যুদ্ধের আবহাওয়া প্রসঙ্গে
প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০২:০৬
চারিদিকে এখন যুদ্ধের আবহাওয়া আমার দেশে। এই বিচিত্র দেশে ভোট দিয়ে নতুন সরকার চয়নপ্রক্রিয়াটা যেমন একপ্রকার যুদ্ধ ঠিক ততটাই যুদ্ধের সমান এখন কথা বলাও। এত বছর ধরে আমাদের বোঝানো হয়েছে আমরা নাকি আসলেই স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। কে জানে!
আমি এবং আমার সমসাময়িক যারা, আমরা সবাই আমাদের বাবা-কাকাদের প্রজন্মের তুলনায় একটু হয়ত বেশিই স্বাধীন। প্রাপ্তবয়স্কতা অর্জনের বছর থেকেই আমি পেরেছি নিজের ভোট নিজে দিতে, যেটা আমার বাবার পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। আমার বেড়ে ওঠার মধ্যে পাওয়া অবাধ স্বাধীনতার জন্যে প্রাণ দেওয়া কোন ছাড়, এক কণাও সংগ্রাম করতে হয়নি আমাকে। করতে হয়নি ভাষার জন্যে সংগ্রাম। মুখের সামনে পাওয়া গ্রাসটুকুর জন্যেও আমি লড়িনি কখনো। আমার হয়ে লড়াইটা করে নিয়েছিলেন অন্য অনেকে। মাঝে মাঝে ভাবি, এই দেশে যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেছি তাতেই আমাদের ভাগের নূন্যতম স্বাধীনতাটুকু আমাদের পাওয়া হয়ে গেছে আপনা থেকেই। ভেবে দেখলাম, গুরুদায়িত্ব বলতে শুধু একটাই কাজ আমাদের ওপর বর্তায়। তা হল আমাদের পূর্বসূরীদের সংগ্রামের বহমানতাকে পরবর্তীর জন্যে ধারণ করা, সময়োপযোগী করে তোলা ও এগিয়ে নিয়ে চলা।
১৯শে মে বা ২১শে ফেব্রুয়ারী নিয়ে আমায় কিছু লিখতে বা ভাবতে বলা হলে বারবার নিজের কাছেই প্রশ্ন করি- সত্যিই কতটা পেরেছি এপারের কমলা-সুনীল-বাচ্চু-জগন্ময়-সুদেষ্ণা বা ওপারের রফিক-সালাম-বরকতদের প্রাণদানকে সম্মান করতে? তাদের অর্জিত অধিকারের রক্ষার কথায় নাই বা গেলাম। নিজের মাতৃভাষাকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু কি আদৌ দিতে পেরেছি আমি বা আমরা আজও?
গর্ব করেই বলি, জন্ম থেকে কৈশোরের মাঝামাঝি অবধি আমি কাটিয়েছি ভাষা শহীদের শহর, আসামের শিলচরে। তখন নিয়মমাফিক, ক্যালেন্ডার মিলিয়েই ইস্কুলের ছুটির দিন হিসেবে পালন করেছি ১৯শে মে। কখনো হয়ত বাবা-কাকা-জ্যাঠাদের সাথে দলে ভিড়ে গণনাট্যের সাথে যোগ দিয়েছি কোন না কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও। এছাড়া শুধুমাত্র লজ্জা এড়াবার জন্যেই জেনেছি এগারোজন, বা পরবর্তীতে পনেরোজন ভাষা শহীদের নাম। চোখ বুলিয়ে মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছি ১৯৬১’র ভাষা আন্দোলনের আবছা ইতিহাস। ব্যস ওইটুকুই। তারপর একটা সময় কলকাতায় চলে আসতে হল। এবং আশ্চর্যভাবে সম্মুখীন হলাম এক “কালচারাল শক”-এর। আগে যখন শিলচরে থাকতাম, দেখতাম বন্ধুদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলাটাই ছিল কেতাদুরস্ত। ইস্কুলের অনুষ্ঠানে বাংলায় গান গাইতে আমায় বলা হলে লজ্জাই বোধ করতাম, বন্ধুরা হাসাহাসিও করত কম না। কলকাতায় এসে দেখি হিন্দির সেই ফ্যাশনের জায়গা কেড়ে নিয়েছে ইংরেজি। সাধারণ স্কুলে পড়া আমি কলকাতার নামজাদা কনভেন্টে প্রতিদিন মুখ খোলার আগে বারবার ভেবে নিতাম, ব্যাকরণটা ঠিক হচ্ছে তো? কেউ হাসবে না তো? কলমকে পেন না বলে কলম বলায় ক্লাসের বন্ধুরা আমায় নিয়ে হেসেই পার পায় না। আমিও সেই থেকে হয় রইলাম একেবারেই ঠুঁটো জগন্নাথ। তবে ওটা শুধুমাত্রই প্রথম কয়েক মাসের গল্প। ইস্কুল পেরিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ঢুকলাম। ততদিনে আমি একশো শতাংশ পটু হয়ে গেছি বাংলায় ইংরেজি, বা ইংরেজিতে বাংলা বলতে। উদাহরণস্বরূপঃ “এই do you have any খাবার with you? Why can’t you sit হাঁটু মুড়ে?” এই গোছের বাক্যে কথোপকথন চালাতে আমি ততদিনে একেবারেই ওস্তাদ!
টনক নড়ল হঠাৎই একদিন ক্লাসে একটি ছাত্র সংগঠনের প্রচার শুনে। কী অসাধারণ দক্ষতায় সেদিন অম্লানদা একনাগাড়ে ৪৫ মিনিট বাংলায় ক্যাম্পেন করে গেছিল একবারের জন্যেও ইংরেজি কোন শব্দ ব্যবহার না করে! সাংগঠনিক বক্তব্য তখন মাথায়, আমি তো মন্ত্রমুগ্ধ তার ভাষা শুনেই! মনে মনে ভাবলাম কলকাতায় তাহলে অন্য রকমও হয়।
সেই থেকেই একটু একটু করে নিজেকে পাল্টাতে চেষ্টা করেছি। বাংলায় বাংলা বলা, আর ইংরেজিতেই ইংরেজি বলার যথাসাধ্য চেষ্টা করি। ভেবে বের করার চেষ্টা অনেক করেছি যে সমস্যার উৎস কোথায়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কখনোই সমান প্রাধান্য পায়না ইংরেজি ও অন্যান্য দেশী ভাষা। সব সময়েই অভিভাবক-সহ সবাই জোর দেন উন্নতমানের ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে। সেখানে কোন ভুল নেই, দোষ নেই। অবশ্যই ইংরেজি শিখব, আন্তর্জাতিক মানের ইংরেজি আমাদের শিখতেই হবে। নাহলে বাকি দুনিয়ার সাথে পাল্লা দেবার দৌড়ে খুঁজেই পাবে না আমাদের ইতিহাস। আমরা হারিয়ে যাব ক্রমশ। কিন্ত তা বলে কি বাংলা, হিন্দি, উর্দু, মণিপুরী, তামিল এদেরকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায়? মরে গেলেও না। যে ভাষাই শিখব, ভালোবেসে শিখব। বাধ্যবাধকতার গন্ডীর জন্যে নয়, মাতৃভাষাসহ অন্যান্য সব ভাষাই গ্রহণ করব সেই ভাষার গায়ে লেগে থাকা সংগ্রামী রক্তের কথা স্মরণ করে।
২০১৬ সালে দাঁড়িয়ে যে কোন ভাষাকে সম্মান দেওয়াটাও তাই একইভাবে এক একটা যুদ্ধের সমান। ১৯৫২-৬১তেও যুদ্ধ ছিল এটাই। কিন্ত তখন বিপরীতে ছিল রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার চেলা-চামুণ্ডারা। আজও অনেকটাই তাই। কিন্ত এখনের সময়ে যুদ্ধক্ষেত্র আরো অনেকটাই বিস্তৃত। এখনের যুদ্ধের মোক্ষম জায়গা আসলে আমরা এক একজন প্রত্যেকে। আমাদের ভেতরটাতেই যুদ্ধ লেগে গেছে। অন্য কারও সাথে নয়, ভাষাকে বাঁচাবার লড়াইতে নিজের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ আমরাই। নিজের সাথে একান্তে আলাপচারিতাও এসবের বাইরে নয়। সেখানে মুখ থেকে, কলম থেকে বেরোনো প্রতিটি শব্দ এক একটা তীর, আমাদের অস্ত্র। শব্দচয়ন এখানে আমাদের একমাত্র রণকৌশল।
অপেক্ষায় আছি, কবে নতুন করে বায়ান্ন-একষট্টির আন্দোলিত ধ্বনি নাড়া দিয়ে যাবে এ প্রজন্মকে নতুন করে। কমলা-রফিক ডাক পাঠাচ্ছে বারবার। যুদ্ধক্ষেত্র আবারও প্রস্তুত। অপেক্ষা শুধুই যোদ্ধার!
লেখক: ব্লগার, সঙ্গীতশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী