আদারবক্স পার্ট টু
প্রকাশ | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২০:৫৭ | আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২১:১৭
"আপু সাহস করে বলেই ফেললাম, দয়া করে রাগান্বিত না হলে খুশি হবো, আপু আপনার সাথে শুতে চায়...একটা রাত..."
ঠিক এইভাবেই ভুল বানান আর বাক্যগঠনে আমাকে আদারবক্সে এই ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন মেহেদী হাসান অন্তর। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তার একটি রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে। বললাম না।
রাগান্বিত না হতে বলেছেন, রাগিনি, কিন্তু ভাবছি। এটা কি অনলাইন হ্যারেসমেন্ট? আমার বয়স হয়েছে। হাঁটুর বয়সী ছেলেছোকরার এইসব কথা শুনে আমার রাগ বা নিপীড়িত হওয়ার অনুভূতি হয় না। আমি ভাবি, সোসাইটি কি খুব অদ্ভুতভাবে বদলে গেছে?
হুমায়ূন আহমেদ এর 'জনম জনম' উপন্যাস থেকে সিনেমা বানিয়েছিলেন আবু সায়ীদ। মূল ক্যারেক্টারটার নাম তিথি। শাবনূর করেছিলেন। নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারের মা, অন্ধ বৃদ্ধ বাবা আর বাউন্ডুলে ছোট ভাই এর দায়িত্ব নিতে গিয়ে স্রেফ পতিতাবৃত্তিতে নামতে হয় তিথিকে। একসময় সংসারের অবস্থা ভালো হয়। বাউন্ডুলে ভাই কাজকর্ম শুরু করে, বাবা-মা মোটামুটি সুখের মুখ দেখতে শুরু করে। কিন্তু তিথি একটা জীবনের মতো ট্রমাটাইজ হয়ে যায়। মা যদি আদর করে গায়ে হাত রাখে তাতেও সে বিরক্ত হয়। বলে, মা গায়ে হাত দিও না তো, মনে হয় পুরুষমানুষ গায়ে হাত দিচ্ছে। জীবনের সব হাসিগান থেকে নিজেকে উইথড্র করে নেয় সে নিজেকে।
ছোটবেলায় বাবার বন্ধুর কাছে পরিবার থেকে জোর করে টাকা ধার চাইতে পাঠানো হতো তাকে, বাবার সেই বন্ধু যাকে চাচা ডাকতো তিথি, সে তাকে যৌন নিপীড়ন করে। তারও আগে আরও ছোটবেলায় খেলার সাথীদের সাথে বাইরে খেলতে গিয়ে দূরে গাছের আড়ালে দাঁড়ানো এক পুরুষকে দেখা যায়। তিথি আর তার বন্ধুরা লোকটির দিকে তাকাতেই লোকটা লুঙ্গী তুলে উত্থিত পুরুষাঙ্গ দেখায়। এমনকি পেশাতেও পুরুষের কাছে নানানভাবে অ্যাবিউজ হয় সে। শেষের একটা দৃশ্যের কথা খুব মনে পড়ে। তিথির চোখে একনজরে ভাসে জীবনে দেখা সমস্ত পুরুষ। কারো মুখে অশ্নীল হাসি, কেউ তাকে নিপীড়ন করছে আর লুঙ্গী তুলে দেখানো সেই পুরুষের মুখ। তিথির আর জীবনে ফেরা হয় না জনমের মতো।
গল্পটা বেশ আগের। তখন বাংলাদেশের মানুষ এত বড়লোক ছিল না, পরিবার বাঁচাতে তখনও এদেশের মেয়েদের পতিতাবৃত্তিতে নামতে হতো। আমি গল্পটার উল্লেখ করলাম জাস্ট শেষের এই দৃশ্যটার কথা মনে করে। একজনমের মতো দেখা অ্যাবিউজ করা পুরুষদের মুখ।
বাংলাদেশ বড়লোক হয়েছে। জনসংখ্যার ৫০ ভাগ নারী। সেই নারী কাজ করছে, জিডিপিতে অবদান রাখছে। কিন্তু সেই নারীকে দেখার চোখ কি বদলেছে? এখনও বাইরে বের হওয়া নারীকে লুঙ্গী তুলে উত্থিত পুরুষাঙ্গ দেখানোর লোকের কি অভাব আছে? বাংলাদেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, গ্রামে-গঞ্জে ইন্টারনেট। এই বেড়ে যাওয়া শিক্ষার হার এদেশের পুরুষদের কি শেখালো তবে? প্রতিদিন রাস্তায় হাঁটি আমি। অফিসফেরত। হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে ভালোবাসি। কিন্তু সারাক্ষণ পুরুষের চোখ আর গেয়ে চলা হিন্দি গানের সুর থেকে নিজেকে টানটান সতর্ক রাখতে রাখতে ভাবি, কিছুই কি বদলালো?
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখনকার ঘটনা মনে পড়ে। বাসে করে বাড়ি যেতাম। মাঝখানে লঞ্চ পাড়ি দিতে হতো। বাস থেকে নেমে হাতে জার্নি ব্যাগ আর কাঁধে হ্যান্ডব্যাগ ঝোলানো আমাকে কত পুরুষের যে নোংরা কথা শুনতে হতো। কোন কারণ নেই, শুনতে হতো। মাঝেমাঝে ঠিক কানের পাশে এসে বলে যাওয়া অশ্নীল বাক্যে মনে হতো আমি কি আদৌ মানুষ? মূলত তাড়াহুড়োর একটা জায়গা বলে হয়তো পুরুষ এবং বেশিরভাগই অশিক্ষিত হওয়ায় এই সুযোগটা তারা নিতো। তাড়াহুড়োর জায়গায় কেউ প্রতিবাদও করতো না। এইসব শুনতে শুনতে তরুণী আমি লঞ্চে উঠে নদীর দিকে তাকিয়ে একলা কাঁদতাম। আর কান্না সামলাতাম এই কথা ভেবে যে ওরা তো অশিক্ষিত পুরুষ, এরকম করতেই পারে। শিক্ষিতরা তো এই কাজ করবে না। সেসময় মেয়েরা হিজাব পড়তো না, হিজাবের ধারণাই ছিল না।
এখন সমাজে শিক্ষিত পুরুষ দেখছি। তো এখন কি বলে সান্ত্বনা দেবো নিজেকে বলেন তো আপনারা? এখন মেয়েরা নিজেকে ঢাকতে হিজাব পড়ে। নিজেকে ঢাকে। রেহাই পায় কি?
মেহেদী হাসান অন্তর এবং আরও আরও অন্তরেরা আমাকে দারুণ সব শিক্ষা দিচ্ছেন। আদারবক্স এবং ইনবক্স মিলিয়ে তারা আমাকে শেখাচ্ছেন পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায় নাই। পাল্টায় না। শেখাচ্ছে যে নারীর প্রতিবন্ধকতা কমেনি কিছুই, জাস্ট শিফট হয়ে অন্যরকম হয়েছে। আগে সরাসরি টিজ করতো অশিক্ষিত পুরুষেরা এখন অনলাইনে টিজ করে শিক্ষিত পুরুষরা। আগে অশিক্ষিত পুরুষরা বলতো আমার সাথে শুবি? এখন অনলাইনে বলে, আপু শুতে চাই।
পার্থক্য কিছু হয়েছে কিন্তু তাতে নারীর নদীর দিকে তাকিয়ে একলা কাঁদার ক্ষণ কি পাল্টালো?
লেখক: সাংবাদিক