মূল্য নির্ধারণ হয় সামগ্রীর, মানুষের নয়
প্রকাশ | ১১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:২৪
(১)
যে সংগ্রামটি শতাব্দী যাবত নারীরা করে আসছেন সেই সংগ্রামটা এখনো অব্যাহত রয়েছে এখনো প্রাসঙ্গিক। এবং আফসোসের কথা হচ্ছে যে এই সংগ্রামটিতে আমাদের অর্থাৎ ব্যাটাছেলেদের ভূমিকা শত বছর আগেও যেরকম ছিল নিতান্তই শঠ নিকৃষ্ট মন্দ ভিলেনের মতো, এখনো আছে সেই একই রকম। আর আমাদের অর্থাৎ ব্যাটাছেলেদের হাতে সবচেয়ে পুরনো অথচ সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ারটা সেদিনও ছিল ধর্ম, আজকেও সেই একই- ধর্ম। না, আহত হবেন না বা হতাশ হবেন না। এই যে আমি ধর্মকে নারীর মুক্তির বিরুদ্ধে নিয়ত ব্যবহৃত একটি ভয়ংকর অস্ত্র বলছি, এটা কেবল আপনার ধর্মই না- সকল ধর্ম।
প্রায় পৌনে এক শতক আগে Simone de Beauvoir লিখেছিলেন "Man enjoys the great advantage of having a god endorse the code he writes; and since man exercises a sovereign authority over women it is especially fortunate that this authority has been vested in him by the Supreme Being. For the Jews, Mohammedans and Christians among others, man is master by divine right; the fear of God will therefore repress any impulse towards revolt in the downtrodden female."
(The Second Sex, বইটি অনলাইনে ফ্রিতে পাওয়া যায়। এটির একটি বাংলা অনুবাদ করেছিলেন হুমায়ূন আজাদ, সেটিও বাজারে এখনো মিলে।)
একইরকম কথা আপনি বেগম রোকেয়ার লেখাতেও পাবেন। আর আমাদের তসলিমা নাসরিন তো এই কথা বলে যাচ্ছেন তো বলেই যাচ্ছেন। আপনারা ওকে দেশছাড়া করেছেন, মেরে ফেলতে চেয়েছেন, তবু তিনি তার উপলব্ধির কথাটি বলতে কুণ্ঠা করছেন না। নারীরা কেন বলবেন না ধর্মের বিরুদ্ধে আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবেন? কোন ধর্মই যে নারীকে পুরুষের মতো মানুষ বিবেচনা করে না সে কথাটি তো ওদের গ্রন্থগুলিতে লেখাই আছে। আর এইটা যে ধর্মগুলির মৌলিক প্রত্যয়ের অপরিত্যাজ্য ভিত্তি সেও তো প্রতিদিনই দেখতে পাই।
(২)
আজকেই দেখেন। খবর দেখলাম- কি? খেলাফত আন্দোলন রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছে যে উনারা ইলেকশন কমিশনে নারীদেরকে দেখতে চান না। কেন? এনটিভিবিডি.কম থেকে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি, "দলটি মনে করে, নির্বাচনের মধ্যে অনেক চাপ থাকে। এসব ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কাজ ‘মহিলাদের’ দ্বারা হয়ে উঠবে না।... বৈঠক শেষে দলের যুগ্ম মহাসচিব মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, '... দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, নির্বাচনের মধ্যে অনেক চাপ একসঙ্গে পড়ে যায়। সেখানে এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ মহিলাদের দ্বারা অনেক সময়ে হয়ে ওঠে না। এ জন্য আমরা এখানে পুরুষের কথাই বলছি। মহিলাদের কথা বলিনি।’
মুখে যেসব যুক্তি দেখাচ্ছে সেসব যুক্তির যে কোন বাস্তব ভিত্তি নাই সেকথা তো আর তর্ক করে বুঝানোর কিছু নাই। আমাদের দেশের ইতিহাসে এই পর্যন্ত যতজন নির্বাচন কমিশনার হয়েছে সকলের নামের লিস্টি করে আমাকে দেখান- কোন কমিশনারটা এমন ছিল যে তার সমান যোগ্যতার বয়া দক্ষতার নারী বাংলাদেশ নাই? এইসব কোন যুক্তি না। আসল কথা হচ্ছে ওদের ধর্মীয় বিশ্বাস- যেখানে নারীকে পুরুষের সমান একই মর্যাদার মানুষ বিবেচনা করা হয় না। যেখানে নারীকে বলেই দেওয়া হচ্ছে যে তুমি হচ্ছ পুরুষের চেয়ে অধম, তোমাকে পুরুষের অধীনস্থ করা হয়েছে, তুমি পুরুষের অবাধ্য হবে না, পুরুষের কথার উপর কথা বলবে না।
এইসব কথা তো আগেও বলেছি তখন কি হয়েছে জানেন? আধুনিক ধার্মিক কয়েকজন আলাপের সূত্রে বলছে, 'না ইমতিয়াজ ভাই, আপনি জানেন না আমাদের ধর্মে নারীকে অনেক উঁচু আসনে রাখা হয়েছে, কন্যা সন্তানকে বহু মূল্যবান হীরে জহরত বলা হয়েছে, আপনারা তো ঠিকমত পড়েন না, না পড়েই শুধু ইত্যাদি।' আমি তর্ক করি না। ধার্মিকদের সাথে তর্ক করতে হয় না। ধার্মিকদেরও তর্ক করা উচিৎ না। ধার্মিক ব্যাক্তিকে বিশ্বাস করতে হয় যে তাঁর গ্রন্থের সকল কথা সকল বর্ণ সব সত্যি। এর একটা যতিচিহ্ন নিয়েও প্রশ্ন করা যাবে না। তর্কের সুযোগ কই?
(৩)
তর্ক করি না ঠিকই। আহত হই। ওদের ধর্মীয় অনুভূতি অক্ষত থাকে আমার মানবিক অনুভূতি আহত হয় প্রতিদিন প্রতিবেলা। অন্তরে খুন ঝরে। কি বলে এইসব পাষণ্ডের দল! আমি আমার জননীর দিকে তাকাই, কই, তিনি তো নিতান্তই একজন মানুষ। দুঃখ, কষ্ট, বঞ্চনা প্রতারণার শিকার হয়েছেন সারা জীবন। যে ঈশ্বর তাঁকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ মনে করেনি, সেই ঈশ্বরের কাছে নতজানু হচ্ছেন প্রতিদিন কি অবাক বিশ্বাসে! কিন্তু তিনি তো মানুষই। কোন অর্থে তাঁকে আমি একটা ব্যাটাছেলের চেয়ে কম বলবো? আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, আমার কন্যারা- আমি ভাল করে দেখি- মানুষই তো। কেন, ওরা কিভাবে একজন পুরুষের চেয়ে অধম?
যে মেয়েটি প্রতিদিন সকালে পায়ে হেঁটে দূর দূর পথ পাড়ি দিয়ে যায় ফ্যাক্টরিতে তাকে তো আমার অপূর্ণ মানুষ মনে হয় না। কিভাবে? বুঝান তো আমাকে এই মেয়েটি কিভাবে যে কোন একজন পুরুষের চেয়ে অধম? এমনকি যে নারীটি কাকরাইল মসজিদের আশেপাশে রাতের বেলা সেজেগুজে আদিমতম পেশাটি করতে যায়, সেই মেয়েটিও কোন অর্থেই কোন যোগ্যতায়ই একজন সাধারণ পুরুষের চেয়ে কম না।
অযোগ্যতা বা যোগ্যতার অভাব অনেকেরই থাকে। সেটা হতে পারে, অযোগ্য লোককে কেন নিব? কিন্তু অযোগ্যতা যদি থাকে, সেটা তো জেন্ডার নিরপেক্ষ ব্যাপার, অযোগ্য নারীও আছে অযোগ্য পুরুষও আছে। কিন্তু কেবল নারী বলেই কেউ অযোগ্য হবে এটা কি কথা? ঐ হুজুরদেরকে কেউ মেহেরবানী করে বলতে পারেন? আমাকে এসে বুঝিয়ে যা, তোদের সেই পুরনো গ্রন্থের বাণীতে কি বলা আছে সেইসব বাদে, বাস্তবে কেন একজন নারী একটি সাংবিধানিক পদে নিয়োগ পেতে অযোগ্য হবে?
দেখেন, নারীকে হালুয়া হিসাবে দেখা বন্ধ করেন এবং হীরে জহরত হিসাবেও দেখা বন্ধ করেন। নারীও মানুষ এই কথাটা আপনাদের মগজে স্থাপন করতে চেষ্টা করেন। নিজেকে নিজে বলেন, নারীও মানুষ, তিনি আগে একজন মানুষ এরপর একজন নারী বা পুরুষ বা অন্যকিছু।
(৪)
কিন্তু এইটা সহজে হবে না। নারীকে মানুষ হিসাবে দেখার ব্যাপারটা চট করে হবে না। নারীকে একটি ভোগের পণ্য হিসাবে দেখা, এইটা আমাদের মগজের এতো গভীরে প্রোথিত একটা ব্যাপার যে সহজে এটা মাথা থেকে যাবে না। আর আমরা তো প্রতিদিন প্রতিনিয়ত আমাদের শিশুদেরকেও সেই শিক্ষাই দিচ্ছি- নারী পূর্ণাঙ্গ মানুষ না, নারী পুরুষের অধীনেই থাকবে, এইটাই বিধান। আপনি আপনার ডানে বামে তাকিয়ে দেখেন, শিশুদেরকে কি আমরা এই শিক্ষা দিচ্ছি না? একটা শিশুকে শিখাচ্ছি- ওড়না লাগবে। কেন? ইমপ্লিকেশনটা কি?
আপনি কি আপনার আশেপাশে নিতান্ত শিশু মেয়েদেরকে দেখেননি যাদের মাথায় পিতামাতা একটা নোংরা ন্যাকড়া বেধে দিয়েছে পর্দার নামে। ইমপ্লকেশনটা কি? তুমি একটি লোভনীয় হালুয়া মাত্র, তোমাকে ঢেকে রাখতে হবে। তুমি একটি হীরের টুকরা- মহামূল্যবান বটে, তবুও নিতান্তই একটি ভোগের বস্তু- তোমাকে সিন্দুকে ভরে রাখতে হবে, তালা মেরে রাখতে হবে। এই যে তালা মেরে রাখা, ঢেকে রাখা, এইগুলিই কিন্তু ওরা যুক্তি হিসাবে ব্যবহার করে।
বিস্মিত হয়েছি একদিন আমার এক বন্ধুর সাথে কথা বলতে গিয়ে। বিস্মিত হয়েছি কারণ আমার এই বন্ধুটিকে একসময় ভদ্রলোক ভাবতাম। ক্ষেপা বটে, রাজনৈতিক ডিগবাজি এইসব করে এখন আওয়ামী লীগে আছেন, কিন্তু তাকে আমি একজন লিবারেল ভদ্রলোকই মনে করতাম। একদিন টেলিফোনে কথা হচ্ছিল, তিনি টেলিভিশনে টক শোতে যাবেন একটু পর, তার আগে আমাকে ফোন করেছেন, এমনিই একটু মত বিনিময় করা ইত্যাদি। কথায় কথায় কিভাবে যেন কন্যা সন্তানের কথা চলে এসেছে। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে বন্ধুটি বলতে থাকেন, 'তোর বাসায় টাকা পয়সা মূল্যবান জিনিস রেখে তুই কি কখনো তালা না মেরে বের হস?' ইত্যাদি। আমার বিবমিষা চলে আসে। কথা বলতে পারি না। আমার কন্যা কি একটি সামগ্রী?
(৫)
না, আমার কন্যারা কোন সামগ্রী নয়। মূল্যহীনও নয়, মহামূল্যবানও নয়- কেননা ওরা মানুষ। মানুষ। ঐরকম মূল্য নির্ধারণ হয় সামগ্রীর, মানুষের নয়। আঠারো বছর বয়সে আমি যতটুকু মানুষ ছিলাম, আমার কন্যারাও ওদের আঠারো বছর বয়সে ঠিক ততটুকুই মানুষ। আমি আমার জীবন যতটুকু নিজের শর্তে যাপন করেছি, ওদেরও অধিকার আছে ঠিক সেইভাবে ওদের নিজেদের শর্তে ওদের নিজেদের জীবন যাপন করার। আমি যেরকম জীবনে ভুল করেছি, শুদ্ধ করেছি, ভাল কাজ করেছি, মন্দ কাজ করেছি ওরাও তাই করবে। নারী হয়েছে বলে ওকে এককদম পিছিয়ে রাখতে বলবেন? ফাক অফ।
লেখক: আইনজীবী