বাংলা একাডেমিকে উদ্ধার করা প্রয়োজন
প্রকাশ | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:১০ | আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:২৯
অমর একুশে বইমেলা ২০১৭ এর স্টল বরাদ্দের ফরম তুলতে গিয়ে শ্রাবণ প্রকাশনী প্রথম জানতে পারে, শ্রাবণ প্রকাশনীকে বই মেলায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে স্টল বরাদ্দের ফরম তুলতে দেয়া হয়নি। কোন ধরণের কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়াই বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান শ্রাবণ প্রকাশনীকে বই মেলায় নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।
ভাবতে অবাক লাগছে বাংলা একাডেমির চেয়ারে বসে রয়েছেন একজন স্বৈরতন্ত্রের প্রেতাত্মা। ষাট এর দশকের রক্ত ঝরা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলা একাডেমির জন্ম। সে বাংলা একাডেমিতে বসে রয়েছেন একজন শামসুজ্জামান খান। তিনি প্রকাশ্যে গণমাধ্যমকে বলেছেন শ্রাবণ প্রকাশনী’র রবীন আহসান গত বছরের বইমেলায় বাংলা একাডেমি কতৃক ‘বদ্বীপ’ প্রকাশনী নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে শামসুজ্জামান খান গংদের নেয়া সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন, একই সাথে তিনি বলেছেন হেফাজতের নেয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রবীন আহসান কথা বলেছে।
শামসুজ্জামান খান’এর কথা শুনে মনে হচ্ছে হেফাজতের কথা না শোনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ! এই কারণে রবীন আহসান’এর শ্রাবণ প্রকাশনী স্টল বরাদ্দ পাবে না।
এই অপকর্মটি করতে শামসুজ্জামান খান বাংলা একাডেমির পরিচালনা পর্ষদের সহায়তা নিয়েছেন, একটি সভা ডেকে এই কর্মের অনুমোদনও নিয়েছেন। সেটি তিনি গোপন রেখেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে বাংলা একাডেমি একইসাথে অভিযোগকারী এবং বিচারকের ভূমিকাও নিয়ে নিয়েছে। গত বছর দুয়েকের মধ্যে বাংলা একাডেমি গোটা দুই প্রকাশনী বই মেলায় নিষিদ্ধ করেছে, মেলা চলাকালীন সময়ে স্টল বন্ধ করেছে এবং বই বাজেয়াপ্ত করার মত ন্যাক্কারজনক কান্ড ঘটিয়েছে।
দেশে মৌলবাদীদের বাড়বাড়ন্ত চলছে। বাংলা একাডেমির আগ বাড়িয়ে মৌলবাদীদের জুজু দেখানো ও মৌলবাদের ভয় দেখিয়ে নিজেদের অপকর্ম জায়েজ করার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হচ্ছে বাংলা একাডেমিতে মৌলবাদ আছর করেছে শামসুজ্জামান খান গংদের হাত ধরেই।
পাঠকের রুচি ও বাছ বিচার এবং কোন ধরণের বই পড়বে তা নির্ধারণের দায়িত্ব কী বাংলা একাডেমি মহাপরিচালকের উপর বর্তিয়েছে? এ দায়িত্ব তিনি কাঁধে তুলে নেবার কে? পাঠক নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে মেলা প্রাঙ্গণে ধুলা বালুতে মাখামাখি করে বই কিনে নিয়ে যাবে শামসুজ্জামান খান গংদের বিচারে!
প্রকাশক ও লেখকদের উপর এক ধরণের সেন্সরশীপ চালু করেছেন শামসুজ্জাম খান গং। মেলা চালু করার সময়ে এক ধরণের অযাচিত উপদেশ খয়রাত করা হয় প্রকাশক ও লেখকদের প্রতি। কোন বইটি প্রকাশ করা যাবে আর কোনটি প্রকাশ করা যাবে না।
কাজের কাজ বাদ দিয়ে বাংলা একাডেমি মাঠে নেমেছে হেফাজত বন্দনায়, হেফাজতের আদর্শ ধারণ করাই যদি বাংলা একাডেমির কাজ হবে, তাহলে এই একাডেমি দিয়ে এ জাতি কী অর্জন করবে? ধীরে ধীরে মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ছে এ সমাজে, বাংলা একাডেমির কার্যকলাপে এ আশংকা আরও বাড়ছে। এ একাডেমির মধ্যে এখন মৌলবাদের ভূতের ছায়া দেখা যাচ্ছে। একাডেমি প্রধান হেফাজতের মুখের দিকে তাকিয়ে তার নিজের কাজ ও লক্ষ্য ঠিক করেন!
অথচ দেশে বাংলা একাডেমিতে বই মেলার প্রচলন ঘটিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। নিজের কাঁধে করে বই এনে এ মেলার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন তিনি। বাংলা একাডেমি এটি প্রকাশকদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে, এখন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।
দেশে সৃজনশীল প্রকাশনা নামক একটি সমিতি আছে প্রকাশকদের, সেটির ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। বই মেলায় কোমড়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে প্রকাশকদের বই প্রকাশের দায়ে, পুলিশ ধরে নিয়ে গেলেও এদের মুখে কোন রা নেই। লেখক ও প্রকাশক খুন হয়ে গেলেও এই সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি মুখে আঙুল দিয়ে নির্বিকার থাকে। লেখকদের কোন রকমে ম্যানেজ করে বই প্রকাশনা করা ও বিক্রি করার বাইরেও যে প্রকাশনা একটি শিল্প মাধ্যম এটি বোঝার ক্ষমতা এই সৃজনশীল ব্যবসায়ীদের নাই! সরকারের অনুগ্রহ প্রত্যাশী এই সৃজনশীলেরা এখন কোন রকমের দায় নিতে চান না। সরকারের নেক নজরে থাকার প্রত্যাশায় থাকা এই ব্যবসায়ীরা স্রেফ টাকা কামানোর জন্যই এখন এ ব্যবসায় জড়িত।
বই মেলা চিন্তার খোরাক জাগায়, প্রশ্ন করতে শেখায় প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে এ সমস্ত লেখা যেন প্রকাশিত না হয়, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে চুপ করে থাকার এই বার্তায় পৌঁছে দিতে চেয়েছেন হেফাজত বান্ধব শামসুজ্জামান খান গং শ্রাবণ প্রকাশনী নিষিদ্ধ করে। ব্যক্তি রবীন আহসানের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে ক্ষান্ত হননি জনাব শামসুজ্জামান, একই সাথে রবীন আহসান’এর প্রতিষ্ঠান শ্রাবণ প্রকাশনী নিষিদ্ধ করে, নিজের যে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন তাই মৌলবাদের প্রাণভোমরা। একজন অবিবেচক ও স্বৈরতান্ত্রিক প্রশাসক যে কোন প্রতিষ্ঠানকেই মৌলবাদের পক্ষ পুটে নিয়ে যেতে পারেন, শামসুজ্জামান খান এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
অমর একুশের দোহাই দিয়ে বই মেলার সময়ে বাংলা একাডেমি যে সমস্ত আলোচনা সভার আয়োজন করে, একাডেমির গলগ্রহ ও ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনৈতিক দালালদের দিয়ে তা বেশীরভাগ দর্শক ও শ্রোতার নজর কাড়ে না। একুশের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক নানান কাজে ব্যাপৃত থাকা বাংলা একাডেমির দিকে নজর দেয়ার সময় এসেছে। শ্রাবণ প্রকাশনী নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলা একাডেমির কার্যকলাপের কিছুটা টের পাওয়া গেল মাত্র। শ্রাবণ প্রকাশনী নিষিদ্ধ হবার পরও যাদের মুখের তালা খুলেনি তাদের জন্য করুণা হচ্ছে, রাজানুগ্রহ একটা সময় পর্যন্ত ললিপপ দেবে, কিন্তু সময়ে শামসুজ্জামান খান’রা সেটা ফেরত নিয়ে যাবে ৭১ এর খান সেনাদের মতই। ভিন্ন কোন সময়ে।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী থেকে বাংলা একাডেমি উদ্ধার করা প্রয়োজন, মৌলবাদের বাড় বাড়ন্তের কাজে বাংলা একাডেমি যতটুকু ব্যবহৃত হয়েছে তো হয়েছে, বাকিটুকু যাবার আগেই।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা