কে জংলি, কে সভ্য !
প্রকাশ | ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ২০:১৭ | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ২০:২১
মারমা, মুরং, খুমি, ত্রিপুরা, সনাতনী, মগ এরকম অনেক ধরনের জাতির বাস পাহাড়ে। পাহাড়ের জীবন অনেক কঠিন। সেই আদিম জীবনযাত্রা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে এই পাহাড়িরা। নিজেদের কাপড় তারা নিজেরাই বুনে, নিজেদের ফসল তারা নিজেরাই ফলায়। তাই পাহাড়ের বাইরের জীবন নিয়ে তাদের কোন আগ্রহ নেই। পাহাড়ের জীবনে অভ্যস্ত হয়েই তারা সুখী।
বাঙালিদের মধ্যে পাহাড়িদের প্রতি একটা নাক সিঁটকানো ভাব আছে। কারণ, পাহাড়িরা সব খায়। সাপ, ব্যাঙ, পোকা মাকড়, শুকর, বানর, কুকুর সব। বান্দরবানে নাকি এক সময় প্রচুর বানর ছিল। সেই বানর এখন আর নেই। তিন বার বান্দরবান গিয়ে আমি মাত্র একটা বানরের দেখা পেয়েছি। পাহাড়িরা নাকি সব বানর খেয়ে সাফ করে দিয়েছে। পাহাড়ে হরিণও বাস করে, এরকম শুনেছি শুধু।
যা বলছিলাম, পাহাড়িরা সব খায়। খুমিদের নিয়েও বাঙালিদের মধ্যে একটু আতংক মিশ্রিত ঘৃণা লক্ষ্য করলাম। কারণ, খুমিরা নাকি মানুষের মাংসও খায়। খুমিরা মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধদের নাকি কেটেকুটে সবাই মিলে খেয়ে ফেলে। তবে এসব অনেক আগের কথা, এখন অবশ্য খায় না। আমিও ভাবছিলাম, খাদ্যের অভাব মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে! কিংবা এসব হয়ত তাদের রীতি! আর আমরা কাদেরই বা জংলি বলছি! আমরা যারা নিজেদের সভ্য বলে মনে করি, এই আমরাই কি কম হিংস্র? ক্যানিবালিজম কি আমাদের মধ্যে নেই? নিজ স্বার্থের জন্য স্বজাতির মাংস আক্ষরিকভাবে হয়ত কেটেকুটে খেয়ে ফেলি না, কিন্তু তার চেয়ে কমই বা কী করি?
১০/১৫ বছর আগেও নাকি এইসব আদিবাসীদের গায়ে এক টুকরো কাপড় ছিল। প্রায় উলঙ্গই ছিল তারা। নারী পুরুষ সবারই নিম্নাঙ্গে সামান্য কাপড় ছিল। ইদানিং তারা সভ্য হয়েছে, তাই কাপড় চোপড় পরে। বাঙালিদের কাছ থেকে আদিবাসীদের নিয়ে এসব কথা শুনতে শুনতে মনে মনে হাসছিলাম। সেই দুর্গম পাহাড়ে নিজের কাপড় নিজে কয় টুকরো বুনা সম্ভব? যারা এসব বলে বেড়ায়, তাদেরকে দুর্গম পাহাড়ে রেখে আসলে দেখা যাবে, দুদিন পরে গাছের পাতা আর ছাল বাকলের উপর তারা নির্ভর করছে। পরিস্থিতির কারণে মানুষকে কত কি-ই না করতে হয়! সুতরাং কে জংলি আর কে সভ্য, এটা শনাক্ত করা এত সহজ নয়।
পাহাড়ে এখনো এমন জায়গা আছে, যেখানে মানুষের কোন পা পড়ে নি। আর রাস্তাগুলোও খুব সরু, দুর্গম। পাহাড়িরা চলার সময়ে হাতে একটা ধারালো দা রাখে। নারী পুরুষ সবাই। চলতি পথে গাছ কেটে কেটে চলার পথ তৈরি করতে করতে তারা হাঁটে। এবং তাদের জুমচাষের জমিগুলো দেখলেও অবাক হতে হয়। কোন রাস্তা নেই, কিছু নেই, খাড়া পাহাড়ে সারিবদ্ধ ভাবে ধান, আনারস, কলাগাছ ইত্যাদি হয়ে আছে। এমন খাড়া জায়গায় এত সুন্দর করে লাইন ধরে ফসল বুনলোই বা কিভাবে আর সেই ফসল তুলে আনেই বা কিভাবে। অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ। বাঁশের টুকরিগুলোতে কেজি কেজি জিনিসপত্র পাহাড়িরা অদ্ভুত কায়দায় বহন করে। সামান্য এক টুকরো কাপড় দিয়ে সেই টুকরিগুলো কপাল আর মাথায় বেঁধে এমন ভারসাম্য করে পাহাড়িরা চলে। অনেক বৃদ্ধ পাহাড়িকে দেখেছি অনেক জিনিস নিয়ে এভাবেই হেঁটে যেতে। মায়েরা শিশুদেরকেও সামান্য একটা কাপড় দিয়েই পিঠে বেঁধে রেখে ঘুরে বেড়ায়, কাজ করে।
পাহাড়ে অনেক রকম আদিবাসীর বাস। তাদের পোশাক গয়না চেহারা দেখে, ভাষা শুনে আমাদের কাছে সব প্রায় এক রকম মনে হতে পারে। কিন্তু প্রত্যেক জাতির আলাদা ভাষা, পোশাক, গয়না, ভাষা। হঠাৎ দেখা গেল, বব কাট চুলে সুন্দর সাদা কাপড়ের মোটা ব্যান্ড মাথায় কয়েকজন বয়স্ক নারী! বেশ স্টাইলিশ আর স্মার্ট দেখাচ্ছিল তাদের মাথার ব্যান্ডগুলো। জানা গেল, এরা সব বিধবা, তাই মাথায় অমন সাদা কাপড়ের ব্যান্ড। বয়স্ক প্রায় সব নারীর কানে অদ্ভুত দুল দেখা গেল। এই দুলগুলো পরতে হলে কানের ছিদ্রের ব্যাসও কমপক্ষে আধা ইঞ্চি হওয়া লাগে। ওদের কানের ছিদ্রগুলো দেখে ভয়ই লাগছিল। একেবারেই আদিম একটা ব্যাপার। কানের এই বিশেষ গয়নাগুলো সব রূপার এবং খুব দামী, এমনই শুনলাম। ত্রিপুরা নারীদের নিজের হাতে তৈরি করা পুঁতির মালাগুলোর নকশা দেখে মুগ্ধ হতেই হবে। আদিবাসী তরুণীরা বাইরে বেড়াতে গেলে মুখে চন্দনের প্রলেপ মেখে নেয়। আমরা যেমন সানস্ক্রিন মাখি, তেমনি ওদের মুখে থাকে চন্দনের সাদা প্রলেপ।
পাহাড়িদের জীবন যাত্রায় এখন সামান্য কিছু আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। তারা মোবাইল ব্যবহার করছে, অনেকেই বাংলা জানে। তবে পাহাড়ের ভেতরের জীবন এখনো আদিম। আদিম মানুষের মতই তারা সরল, পরিশ্রমী, লাজুক। তবে ইদানীং বাঙালিদের সংস্পর্শে এসে বিটলামি শিখছে, ব্যবসা শিখছে, টাকা চিনছে। যুগ যুগ ধরে এই পাহাড়ে তাদের বাস। এখানে হঠাৎ করে বাঙালিদের আগমন, বসবাস শুরু করা, দখলদারিত্ব পাহাড়িরা স্বাভাবিক কারণেই মেনে নিতে পারে না। স্বার্থে আঘাত লাগলে আদিম মানুষের মত হিংস্র বন্য তারাও হতে পারে। মনে মনে আবার হাসি, কে জংলি আর কে সভ্য তা শনাক্ত করা কি এতই সহজ?
লেখক: লেখক ও শিক্ষক