জেনারালাইজেশন এর দুঃখ
প্রকাশ | ২৮ জানুয়ারি ২০১৭, ২২:২৮ | আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৭, ২২:৩৫
টেবিলের উপর ওয়ার্ল্ড এটলাসের বিশাল বইটা খুলে রাখা, তার দুই পাতা জুড়ে রঙের তারতম্য দিয়ে ম্যাপের মধ্যে দেখানো হয়েছে মানব সভ্যতার বিস্তার, আর কিভাবে আদি বাসস্থানের প্রভাব রয়ে গেছে নতুন বসতি গড়া মানুষের মধ্যে। জিনের প্রভাব এবং পরিবেশের প্রভাব মানুষ বয়ে বেড়াচ্ছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। আমার বাবা তাই বুঝিয়ে দিচ্ছে তার ছেলে আর নাতীকে, ছোট্ট আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি অনিন্দ্য সুন্দর ম্যাপটির দিকে।
আমার বাবা মারা গেছেন আমি অনেক ছোট থাকতেই, তেমন কোন স্মৃতি আমার নেই, তবুও মাঝে মাঝে ঘটনাচক্রে কেমন যেন স্পষ্ট হয়ে ফিরে আসে কিছু স্মৃতি। এই স্মৃতিটা প্রথম ফিরে পাই, আমার টিন এজ বয়সে একটা ঘটনায় প্রচণ্ড কষ্ট পেয়ে। আত্মীয়তার সূত্রে এক গ্রামের চার-পাঁচটা ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়, যারা প্রত্যেকে কাজিন, তাদের এক বোনের সাথে আমার বেশ সখ্যতা হয়। সেই বোনের মাধ্যমেই জানতে পারি, তাকে তার ভাইয়েরা আমার থেকে সাবধানে থাকতে বলেছে, কারণ, "ঢাকার মেয়েরা ডেঞ্জারাস!" যদিও ছেলেগুলোর সাথে আমার তেমন কথাই হতো না, তারা আমার সম্পর্কে কিছুই জানে না। বাংলাদেশ হওয়ার আগে থেকেই আমার বাবার ঢাকায় বসবাস, কিন্তু গ্রামের সাথে তার যোগাযোগ তীব্র। কখনো এই বিষয়টা খেয়াল করিনি। আমাকে না জেনেই এরকম কথা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল, বিষয়টা এতই ভাবিয়েছিল যে তখনই ঐ স্মৃতিটা ফিরে আসে। কিন্তু ততদিনে বাবা আর নেই, কাকে জিজ্ঞেস করবো, আঞ্চলিকতার এই জেনারালাইজেশন, কতটুকু যৌক্তিক?
বিষয়টা কষ্ট দিয়েছিল বলেই হয়তো নানা সময় এরকম বিভিন্ন জেনারালাইজেশন আমার চোখে পড়তো, আমাকে ভাবাতো। একসময় খেয়াল করলাম, ঢাকায় বড় হওয়া অনেকে বলছে, "গ্রামের মেয়েরা ভয়ঙ্কর!" এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে প্রচলিত আছে বিভিন্ন কথা! এগুলো আমাকে কষ্ট দিতো। সুযোগ পেলেই বয়সে বড়, পড়াশোনা করা কারো কাছে জানতে চাইতাম, এগুলোর যৌক্তিকতা কতটুকু? আব্বার বইটার কথা মনে পড়তো। মানুষের উপর জিন এবং পরিবেশের প্রভাব রয়েছে সত্য, সেটা অনেক বৃহৎ পরিসরে। এ ধরণের স্থূল বক্তব্য কেবল মানুষেরই মনগড়া। কেউ কেউ যুক্তি দেখায় অমুক অঞ্চলের মানুষ খুব স্বার্থপর হয়েছে কারণ প্রকৃতির বৈরিতা তাদের বেশী সহ্য করতে হয়। কেউ কেউ বলে একবার সাপে কাটলে যেমন মানুষ সাপ দেখলে ভয় পায়, তেমনই একটা খারাপ অভিজ্ঞতা থেকেই এসব কথার প্রচলন। আসলেই কি তাই! একজন এর জন্য পুরো অঞ্চলের সবাইকে কি এক আখ্যা দেয়া যায়?
চার মাসের ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে যখন প্রথম কানাডা আসি, বিদায়কালে একজন স্বনামধন্য শিক্ষিত বন্ধু বলেছিল, মেয়ের যখন বিয়ের বয়স হবে, তখন নাকি তাদের পায়ে ধরে কান্নাকাটি করবো, কারণ বিদেশে বড় হওয়া মেয়ে কেউ বিয়ে করবে না! এই যে রেসিজম, রঙের বৈষম্য, আঞ্চলিকতার বৈষম্য এগুলো বেশিরভাগই ব্যক্তি মানুষের চর্চা। গুটিকতক ব্যক্তির প্রচারেই এর প্রসার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা নেগেটিভ বিষয়গুলোর চর্চাকে বাড়তে সাহায্য করি। কখনো সাথে যোগ দিয়ে, কখনো প্রতিবাদ না করে। আমার সৌভাগ্য আমি এসব কথা বিভিন্ন সময় শুনলেও কার্যত আমার পরিবারের বৈষম্যহীনতার চর্চা আমার জীবনে প্রভাব ফেলেছে। নানা অঞ্চলের আত্মীয়-অনাত্মীয় সবাই একই ব্যবহার পেতো আমাদের পরিবারে। ঈদের সকালে পাশের বস্তির রিকশাওয়ালা আব্বার সাথে যে টেবিলে বসে খেতো, সেই একই টেবিলে বাংলাদেশ ব্যাংক এর গভর্নরও খেতো।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা মনে হয় তা হচ্ছে কোন রকম প্রি-কনসেপ্ট নিয়ে না মিশতে উৎসাহ দেয়া। আমার ভাই বলতো, পৃথিবীতে খারাপ মানুষ বলে কিছু নেই, কোন কোন মানুষ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে খারাপ আচরণ করে, আদতে সব মানুষই ভালো। জাফর ইকবাল স্যারের একটা কথা আমার ভীষণ ভালো লাগে তা হচ্ছে, সারা পৃথিবীর সব মানুষই একইরকম, একইরকম হাসি-কান্না, দুঃখ-ভালোবাসায় ভরা তাদের জীবন। অনেকে বলে এসব কথা মুখে মুখেই সম্ভব, বাস্তবতা ভিন্ন! বাস্তবতা কি? স্টিফেন হকিং'র একটা বক্তব্য শুনলাম রিয়েলিটি নিয়ে। তিনি বলেছেন, আমরা চোখ দিয়ে যা দেখছি তা আমাদের ব্রেইন যেভাবে প্রসেস করছে সেই ফিজিক্স হচ্ছে রিয়েলিটি, একই জায়গায় অবস্থান করেও দুজন মানুষ এর দেখা ভিন্ন হয়, ব্রেইন ভিন্নভাবে প্রসেস করছে বলে। পুরোটাই আমাদের ব্রেইনের কারসাজি! খুবই ছোট্ট পার্থক্যের জন্য প্রত্যেকটা মানুষের রিয়েলিটি ভিন্ন হয়ে যায়। এই বাস্তবতা এতই স্বতন্ত্র আর এত সূক্ষ্ম কারণে বদলে যেতে পারে যে এর কোন পূর্ব ধারণা সম্ভব নয়। অথচ আমরা কত সহজেই রঙ দেখে, অঞ্চল দেখে প্রি-কনসেপ্ট নিয়ে বসে থাকি।
শেখ শাদীর পোশাকের গল্পটা খুব মনে হয়, এত যুগ পরেও আমরা কিছুই শিখিনি, বাহ্যিক রূপ দেখেই এখনো ধারণা নিয়ে বসে থাকি।
আমার চাওয়া, মানুষ নিয়ে প্রি-কনসেপ্ট এর প্রচার-প্রসার আর তীব্রতা দূর হোক, তাহলে আর জেনারালাইজেশনের মতবাদে কাউকে দুঃখ পেতে হবে না। আমার মেয়েরা যে স্কুলে পড়ে সেখানে সারা পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন কালচারের মানুষের সন্তানেরা পড়ে। তাদেরকে সব সময় শেখানো হয় প্রত্যেকের বৈচিত্র্যকে যেন পুরোপুরি সম্মান দেখানো হয়, ওদের অতি প্রিয় মিউজিক টিচার যত বেশী সম্ভব দেশের মিউজিক এবং উৎসব জেনে নিয়ে সবার সঙ্গে তা পালন করে। একবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা প্রসঙ্গে আমার মেয়ে জানতে চেয়েছিল, এখনকার পাকিস্তানিরাও কি তখনকার মত নিষ্ঠুর? কারণ ওর অতি প্রিয় বন্ধু পাকিস্তানি। ওকে বুঝিয়ে ছিলাম, যুদ্ধটা অনেকাংশেই ছিল রাজনৈতিক, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভয়ঙ্কর জেনোসাইড এর মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেটা সাধারণ মানুষের সাথে সাধারণ মানুষের যুদ্ধ ছিল না। আমাদের নিজেদের লোক কেউ কেউ যেমন ওদের সাহায্য করেছিল, তেমনি ওদের কেউ কেউ এই জেনোসাইডের বিপক্ষে ছিল। বুঝিয়ে ছিলাম ইতিহাস ভালো করে জানতে হবে, বাংলাদেশের ভাষা এবং ইতিহাস প্রচণ্ড ত্যাগের আর গৌরবের। সেই সাথে অন্য আর সব ক্লাসের বন্ধুদের সাথে যেমন ব্যবহার কর, ওর সাথেও সে রকমই ব্যবহার করবে, কোন রকম প্রি-কনসেপ্ট নিয়ে রাখবে না। একটাই কনসেপ্ট মাথায় রাখা যায় তা হলো, "মানুষ হিসেবে সব মানুষকে ভালোবাসতে হবে, সম্মান করতে হবে।"
লেখক: প্রবাসী বাঙালি