বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফটোসেশন! দেখার কেউ নেই?
প্রকাশ | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২১:৪৯ | আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২২:০১
"আমি যদি ভুল না করি ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে রায়েরবাজার বধ্যভূমি"-এমনটা লিখেই আমার এক বন্ধু ফেসবুকের ইনবক্সে একটা লিংক দিল। লিংক ওপেন করে দেখলাম আমাদের দেশের একজন পরিচিত মডেলের ফেসবুক পেজের লিংক, যাকে ছবিতে দেখা যাচ্ছে। ছবিগুলো তোলা হয়েছে আমাদের দেশের স্বনামধন্য ফ্যাশন হাউজ 'অঞ্জনস'- এর বিজ্ঞাপন মডেলের জন্য। যদিও আমাদের দেশে এ ধরনের ছবি দেখে আঁতকে ওঠার কিছু নেই। এসব দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত, চোখ-সওয়া ব্যাপার এসব। শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধের মত স্পর্শকাতর জায়গায় আমরা অনেক অপ্রত্যাশিত চিত্রই দেখতে পাই। কিন্তু তারপরও রায়ের বাজার বধ্যভূমিকে ব্যকগ্রাউন্ডে রেখে একটা ফ্যাশন হাউজের এমন চাকচিক্যপূর্ণ মডেলিং ফটোগ্রাফি দেখে একটু আঁতকে না উঠে পারলাম না। হ্যাঁ, আঁতকে উঠতাম না যদি ফটোগ্রাফির থিমটা ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতো, যদি শোকাবহ বা শ্রদ্ধার্ঘমূলক কোন সাবজেক্টে ফটোগ্রাফিটা করা হত। নাটক, সিনেমা, ফটোগ্রাফির জন্য যৌক্তিক প্রাসঙ্গিক দৃশ্যগুলো এই জায়গাগুলোতে ধারণ করা যেতেই পারে। কিন্তু শুধুই বিজ্ঞাপনের মডেলিং এর জন্য এই শোকের জায়গাকে বেছে নেয়া কতটা বিবেকহীনতার পরিচয় তা আপনারাও বুঝতে পারছেন বলে আশা করছি।
কেউ হয়তো বলবেন, এটা খুব স্বাভাবিক বিষয়। সাধারণ মানুষেরা এখানে অহরহ জমকালো সাজে বিভিন্ন পোজে ছবি তোলে। হ্যাঁ তা করে আমিও জানি। কিন্তু সাধারণ মানুষদের বুদ্ধি বিবেচনায় অনেক কিছুই ধরে না। সাধারণ মানুষদের কর্মকান্ড আর একটা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এবং যে ব্যক্তি একটা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করে -এ দুয়ের তফাৎটুকু বুঝতে হবে। এই ফ্যাশন হাউজ নিশ্চয়ই এ ফটোশুট করেছে বড় বিলবোর্ড টাঙিয়ে অথবা ক্যাটালগ বানিয়ে তাদের বিজ্ঞাপনের জন্য। তাই তাদের সাধারণ মানুষদের মত কাজ করলে তো চলবে না। তাদের একটু বস্তুনিষ্ঠ চিন্তা করতেই হবে।
রায়েরবাজার বধ্যভূমি নামটা দেখলে বা মনে পড়লে আমার চোখে একটা চিত্রই ভেসে ওঠে, যে চিত্রে শরীরে ঝিম ধরে যায়- একগাদা ক্ষতবিক্ষত পঁচে যাওয়া, গলে যাওয়া লাশের স্তূপ। সেই চিত্রের সামনে এমন ফটোশুট দেখে আমি আঘাতপ্রাপ্ত না হয়ে পারিনি। আমার বন্ধুও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েই আমাকে লিংকটা দিয়েছিল। আমাকে অনুরোধ করল যেন এ বিষয়ে কিছু লিখি। তাই লিখতে বসলাম বন্ধুর অনুরোধে এবং নিজের বিবেকের তাড়নায়।
রায়েরবাজার বধ্যভূমির ইতিহাস আমরা মোটামুটি সবাই জানি। স্বাধীনতা লাভের মাত্র দুদিন আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের সহযোগীদের সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। ঢাকার রায়েরবাজারেই এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল। তাই এই স্থানটিতেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং শোকের নিদর্শনস্বরূপ শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয় ১৯৯৯ সালে।
যে স্মৃতির প্রাঙ্গনে গেলেই আমাদের হৃদয় শোকে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠার কথা, এক গভীর দেশপ্রেমের উপলব্ধিতে সারা শরীর শিউরে ওঠার কথা, সেখানে বিবেকহীনতার কোন পর্যায়ে আমরা এ ধরণের ফটোশুট করতে পারি! আমাদের এই সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে ফটোশুট করার মত জায়গার কি অভাব পড়েছে! এই শোকের নিদর্শনকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ফ্যাশন হাউজের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তারা আসলে কি বুঝাতে চায়?
দেখ, আমরা এত শোক কাটিয়ে উঠেও এত সুন্দর সাজুগুজু করে পণ্যের প্রসার ঘটিয়ে ব্যবসার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এমন কিছু?
এছাড়া তো আর কোন কারণ আমি দেখি না! আমার কথা হচ্ছে একজন ফটোগ্রাফার; যে চিত্রের মাধ্যমে নিজের সৃষ্টিশীল প্রতিভার প্রকাশ ঘটায় তার মধ্যে ন্যুনতম একটা বোধ তো থাকবে, যে বোধের কারণে সে এমন কিছু করতে পারে না যা দেখে যেকোন বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষ তাকে বিবেকহীন ভাবতে বাধ্য হয়! আর এই মডেল, এই ফ্যাশন হাউজ, এই ফ্যাশন হাউজের সাথে জড়িত সকল ব্যক্তি যারা এই ছবির প্রচার ঘটায় এবং যারা এ ছবিগুলো দেখে তাদের কারোরই কি এই বোধটুকু জন্মায় না যে, অন্তত এখানে মডেলিং ফটোশুট করাটা বেমানান, বর্বর, দৃষ্টিকটু?
নিশ্চয়ই এই বোধোদয় তাদের হয় না। যদি হতো তাহলে কেউ না কেউ বাধা দিতো। তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে? আমাদের দেশে স্বনামধন্য একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে একদল স্টুপিডদের সমন্বয়ে? এ প্রশ্নের উত্তর আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
আর এ স্মৃতিসৌধের সার্বিক তত্ত্বাবধান, রক্ষণাবেক্ষণ কে করছে? নিশ্চয়ই সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় তা করা হচ্ছে। তাহলে এর সম্মান, ইতিহাস, চেতনা সমুন্নত রাখতে তারা কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে? আর যে অব্যবস্থাপনাই থাকুক (যদিও কোন অব্যবস্থাপনাই থাকা উচিত নয়), অন্তত এ ধরণের স্পর্শকাতর জায়গায় এমন চেতনা বিকৃত কাজ করা যাবে না এটুকু আইন-কানুন নিশ্চয়ই থাকা উচিত ছিল। কারণ মানবিক চেতনাই এমন স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রয়াস যোগায়। আর যদি আইন-কানুন থেকেও থাকে তাহলে এ কাজগুলো হয় কি করে? এটুকু আদর্শিক মূল্যবোধ যদি না থাকে তাহলে এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণের অর্থ কি? শুধু শোকদিবসগুলোতে এক তোড়া ফুল দিয়ে লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা? নাহ, তা তো হওয়ার কথা নয়! এ নিদর্শন স্বচক্ষে বা চিত্রে দেখে, এর ইতিহাস জেনে আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যেও যেন দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ হয়, দেশের ইতিহাস যেন তারা ভুলে না যায় এটা একটা বড় উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই। কিন্তু বর্তমান এই ফেসবুক, ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল জগতে যেখানে একটা ছবি মুহুর্তেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে সেখানে এ ধরণের ছবি দেখে নতুন প্রজন্মের মনে কী চেতনার উদয় হবে! কী শ্রদ্ধা, ভালবাসা, শোক জেগে উঠবে তা আপনাদেরই বিবেচনায় ছেড়ে দিলাম।
আমাদের কষ্ট হোক বা না হোক এই বধ্যভূমিতে যাদের স্বজনরা ইতিহাসের ঘৃনিত পৈশাচিক নির্যাতনের দ্বারা এখানে পঁচে মরেছে, সেই শোকসৌধকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে এ ধরনের হাস্যোজ্জ্বল ফটোগ্রাফি দেখে কি তাদের অন্তরটা মোচড় দিয়ে উঠবে না? আপনার পরিবারের কারো সমাধিস্থলে আপনি কি এমন চিত্র দেখে ব্যথাতুর না হয়ে পারবেন? নিশ্চয়ই পারবেন না। আমরা এই শহীদ স্বজনদের শোকের উপর শোক দেয়ার জন্যই কি এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছি! আর এই বুদ্ধিজীবী শহীদরা কি শুধু তাদের পরিবারেরই স্বজন? এখনও কি তাঁরা আমাদের স্বজন হয়ে উঠতে পারেননি?
আর কিছু বলার নেই।
এ ধরনের বিবেকবর্জিত কাজগুলো যেন এই মাথা নোয়ানোর জায়গাগুলোতে না হয় তার সার্বিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করছি। আর আমাদের দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মডেল, ফটোগ্রাফার সবাই যেন ব্যক্তিস্বার্থে শুধু দেশের উপযোগটুকু ভোগ না করে দেশের প্রতি, দেশের ইতিহাসের প্রতি, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি একটু মমত্ববোধ, একটু শ্রদ্ধা দেখানোর চেতনা ভিতরে ধারণ করে সবিনয়ে এই অনুরোধ জানিয়ে যাচ্ছি।
আর এরপরও যদি তাদের সেই বোধোদয় না হয় তাহলে আমাদের দেশের যারা দেশপ্রেমিক মানুষ আছেন তাদের প্রতি এ ধরনের প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
লেখক: সাংবাদিক ও তরুণ লেখক