শ্যামলী রূপসী।
শাইশাই চাবুকের শব্দ শুনি। চাবুকের শাইশাই শব্দে গান হয়ে বেজে উঠছে এক হাজার একশো বছর।
শুধু চাবুকের শব্দ শুনি।
শেকলে বাধা উদ্ধত দুর্বিনীত প্রাকৃত মানব। ঝনঝন করে ওঠে অজগরের মতো স্তরে স্তরে শেকল আর শেকল আর শেকল।
শুধু শেকলের শব্দ শুনি।
তুমি আর আমি সে গোত্রের যারা চিরদিন উৎপীড়নের মধ্যে গান গায়।
হাহাকার রূপান্তরিত হয় সঙ্গীতে শোভায়।
আমি চারদিকে শোভা দেখি।
সঙ্গীতে শিহরিত দেখি লোকালয় বন আর প্রান্তর।
তোমার অশ্রুবিন্দু পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুক্তোর চেয়েও সুন্দর। তোমার পিঠের চাবুকের দাগ সবচেয়ে উজ্জ্বল জড়োয়ার চেয়েও উজ্জ্বল।
তুমি তাকালেই সৌন্দর্য্য ঠিকরে পড়ে সূর্যাস্তে, চন্দ্রোদয়ে। শিশিরে, সমুদ্রে, বুনোঘাসে, কবিতার পংক্তিতে।
তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চণ্ডীদাস
শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন
তোমার থরোথরো ভালোবাসার নাম রবীন্দ্রনাথ
বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম
তোমার রূপের আমি সীমা পাই না।
একসময় দেখি তুমি আর আমার অস্তিত্ব এক হয়ে গেছে।
সুখে দু:খে উদ্ধত বিদ্রোহে পরাজয়ে আর বিজয়ে অভিন্ন আমরা।
হাজার বছর ধরে। হাজার বছর পরে।
সত্যি বাংলাভাষা, আমার দুঃখিনী এই বর্ণমালার সাথে বড় একাত্ম বোধ করি।
লেখক: সাংবাদিক