চট্টগ্রামে কুকুর হত্যার ভূত ভবিষ্যত
প্রকাশ | ২৬ জানুয়ারি ২০১৭, ০১:২৪
২৫ জানুয়ারি ২০১৭। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ডাস্টবিনে পড়ে আছে পনেরটি মৃত কুকুর। শিশু আর প্রাপ্ত বয়েসি মিলে। আসলে এদের হত্যা করা হয়েছে। বিষ খাইয়ে। চট্টগ্রামে কুকুর হত্যার নৃশংস ঘটনা ইতোমধ্যেই সামাজিক-সংবাদ মাধ্যমে আলোচনায় এসেছে। আর স্বাভাবিকভাবে আলোচিত সংবাদের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনার মতো এমন হত্যার দায় এড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে; যেহেতু সংবাদমাধ্যমের কাছে তারা কিছু না জানার ভান ধরে আছেন এবং শেষ পর্যন্ত ভং ধরে থাকবেন – এমনটাই হতাশার।
কিন্তু এই ঘটনা আমাদের কিছু জরুরি পদক্ষেপের প্রতি ইঙ্গিত দেয়। তা হল প্রাণী কল্যাণ আইন ২০১৫ সালের খসড়াটি মজবুতভাবে প্রণয়ন এবং প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা আইন ১৯২০ – যথার্থভাবে সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা। এই আইনগুলোর যৌক্তিক প্রণয়ন এমন নৃশংসভাবে প্রাণী হত্যার দায় এড়ানোর কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ আইনের শাসন থাকুক বা না থাকুক; আইনি প্রক্রিয়া সচল থাকবে। এই দুটি আইনের প্রতি নির্দেশের কারণ হল আপাতদৃশ্য অকার্যকর মানববন্ধনের বিপরীতে প্রণীত আইনই কঠোর ভূমিকা রাখবে তাতে নিশ্চয় সংশয় কিংবা সন্দেহ অবশিষ্ট থাকে না।
গত রাতেই আমাদের সাংবাদিক বন্ধুমহল সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এটি আদতে প্রাণীর প্রতি তাদের ভালোবাসার অকৃত্রিম প্রকাশ। প্রাণী ভালবাসুক বা না বাসুক এমন অনেকেই সোচ্চার হয়েছেন এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমি পারিনি। কেননা এমন বিকৃত সামাজিক ব্যাধি আমাকে বরং ভাবিয়ে তুলেছিল নানা দিক নিয়ে।
সামাজিক এমন ব্যাধি নিয়ে ভাবতে গিয়ে নজর পড়লো যুক্তরাষ্ট্রের দ্য হিউমেইন সোসাইটির প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা ও মনুষ্য সহিংসতা শীর্ষক একটি তথ্যসংযোগে। সেখানে বিভিন্ন অধ্যয়ন থেকে প্রাণী নির্যাতন ও অপরাধমূলক সহিংসতার মধ্যে এক ধরনের মনোসংযোগের উপস্থিতি পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রাণী নির্যাতনের পরিণত অধ্যায় হল মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা। এ নিয়ে খানিক বিস্তারিত ঘাটতে গিয়ে সামনে আসলো প্রাণী নৃশংসতার সাথে মানসিক রোগ সংযোগের বিষয়টি। সেখানে দেখা যাচ্ছে শিশু বয়সে প্রাণী নির্যাতন একধরণের অস্বাভাবিকতা। এছাড়া প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা একটি আচরণগত ব্যাধি যা ডায়াগনস্টিক নির্ণায়কের মাধ্যমে নির্ধারণ করা প্রয়োজন; কিন্তু গবেষণা বলছে এমন আচরণ ডায়াগনস্টিক তাৎপর্যে নিরস্তিত্ব। কিন্তু বর্তমান গবেষণায় তদন্তকারীরা বলছে প্রাণীর প্রতি নৃশংসতার ইতিহাস এন্টিসোশ্যাল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারের (এপিডি) সাথে সম্পৃক্ত।
সত্যি এই অবস্থা ভয়াবহ উদ্বেগের কারণ; কেননা যেভাবে আমরা অবক্ষয়ের দিকে এগুচ্ছি, যে নৃশংসতা অকপটে ঘটে যাচ্ছে তার লক্ষণগুলোর বেশ অনেক কিছুই ঐ অধ্যয়নের সাথে মিলে যায়। আর এই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো ভয়াবহ বিপদসংকেত। তাই সমাধান খুঁজতে হবে দুদিকে সমভাবে; একটি শক্ত আইনের প্রণয়ন, অপরটি মানুষ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পরতে পরতে মানবিক হবার শিক্ষা, যা ডিজিটাল হলেও সমস্যা নেই।
এবং সর্বোপরি সময় হয়েছে আমাদের তথাকথিত সৃজনশীল শিক্ষা অবস্থায় প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যকে সম্পৃক্ত করা, প্রাণ-প্রকৃতি পাঠকে সকল স্তরের সাধারণ শিক্ষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার। এই প্রাণ-প্রকৃতির সাথে টান নেই বলেই আমরা মনুষ্য সমাজেরা রাষ্ট্রীয় ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছি।
নানান প্রসঙ্গে কুকুরের হত্যাকাণ্ড হারিয়ে ফেলেছি? না! আমি আসলে এই হত্যাযজ্ঞের বিকৃত অস্বাভাবিকতার জিজ্ঞাসাগুলো খুঁজতে চেয়েছি। সুতরাং এমন বিকৃতি থেকে উত্তরণ দরকার। সেটা অবশ্যই সম্ভব। কিছু বোঝাপড়া নিজের সাথে প্রাণ-প্রকৃতির। আর এই বোঝাপড়া করতে গিয়েই গান্ধীর একটি কথা আমার মর্মে বিঁধেছিল, বলেছিলেন “কেমন হচ্ছে প্রাণীর প্রতি আচরণ, এ দিয়ে বিচার করা যায় একটি জাতির মাহাত্ম্য ও তার মূল্যবোধের অগ্রগতির অবস্থাকে”।
লেখক: ভিজ্যুয়াল জার্নালিস্ট, বিবিসি