কোন অপশক্তি ঐশীর কাঁধে ভর করেছিল
প্রকাশ | ০৪ জুন ২০১৬, ২৩:৩৮ | আপডেট: ০৪ জুন ২০১৬, ২৩:৫১
ঐশী নামটি একটি পবিত্র নাম। পিতামাতার অনেক আদর ও আকাঙ্ক্ষার ধন হিসেবে ঐশী তাদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিল। এই ঐশীর বিরুদ্ধেই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহতম লোমহর্ষক এবং নিষ্ঠুরতম অভিযোগ আসে, বাবা মাকে একসাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যার। এই রকম একটি অভিযোগ একটি নির্মম নিষ্ঠুরতম অভিযোগ। বাড়িতে আর ছিল একটি পনের বছরের কাজের মেয়ে। আর তার ঘুমন্ত ভাই ঐহী।
ঘটনার পেছনে অনেক ঘটনা থাকতে পারে যা আমরা খুঁজে দেখতে চাই না বা আমাদের চিন্তা চেতনা সেইসব দিকে ধাবিত হবার আগেই একের পর এক ঘটনা আমাদের চিন্তার জগতকে সামাজিক ত্রাসের ভয়াবহতার আচ্ছন্নতায় নিস্তেজ নেশাগ্রস্ত অবস্থার মধ্যে টেনে টেনে আরেকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখে। এটা আমাদের সমাজ এবং রাজনৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র। নানা রকম ঘটনা দুর্ঘটনার নেশার ঘোরের পিছনে মনোযোগ কেড়ে নিয়ে কিছুতেই চিন্তা করার শক্তিকে স্থির হতে দিচ্ছে না।
বিজ্ঞ আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান এবং আস্থা রেখেই বলছি স্বাভাবিকভাবে কোনো সন্তান তার বাবা মাকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করতে পারে না। যেখানে আমরা মাতৃভক্তির ইতিহাস জানি। সেখানে ঐশী বা অন্য যে কোনো কেউ ঠান্ডা মাথায় একসাথে বাবা মা দুজনকে হত্যা করতে পারে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু সকল অতীত ধারনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে এই মেয়েটির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়। বিজ্ঞ আদালত তাকে ডাবল হত্যার জন্য ফাঁসি দেওয়ার আদেশ দেয়। এটা যেন মেনে নেওয়া যায় না।
নারী শিশুটি কোনো গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়নি তো? যেমন তনুকে হত্যা করার পরে এখনো আমরা প্রকৃত সুরতহালের রিপোর্ট পাই না। যা দেখেছি তা তনুর বাবা মেনে নিতে পারেনি। তনুর বাবা জীবিত বলে মিথ্যার বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করতে পারছেন কিন্তু ঐশীর বাবা মা দুজনই নেই।
মধ্যযুগে এইরকম একটি ঘটনা ঘটলে মানুষ ধারনা করতো ঐশীর মত যুবতীর উপর শয়তান, অপদেবতা বা অপশক্তি আশ্রয় করেছে যে কারণে বাবা মা দুজনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। সেই সময়ের মানুষ ধারনা করতো সেই অপশক্তি দুষ্কর্মটি করেছে, ঐশী সজ্ঞানে করেনি।
আধুনিক যুগে আমরা অপশক্তির কথা ভাবতে পারি না সত্য, কিন্তু অতীতের সেই এক ধরনের অপশক্তিগত চিন্তা দূর হলেও অপশক্তি তার রূপ বদলে আর এক অপশক্তিরূপে যুবশক্তি ধ্বংসের মিছিলে নেমেছে। শুধু তাই নয় এই অপশক্তিগুলি প্রতিটি শিশুর সম্ভাবনাময় শৈশবের ভিতরে ঘুণপোকার মত বাসা বাঁধে তারপর ভয়াবহ দৈত্যের মত তাদেরকে দিয়ে যা করাতে চায় তাই করিয়ে নেয়। এই ভয়াবহ অপশক্তিগুলো মানুষের স্বাভাবিক চেতনাকে বিনষ্ট করে দেয়। সেই অপশক্তি আর কিছু নয় একটি হল নেশা, মানুষের বড়লোক হবার লোভ, আর রাজনৈতিক হঠকারিতা।
প্রযুক্তিকে অবলম্বন করে মানব সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে। আবার এই প্রযুক্তি, মাদকদ্রব্য এবং ড্রাগ ব্যবহার করেই বদলে যাচ্ছে মানুষের মানসিক জগত, পারিবারিক, সামাজিক, নৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধ। এর অসহায় শিকার হচ্ছে নারী এবং শিশু বিশেষ করে কন্যাশিশু। এরই ফলশ্রুতিতে অসংখ্য নারীকে হয় ধর্ষণ করে হত্যা করা হচ্ছে আর না হয় আত্মহত্যায় বাধ্য করা হচ্ছে। মাদকদ্রব্যের ব্যবহার এর একটি অন্যতম কারণ। মাদকদ্রব্য এবং ড্রাগের প্রতি নেশাই সেই মনস্টার বা দৈত্য।
এরপর আছে পরিবারের কর্তার অথবা যে কোনো মানুষের কর্মের ধরণ। একজন মানুষের পেশাগত জীবনের উপরে তার ব্যক্তিত্ব তার অস্তিত্বের মূল শিকড় গড়ে ওঠে এবং অন্যান্য মানুষের সাথে তার সামাজিক দায়দায়িত্ব এবং কর্মের একটি আওতাভুক্ত বিষয় তৈরি হয়। যে বিষয়গুলির প্রভাব তার ব্যক্তিজীবন এবং পারিবারিক জীবনের উপর একধরনের ভাল বা মন্দের বা সংকট সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ঐশীর বাবা মাহফুজুর রহমান পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (পলিটিক্যাল) কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি শুধু ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকেননি। একজন সৎ এবং আদর্শবান পুলিশ অফিসার হিসেবে তিনি দেশের জন্য দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত ছিলেন। সব পুলিশ অফিসারকে অর্থ ঘুষ অথবা ভাল পোস্টিং এর বিনিময়ে কেনা যায় না। তাকে দেশের বিভিন্ন অপরাধের বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়েছে। যে দেশে শিশুখাদ্য তরল দুধ বানানো হয় শ্যাম্পু এবং কেমিকেলের বিনিময়ে সেই দেশে পুলিশের কতটা তৃণমূল বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখার কথা তা তো সৎ পুলিশ অফিসাররাই জানেন। যেহেতু ঐশীর বাবা একজন সৎ পুলিশ অফিসার, তাকে কোনো মতেই ঘুষ বা দুর্নীতির জালের মধ্যে ঢোকানো যায়নি তাই কি অপরাধী চক্র বা এই উল্লেখিত দৈত্যরাই ঐশীর কাঁধে চেপে স্বামী স্ত্রী দুজনকে হত্যা করে ঐশীর গায়ে দোষ চাপিয়ে দিয়েছে?
ঐশীর বিষয়ে এ ভাবনা নারী হিসেবে, মা হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, আমার নির্দোষ সংবেদনশীলতা। যেহেতু ঐশী একটি আঠারো বছরের কন্যা শিশু, বাবা মায়ের অসম্ভব আদরে লালিত বাইরের জগতের বিষয়ে অনভিজ্ঞ, তাই কাটায় কাটায় আঠারো বছর হলেও সে অপরিণত। কন্যা হিসেবে আরো অপরিণত। তাই ঐশীর এ অপরাধ কর্মের বিষয়টি আমাদের মায়ের মন এবং মানবিকতার দিকটিকে সংবেদনশীল করে তোলে। আমাদের চেতনার ভিত্তিমূলকে নাড়িয়ে দেয়।
ঐশীর বাবা মাহফুজুর রহমান গোয়েন্দা বিভাগের পরিদর্শক (পলিটিক্যাল) ছিলেন। এমনিতেই তিনি গোয়েন্দা তার উপর পলিটিক্যাল। এই জায়গায় কাজ করাটা আসলেই ভীষণ চ্যালেঞ্জিং। তার মেধা, সাহস, সততা এবং আপোষহীন ব্যক্তিত্ব না থাকলে তিনি সাধারণভাবে এখানে আসার সুযোগ পাননি। দুইবার তিনি জাতিসংঘের কাজে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। মেধাবী না হলে এবং নিবেদিত না হলে এই কাজের সুযোগ পেতেন না। এটি তার সততার পরিচয় বহন করে। একটি সংবাদে জেনেছি তিনি সেখান থেকে যে অর্থ উপার্জন করেছেন সেটা ব্যাংকে রেখে সেই টাকা দিয়ে সংসার চালাতেন। পুলিশ অফিসারদের আয় এবং ব্যায়ের কোনো চিন্তা করতে হয় না বলেই গড়পড়তাভাবে আমরা জানি। তবু তিনি সংসার চালাবার জন্য টাকাটা গচ্ছিত রেখেছেন এতে প্রমাণ হয় তিনি খুব মিতব্যায়ী। অর্থ উপার্জনের জন্য একজন পুলিশ অফিসারের কিন্তু একটা ভাল পোস্টিংই যথেষ্ট।
জাতিসংঘে দুইবার যাওয়ার জন্য তার পারিবারিক জীবনে গোপনে সংকট নেমে আসে। কন্যা শিশুটির প্রতি বাবার যে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান প্রয়োজন ছিল তাও বিঘ্নিত হয়। মা একা হয়তো এই বিপর্যয় থেকে ঠেকাতে পারেননি। ইংরেজি মাধ্যমেই নয় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে মাদকের গোপন বাজার থাকে। বন্ধুদের সাথে তারা এ সমস্ত গ্রহণের ফ্যান্টাসিতে জড়িয়ে পড়ে। মাহফুজুর রহমানের উৎসর্গকৃত কর্তব্যজ্ঞান, সততা এবং কাজের টেবিলই তার পারিবারিক এমন প্রশ্নবিদ্ধ ঐশীর ডবল হত্যার দোষারোপের কারণ নয় তো? ঘটনার আড়ালে কোনো ঘটনার অনুসন্ধানী গোয়েন্দাদল আবারো বিষয়টি দেখতে পারে।
খবরে প্রকাশ, ঐশী কিছু লিখতে চায় কিন্তু তাকে লিখতে দেওয়া হচ্ছে না। ছোট ভাইটিকে দেখার জন্য কান্নাকাটি করে, ছোটভাইটির পরীক্ষার কথা বলে তার সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। এতটুকু একটি বাচ্চা মেয়ে কীই বা বোঝে!! আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ালে দোষী নির্দোষী সবার পক্ষেই কথা বলা সম্ভব নয়। দিনের পর দিন একটি মানুষকে জনবিচ্ছিন্ন করে যখন কারাগারে রাখা হয় তখন সেই মানুষটির শারীরিক ও মানসিক শক্তি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার কথা। সেখানে নেশাসক্ত মানসিক ভারসাম্যহীন এই অপরিণত মানসিকভাবে অসুস্থ নারীশিশুটি সত্য বলার মত সুযোগ পেয়েছে কী না তা কি স্থির ভাবে বলা যায়? ঐশী নিজে নিজেকে আত্মসমর্পণ করেছে। যে আত্মসমর্পণ তার আত্মবিশ্বাস ও সততার পরিচয় বহন করে। এত ক্রিমিনাল অনেক অনেক খুন করার পরেও জামিন পেয়ে ঘুরে বেড়ায়, আবার খুন করে, আর ঐশীকে কেউ জামিনে মুক্ত করাতে আসেনি। কারণ বাবা মা দুজনই নেই। যারা তাকে ছাড়াতে আসতো তাদের খুনের দায়ই তার।
আমার বোন সাবিনা শারমিন ছন্দা বাংলাদেশ বিমানের সহকারি ব্যবস্থাপক। সে ঐশীর মা রূপে নিজেকে কল্পনা করে একটি অদ্ভুত মর্মান্তিক বিশ্লেষণধর্মী আর্টিকেল লিখেছিল। বিষয়টি আমার খুব ভাল লেগেছে। আমার একটি বিষয় মনে হয় সেটা হল, এই মেয়েটি যদি হত্যা করে থাকে তাহলে বুঝতে হবে সে মানসিকভাবে অসুস্থ। প্রথমে তার দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা দরকার। তারপর এক সময় সে সুস্থ হলে তাকে বিচারের আওতায় আনা হোক। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই এটা করা যায়।
ঐশীর একটি নাচের ভিডিও দেখলাম। ভিডিওটিতে খারাপ কিছু নেই। কিন্তু কেউ না কেউ এই ভিডিওটুকু রেকর্ড করেছে, সেটা কেন করেছে? বোঝাবার জন্য যে মেয়েটির চরিত্র খারাপ ছিল! যারা মেয়েটির উপরে এরকম দোষারোপের জন্য ভিডিও করেছে তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? খুনের দায়টিকে প্রশ্নাতীত করা?
এমনও তো হতে পারে ঐশী খুন না করে ভাইকে বাঁচানোর জন্য খুনের দায় শিকার করছে। হয়তো এ পরিবারটি কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে ।
আমরা সন্তানকে স্কুলে পাঠাই কিন্তু একশ্রেণির দুর্বৃত্ত এবং ঔষধ কোম্পানিগুলো বেশি লাভের আশায় আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তথা জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি পাঁচটি পরিবারের একটি বা দুটি সন্তান যদি মাদকাসক্ত হয় তাহলে আমাদের জাতির পঙ্গুত্ব বরণে আর দেরি নেই। ইসলামধর্মে মদ নিষিদ্ধ তার কারণ হল এটা মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটায়। কিন্তু এদেশে মাদক দ্রব্যের বিক্রি কি নিয়ন্ত্রিত?
নিষিদ্ধ দ্রব্যের ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা আয় করে একশ্রেণির গডব্রাদার ফাদাররা আর এই অপশক্তি ব্যবহার করে নানারকম রাজনৈতিক ফায়দা লোটে। আমাদের এক একটি পরিবারের অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করেই তারা পুষ্ট হচ্ছে। এইসব অপশক্তিকে রুখে দিতে না পারলে এক ঐশীকে ফাঁসি দিয়ে কোনো লাভ হবে না। আরো কোটি কোটি ঐশী দৈত্যের মত হয়ে উঠবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারাগারে অবস্থানরত মানুষের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করে বলেছেন পাপকে ঘৃণা কর পাপীকে নয়। ঐশী যদি অপশক্তির প্রভাবে এ ঘটনাটি ঘটিয়েই থাকে তাহলে সে মানসিক বিকারগ্রস্ত। তাকে ঘৃণা নয় ঘৃণা করতে হবে মাদককে। যে মাদক ঐশীর বিকৃতি ঘটিয়েছে। বিতারিত বা নির্মূল করতে হবে মাদক এবং এ সমস্ত ড্রাগকে। বিচারের আওতাভুক্ত করতে হবে সেইসব বড় বড় মাদকরাজরূপ অপশক্তিকে যারা ঐশীর মত যুবশক্তির কাঁধে ভর করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করে। ঐশীর মানসিক অসুস্থতা বিবেচনা করে, এতিম শিশু ঐহীর কথা বিবেচনা করে, ঐশীকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করা প্রয়োজন কারণ তার পিতা বাংলাদেশ সরকারের কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল যে দায়িত্বের বিষয় ছিল পলিটিক্যাল। এই কাজের জায়গাটির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই তার একটি সন্তানের জন্য ঐশীর ভালবাসা তার ছোট ভাই ঐহীর প্রয়োজন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা