সীমিত অসাম্প্রদায়িকতা, অপরিমিত সাম্প্রদায়িকতা
প্রকাশ | ১১ নভেম্বর ২০১৬, ২১:২৬
১
উত্তরাঞ্চলে এই সময় শীত পড়ে যায়। ঢাকার গণগণে ইটের বস্তিতে বসে তা অনুভব করা সম্ভব নয়। তার উপর, এই ইটের বস্তির শহরে ইটের ভেতর এসি চালাতে গিয়ে এমনভাবে দরজা জানালা বন্ধ থাকে, তাতে আরও বোঝার উপায় নেই... উত্তরাঞ্চলের মানুষের খোলা আকাশের নীচে নিরাশ্রয় করে দেবার বেদনা!
রাজনীতিবিদ হলে তারা বুঝতো। তারা রাজনীতিবিদ নয়, তারা প্রকৃত অর্থে ‘রাজনীতি’ নামের ব্র্যান্ডের বেনিয়া! বেনিয়া কবে, কখন, নিজের ছাড়া অন্যর দুঃখ বেদনায় কাতর হয়েছে?
লক্ষ্য থাকে শুধু টাকার পাহাড় গড়ার দিকে ... বেনিয়ারা যা করে আরকি!
আমাদের করের টাকায় পুষছি যাদের, তারা কেমন নেমক হারাম! দুর্বৃত্তকে আশ্রয় দিচ্ছে, নিরাশ্রয় করছে সাধারণ জনগণকে!
দুর্বৃত্তায়ন-এর শেষ যেন নেই, এই প্রতিকারহীন বাংলাদেশে! তাই প্রতিদিন নূতন নূতন নির্যাতন-নিপীড়ন-সংবাদে ভারী হচ্ছে কেবল বাংলার আকাশ-বাতাস!
আমি সাঁওতাল বুঝি না! আদিবাসী বুঝি না!...... শুধু এইটুকু বুঝতে চাই, এই শীতের রাত্রিতে মানুষকে নিরাশ্রয় করেছে একদল লোভী মানুষ প্রশাসন-যন্ত্রকে ব্যবহার করে!
কেন?
এই সরল প্রশ্নের জবাব দেয়া কী খুব অসাধ্য?
এই জন্যই কি বাংলাদেশ দ্বিজাতিতত্ত্ব কিংবা দ্বিভাষার বিরোধের জেরে আলাদা হয়ে ছিল? গুটি কয়েক মানুষ লুটেপুটে খাবে বাংলাদেশের ধন-সম্পদ? সেই তো, প্রশাসন-যন্ত্র ব্যবহার করে মানুষ নির্বিচারে হত্যা, সেই তো জ্বালাও, সেই তো পোড়াও, সেই তো ভূমি থেকে উৎখাত...... তাহলে?
আমাদের শহীদ ভাইয়ের রক্তের সাথে এই কী বিশ্বাস ঘাতকতা নয়?
এই রাষ্ট্রীয় পোশাকের নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে কী ‘রাজাকার’-এর মতো লাগছে না?
জানেন তো সবাই, তবুও আবার মনে করিয়ে দেয়ার জন্য বলছি,...... ‘রাজাকার’ একটি আরবি-শব্দ, এর অর্থ, ‘স্বেচ্ছাসেবক’, ‘সাহায্যকারী’ । আগুনে পোড়ানোতে সাহায্য করছে বলেই ওদের ‘রাজাকার’ নামে এই তথাকথিত স্বাধীন দেশে ঘৃণা ভরে ডাকা যায়! মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ‘রাজাকার’রা নিজেদের বড় ভালোবেসে এই মহান নামটি ধারণ করেছিলো ! তখনকার সাহায্যকারী আর ২০১৬-র সাহায্যকারীতে কী তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায়? এই রাষ্ট্রীয় পোশাকের নপুংসকগুলো সাহায্যকারী হলে, ‘রাজাকার’ হলে, এদের মদতদাতা বা হুকুমদাতা কী ‘রাজাকার’ নয়?
চেতনাজীবীরা নিশ্চয়ই আরও ভালো বলতে পারবেন!
আমরা এইসব ‘রাজাকার’ মুক্ত বাংলাদেশ চাই।
বিচারের আওতায় আনা হোক এইসব ‘রাজাকার’দের।
২
ধরুন, আপনি হাঁটছেন এই বিশ্বাসে, যে সবুজ ঘাসের উপর দিয়েই হাঁটছেন, হঠাৎ নীচে তাকিয়ে দেখলেন, আসলে ওইটি সবুজ ঘাস নয়, সবুজ সাপ... আজ সকালে ইনবক্সে একটি এসএমএস... আমার এই বোধের উন্মেষ ঘটিয়েছে বলেই সেই সাম্প্রদায়িক শক্তির এসএমএস-এর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
‘আমি মালাউন’ প্রোফাইল পিকচারে এড করেছিলাম একটি তীব্র প্রতিবাদ হিসেবে পশু মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। তিনি আমাদেরই করের টাকায় বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে আমাদের জনগণকে ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলে অপরাধমূলক গালি দিতে পারেন না। ‘মালাউন’ একটি আরবি ভাষার শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে, ‘অভিশপ্ত’। বাংলাদেশ সরকারের বিচিত্র বিন্যাসে এই অভিশপ্ততার দীর্ঘশ্বাস পাওয়া যায় এর জন্ম-লগ্ন থেকেই।
চিন্তনে, মননে, যুক্তিতে, বিশ্বাসে, ভালোবাসায় কোথাও সাম্প্রদায়িকতাকে বিশ্বাস করি না। একজন সভ্য-যুক্তিবাদী-আধুনিক মানুষ মানেই ‘সর্বমানবতাবাদ’-এ বিশ্বাসী একজন মানুষ। ধর্ম, গোষ্ঠী এইসব ব্যক্তিক আচারে সীমিত থাকাই সভ্যতা। যেমন অঞ্চল বিভাজনে একটি স্থানিক প্রশাসন চালাতে সহজ হয়, তেমনি। কিন্তু, যখন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা-চাহিদাকে একটি ধর্ম বা গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তখন সেখানে ধর্ম থাকে না। ব্যবসায়িক কূটকৌশল এসে দখল করে নেয় সেই স্থান। সেই ব্যবসায়িক কূটকৌশলের হাতিয়ার হতে আমি কখনই রাজি নই। আমি বা আমার চিন্তনের মূল্য এতো সহজ নয়। তা কখনই ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য কোন পণ্য নয়!
আমার আমিকে, আমার অহমকে আমি কারো হাতের পুতুল হতে দেবো না কিছুতেই!
এই ক’দিন থেকেই দেখছি, বেড়ে গেছে বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের আস্ফালন ফেসবুকে। আমার তখন মনে হতে থাকলো, আমাদের এই প্রোফাইল চেঞ্জ কী কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে উল্টো গাইতে ইন্ধন দিচ্ছে? আজকের সকালের ইনবক্স তা আমার কাছে স্পষ্ট করে দিলো। ব্যক্তি-বিশেষ কোন উগ্রবাদ নিশ্চয়ই সমর্থন যোগ্য নয়।
অন্যায় যেখানে, সেখানে অন্যায়ের প্রতিবাদ থাকবে। তীব্র প্রতিবাদ থাকবে। কিন্তু এই প্রতিবাদের ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে ফায়দা লোটায় ইন্ধন হতে ‘মানবতাবাদ’ রাজি নয় কোন মতেই।
সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ আজ যে বিপদ সঙ্কুল পথে হাঁটছে, সেখানে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের নিশানা মুছে, এক সাম্প্রদায়িক ভঙ্গুর বাংলাদেশ পেতে যাচ্ছি আমরা। সেই অশুভ পদধ্বনিই যেন চারদিকে শোনা যাচ্ছে!
ছয় দফার ভিত্তিতে যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো, সেই বাংলাদেশ আমরা ফেরত যেন পাই, কায়মনো-বাক্যে এই শুভ কামনা আমাদের দুখিনী বাংলাদেশের জন্য, এই মুহূর্তে!
লেখক: আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট