বেওয়ারিশ কুকুর হত্যা: সংকট ও উত্তরণ

প্রকাশ | ২৭ জানুয়ারি ২০১৭, ২১:১০ | আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০১৭, ২১:৩১

খবর: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো নির্বিচারে বেওয়ারিশ কুকুর হত্যার ছবিতে ছেয়ে গেছে। শহর চট্টগ্রামের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় কারা, কিভাবে, কেন এসব হত্যা ঘটিয়েছে সেসব সম্পর্কে এখনো সুনির্দিষ্ট কিছু জানা যায় নি। তবে পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে এই কাজ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বৈকি।

নিশ্চিন্ত নিরাপত্তায় অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী'র নিখুঁত ভালোবাসা ও নির্মল বিনোদন দিয়ে সমাজে মানুষের সাথে একই সমান্তরালে বাস করে চলা প্রাণিটি আর কেউ নয়, কুকুর। আজ থেকে প্রায় ১৫,০০০ বছর আগে এই সখ্যতা, এই বন্ধুতার শুরু যা এখনো চলছে। সমান তালে। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস মানুষ যে প্রাণীটি প্রথম পোষ মানিয়েছিল তা ছিল কুকুর।
 
আমাদের দেশে বেওয়ারিশ কুকুর এত বেশি কেন?

বিষয়টি বুঝতে কুকুরের মোট সংখ্যাকে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বেওয়ারিশ ও মালিকানাধীন। অন্যভাবে বলতে গেলে বেওয়ারিশ (roaming) ও নিয়ন্ত্রিত (controlled)। যারা মুক্তভাবে চলে, ঘোরাঘুরি করে তারাই বেওয়ারিশ। এরা দুই প্রকৃতির। সংযত (restrained) ও অসংযত (unrestrained)। মালিকানাধীন কুকুরগুলো হারিয়ে গেলে, মালিকানা হারালে, অসংযত প্রকৃতির হয়ে পড়লে বেওয়ারিশ হয়ে যায়। পরে এরা নিজেরা প্রাকৃতিক উপায়ে বংশবৃদ্ধি করে করে বেওয়ারিশ হয়। আর এভাবেই থেকে যায়।

কুকুরের পূর্ণাঙ্গ বয়সে পৌঁছাতে মাত্র ছয় মাস বা ততোধিক সময় লাগে। এদের গর্ভকাল সময় ছোট। দু’মাস বা তার কিছুদিন বেশি। কুকুরের প্রতি প্রসবে বাচ্চার সংখ্যা অনেক বেশি। জাত ভেদে তা পাঁচ থেকে শুরু হয়। এমনকি বিশও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এসব মিলিয়ে প্রতি প্রজনন পরপর অনাবশ্যক কুকুরের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলে। অনেক সময় এলাকাভিত্তিক কুকুরের অভিবাসন (migration) ও স্থানান্তর (Translocation) ঘটে।

আমাদের দেশে শখের বসে দেশীয় জাতের কুকুর পুষছে এমন লোকের সংখ্যা খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। অথচ বেওয়ারিশ কুকুরের সিংহভাগ দেশীয় জাতের। কোন এক অলিখিত নিয়মে এদেশের মানুষ শুধুমাত্র খাওয়ার বেলায় দেশী জাতের চিকেন অধিকতর পছন্দ করে। বাকিসব ক্ষেত্রে দেশের হিসেব বিবেচনাধীন। বেওয়ারিশ কুকুরগুলোও এই নিষ্ঠুর বাস্তবতার বাইরে নয়।

আমাদের দেশে কোন সুপরিকল্পিত পরিচ্ছন্ন খাদ্যবর্জ্য ব্যবস্থাপনা নাই। যেখানে সেখানে ডাস্টবিন। উচ্ছিষ্ট খাবার। পরিবেশে এরকম খাদ্যবর্জ্য'র উপস্থিতি বেওয়ারিশ কুকুরের প্রাকৃতিক টিকে থাকাকে প্রতিনিয়ত আরো সুনিশ্চিত করে।

কুকুর নিধন কেন করা যাবে না?

নিঃসন্দেহে কুকুর হত্যা অমানবিক। বিপজ্জনক। পরিবেশ দূষণ ও রোগ সংক্রমণের বড় কারণ। বাস্তুসংস্থানে জীবিত নির্দিষ্ট একটি প্রজাতির সাথে পরিবেশগত নিবিড় সম্পর্ক (Biological Niche) বিদ্যমান। নির্বিচারে কুকুর হত্যা এটি বিনষ্ট করবে।

নির্বিচারে কুকুর হত্যা এলাকাভিত্তিক নতুন নতুন কুকুরের অভিবাসন (migration) ও স্থানান্তর (Translocation) ঘটাবে এবং পূর্বাপর ভারসাম্য বজায় রাখবে। তথাপি, প্রাকৃতিকভাবে নির্বিচারে কুকুর হত্যায় বেঁচে যাওয়া কুকুরগুলোর প্রজনন হার অনেক বেড়ে যাবে। ইঁদুর, শেয়াল, নেকড়ে বা সদৃশ প্রাণীগুলোও তখন বেড়ে যাবে। বিবিধ।

নির্বিচারে কুকুর হত্যা শিশু ও জনমনে গভীর হতাশা ও আতংকের উদ্রেক করে। মানুষের মত এদেরও রয়েছে বেঁচে থাকার সমান অধিকার। নির্বিচারে কুকুর হত্যার লাইসেন্স কোন ধর্মের নিষেধ বিধিতেও নাই।

উত্তরণ কি তাহলে?

নির্বিচারে বেওয়ারিশ কুকুর নিধন কোন কিছুর সমাধান নয়। বেওয়ারিশ কুকুর হত্যার প্রধানতম টার্গেট জলাতঙ্ক রোধ। জলাতঙ্ক, ভাইরাস জনিত একটি মারাত্মক রোগ যা মানুষসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণিদের আক্রান্ত করে। এ রোগে মৃত্যু অনিবার্য। 

মানুষে জলাতঙ্ক রোধের সবচেয়ে টেকসই সমাধান প্রাণি'র জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ। এজন্য কুকুর গণটীকাদান কর্মসূচি (Mass dog vaccination program), কুকুর রেজিস্ট্রেশন (Dog registration), কুকুর বন্ধ্যাকরণ (Neutering), গণশিক্ষা কার্যক্রম (Mass education), গণসচেতনতা বৃদ্ধি (Mass awareness) ইত্যাদি উপায় গ্রহণ করতে হয়।

বেওয়ারিশ কুকুর গুলোকে নির্দিষ্ট ব্যক্তি, গোষ্ঠী, ক্লাব, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা নির্বিশেষে মালিকানা প্রদান করা যেতে পারে। বেওয়ারিশ, মালিকানাধীন সব কুকুরের রেজিস্ট্রেশন করা যেতে পারে। মালিকানা প্রদান করা কাজটি খুব কঠিন- এমনটি ভাবার কোন কারণ নাই। আমি হলফ করে বলতে পারি- কোন শহরের এপার্টমেন্ট প্রতি যদি একটা কুকুরও মালিকানা প্রাপ্ত হয়, তবে সে শহরে আর কোন কুকুর বেওয়ারিশ থাকবে না। 

ফি বছর মালিকানাধীন ও বেওয়ারিশ কুকুরগুলোর টীকা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট নাম, প্রয়োজনীয় খাদ্য ও নিরাপদ আবাসস্থান থাকবে। সমাজের বিত্তবান শ্রেণী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব কিংবা নির্দিষ্ট সোসাইটির লোকজন এদের নিয়মিত খাবারের অর্থায়ন করতে পারে। 

এমনকি বিশেষ ট্রেনিং পূর্বক নিরাপত্তার কাজে এদের বহুল ব্যবহার বিশাল সংখ্যার এই বেওয়ারিশ সমাজকে সম্পদে রূপান্তর করতে পারে। তাই তো নির্বিচারে কুকুর নিধন রুখতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রাণিহিতৈষী সংস্থাগুলো তাদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলছে। সচেতন সমাজকে পোষার প্রতি আরো বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।

জলাতঙ্ক সম্পর্কিত প্রাথমিক জ্ঞান ও চিকিৎসা, কুকুরের সাথে সাথে মানুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত এসব বিষয়গুলো ভেটেরিনারিয়ানদের কাছে জেনে নিতে হবে। নির্বিচারে কুকুর হত্যা না করে বেওয়ারিশ কুকুর বন্ধ্যাকরণ (Neutering) কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। তাদের সুস্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি সংখ্যা হ্রাসে আজ পর্যন্ত এটিই ইতিবাচক ও বিজ্ঞানভিত্তিক।

লেখক: ফিল্ড ভেটেরিনারিয়ান, সুনামি এনিম্যাল পিপল এলায়েন্স, শ্রীলংকা