মুক্তিযুদ্ধে নারী, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির দায়

প্রকাশ | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ২১:৫৩

'মুক্তিযুদ্ধে নারী' - এই শব্দ দুটো বললে সকলের চোখের সামনে কি ভেসে ওঠে? সকল বাঙালীর চোখের সামনে?

আমার ভাসে ওরা এগারজন সিনেমার একটা দৃশ্য। শেষ দৃশ্য সম্ভবত। মুক্তিযোদ্ধারা বের হয়ে আসছেন, অস্ত্র উঁচিয়ে উল্লাস করছেন। খানিকবাদে বের হয়ে আসছেন অভিনেত্রী নূতন। আলুথালু শাড়ি, উস্কখুস্ক চুল। খসরুর কোলে শুয়ে অতি কষ্টে একটা হাসি দিয়ে ধর্ষিতা নূতন মারা যান। আরেকটা ছবি ভাসে। একটা লেখারে ভিজুয়ালাইজ করি আমি। তসলিমা নাসরীনের লেখা।

"মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমার মামা যখন ফিরে এলেন আমরা গর্ব করলাম আর আমার খালা যখন নির্যাতিত হয়ে ফিরে এলেন আমার পরিবারের সবাই ভীষন অসন্তুষ্ট হলো। তার এই ফিরে আসা চায়নি কেউ।"

এরকম অসংখ্য চিত্রকল্প আমার চোখে ভাসে। আমার টকশো তে মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবীর আর চলচ্চিত্র নির্মাতা শবনম ফেরদৌসী অংশ নিয়েছিলেন ১৬ই ডিসেম্বর। তারা দুজনেই বললেন, "এরকম কত নারীকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসে বাবা বা ভাই বলে গেছে, কাল তোকে নিয়ে যাবো। আর কোনদিন তারা আসেনি। পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্র তাদের নেয়নি"।

সেই ছোটবেলা থেকে বই, পত্রিকা, টেলিভিশন এবং সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই লাইনটা শুনে আসছি ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত এবং দুই লক্ষ মা-বোনের 'ইজ্জত' এর বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত যখনই শুনেছি গর্বে মাথা উঁচু হয়েছে জাতির আর যখন '২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত' বিষয়টা আসলেই একটা গলা খাকারি, একটু অস্বস্তি আর সংকোচের অনুভূতি হয়েছে ছোটবেলা থেকে। কেন হয়েছে? বীরাঙ্গনা বা ৭১ এ ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কেউ যে তাদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তা তো নয়। তবু কেন হয়েছে এই অনুভূতি? আমারই? অথবা আমার মতো আরও অনেকের? 

ধর্ষণ কেন হয় যুদ্ধে? যুদ্ধের একটা হাতিয়ার হলো ধর্ষণ। অস্ত্রের মতোই একটা হাতিয়ার। কি জান্তব উল্লাসে, কি মর্ষকামে, কি ক্ষমতার প্রয়োগ দেখানোর হাতিয়ার হিসেবে এদেশের নানান বয়সী নারীকে একাত্তরে ধর্ষণ করেছিল পাকিস্তানীরা, সাচ্চা মুসলমানের বীজ এদেশে পুঁতার ইচ্ছা যে পোষণ করেছিল তারা সেসব বিস্তারিত না বলি। কিন্তু সে তো পাকিস্তানীরা করেছিল। কিন্তু আমরা কি করলাম? ধর্ষিতার বাবা-ভাই-খালু-চাচা-মামা-স্বামী? সমাজ? রাষ্ট্র? আমরা নিয়েছিলাম তাদের? গ্রহণ করেছিলাম? মানসিক ট্রমা আর শারীরিক বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে তাদের বের করে আনার কোন চেষ্টা কয়টা পরিবার করেছিল? কাবেরী গায়েন তার মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে নারী নির্মাণ বইটিতে স্পষ্ট লিখেছেন, 'যুদ্ধকালীন নির্যাতনের দৈহিক স্বাক্ষর পুরুষকে বীর যোদ্ধার মর্যাদা দিয়েছে, লিখিত ইতিহাসে সেই যুদ্ধকালীন নির্যাতনের দৈহিক স্বাক্ষরকে নারীর 'সম্ভ্রমহানি' হিসেবে দেখা হয়েছে'।

এই দেখাটা কারা দেখিয়েছে? জ্বী, মহান গণমাধ্যম এবং সরকারী নানান হাতিয়ার। কখনও সাহিত্যও। আমাদের জনপ্রিয় সাহিত্যগুলোয় ধর্ষণকে রগরগে করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ এর বইগুলোর কথা মনে করুন। ১৯৭১ নামের তার একটা বইয়ের কথা মনে পড়ছে। একটা মেয়েকে রেইপ করার পর পাকি সৈন্যের মনোভাব তিনি লিখেছেন এভাবে, 'এতো সুন্দর মেয়ে শুধু কাশ্মীরেই দেখেছে সে'। অথবা সৈয়দ হকের খেলারাম খেলে যা। ধর্ষণ যে একটা ভয়ংকর রকম অপরাধ, এতে যে একজন মানুষের অব্যাখ্যেয় শারীরিক মানসিক যন্ত্রণা হয়, সেই চিৎকার আমাদের পপুলার লিটারেচারে সেভাবে উঠে আসেনি। আমরা মুক্তিযুদ্ধে নারীকে বীর অবয়বে দেখতে পছন্দ করিনি, ট্রাকে ট্রাকে ঘুরে তাদের টানটান গ্রীবা আর দীপ্ত কণ্ঠস্বরের গণসংগীতের কথা বলতে পছন্দ করিনি, তারামন বিবি বা কাঁকনবিবির কথা শুনতে পছন্দ করিনি, রোকেয়া কবীরদের মার্চপাস্ট পছন্দ করিনি বদলে নারীকে 'নির্যাতিতা' 'লাঞ্চিতা' 'সম্ভ্রমহারা' এভাবে দেখে এবং দেখিয়ে সুখী হয়েছি। 

পয়তাল্লিশ বছর ধরে তো চলল এরকম। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো আর কতদিন? এবার তো পাল্টানো উচিত দৃষ্টিভঙ্গি। গতবছর বীরাঙ্গনা নয়, নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সরকারী ঘোষণা এসেছে। শবনম ফেরদৌসী বলছিলেন, "এতে আর সেইসব নারীদের এখন কিছু আসে যায় না। অনেক বছর পার হয়ে গেছে।"
 
সত্যি। তাদের হয়তো কিছু আসে যায় না। কিন্তু জাতি হিসেবে নিজেদের বীরদের চিহ্নিত করতে না পারা আর স্বীকৃতি না দেয়ার অপরাধে আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো উচিত। যে 'ইজ্জ্বত' নারীর শরীরে থাকে, সেই 'ইজ্জত' এইবার প্রকৃতপক্ষেই অসংকোচে এবং অবহেলায় ফেলে দেয়ার, ধুলায় মিশিয়ে দেয়ার সময় এসেছে। এই যে 'মা-বোনের ইজ্জত' 'মা-বোনের ইজ্জত' বলে এতোগুলো বছর পার করলাম, এই 'মা-বোন' বিষয়টা কি? কারো মা বা বোন না হওয়া সত্ত্বেও যে নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন তার অবস্থান তাহলে কি? অবশ্য মা-বোন হয়েই যখন বীরের মর্যাদা পায়নি নারীরা, তখন যারা মা বা বোন নন তারা কোথায় কিভাবে হারিয়ে গেছেন সে খবর রাখার প্রশ্নই ওঠে না।
 
এখন আর ধর্ষিতা নারীদের কোন যায় আসে না হয়তো কিন্তু এই দেশ যে নারীদের 'মানুষ' হিসেবেই দেখে, নারীর উপর নির্যাতনকে নির্যাতন হিসেবেই দেখে, এর সাথে ইজ্জত হারানো বা লজ্জ্বার কোন বিষয় নেই সে হিসেবে দেখে, সেটা প্রমাণ করার দায় অবশ্যই এখন এই রাষ্ট্রের। সে দায় রাষ্ট্রকে মেটাতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক