দাসখতটা ছিঁড়ে ফেলুন
প্রকাশ | ১১ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:৪১
(১)
আমার তিন ভাই পুলিশের গুলিতে মরেছে। রমেশ সরেন, শ্যামল হেমব্রম আর মঙ্গল মার্ডি। ওদের অপরাধ ছিল ওরা ওদের বাড়িঘর ছেড়ে পথে নামতে চায়নি। পুলিশ ওদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আগুণের অপূর্ব মোহনিয় আভা যখন ওদের বাঁশ কাঠ দিয়ে তৈরি তুচ্ছ কুঁড়েঘরগুলি আলোতে উজ্জ্বল করে তুলছিল সেসময় পুলিশ ওদের দিকে গুলি ছুঁড়েছে। টিয়ার গ্যাস নয়, লাঠি নয়, সাউন্ড গ্রেনেড নয় এমনকি পিপার স্প্রেও নয়, গুলি।
গুলি। তামার কিংবা শক্ত প্লাস্টিকের ও ধাতুর তৈরি খোলসের ভেতরে বারুদ, তার সামনে সীসার টুকরা। এই বারুদ ভরা খোলসের পেছন দিকে বৃত্তাকার ছোট একটা জায়গা একটু আলগা থাকে। রাইফেলের ট্রিগার চাপলে একটা পিন এসে সেই আলগা জায়গাটায় আঘাত করে আর সেই আলগা অংশটা ভেঙে ভিতরে রাখা বারুদে আঘাত করে। এই আঘাতে বারুদ বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের ধাক্কায় বারুদের সামনে রাখা সীসার টুকরাটা তীব্র গতিতে ছুটে যায় রাইফেলের নল ধরে সামনের দিকে। কিছু কিছু গুলি থাকে যেগুলিতে সীসার টুকরাটা থাকে না বা ধাতুর টুকরা থাকলেও সেগুলি মানুষ হত্যার মত না। আমার ভাইদের দিকে পুলিশ যেসব গুলি ছুড়েছে সেগুলি মানুষ মারার জন্যেই তৈরি করা গুলি।
পুলিশ ওদেরকে হত্যা করার জন্যেই গুলি করেছে। পুলিশ গুলি করেছে বললে সম্পূর্ণ সত্যিটা বলা হয় না। এই রাষ্ট্র আমার ভাইকে হত্যা করার জন্যে গুলি করেছে।
(২)
কেন গুলি করেছে? জমি খালি করার জন্য। এই জমি নাকি কোন এক সময় সরকার অ্যাকোয়ার করেছিল চিনিকলকে দেওয়া জন্য। কবে অ্যাকোয়ার করেছিল? আমার জন্মেরও আগে। এই যে তিনজনের নাম বলেছি উপরে, যখন এই জমি অ্যাকোয়ার করা হয়েছিল তখন এই তিনজনের কারোই জন্ম হয়নি। কাগজে কলমে অ্যাকোয়ার হয়তো হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কোনসময়ই এইসব জমি চিনিকলের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। এইসব জমিতে এরা বাস করছিল নিরবচ্ছিন্নভাবে।
এইটাই কি আমার রাষ্ট্র? কোন বিকল্প ভাবনা চিন্তা না করেই একদল মানুষকে গৃহহীন করবে এইটা আমার রাষ্ট্র? ভিটা থেকে সরতে না চাইলে মানুষকে গুলি করে মারবে এটাই আমার রাষ্ট্র?
দেখেন, পেশায় আইনজীবী বলে আমাকে সংবিধান পাঠ করতে হয়। সংবিধান থেকে একাধিক বিধান তুলে আমি আপনাকে দেখাতে পারি যে আমাদের সরকার আমাদের সংবিধানের যে মৌলিক রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিমালা তার উল্টাদিকে হাঁটছে। কিন্তু এটা তো ভাই কেবল আইন কানুনের বিষয় না। রাষ্ট্র তো কেবল কানুনদ্বারা নিগমিত একটা কর্পোরেট এন্টিটি না। রাষ্ট্র হচ্ছে জনগণের একটা রাজনৈতিক সমিতি- একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। পুলিশের হাতে আইনের বই ধরিয়ে দিলাম আর সেই অনুযায়ী রাষ্ট্র চলবে সে তো হতে পারে না।
(৩)
এই কথা আপনি কাকে বলবেন? যারা সরকার গঠন করেছে ওদেরকে বলবেন? ওরা শুনবে না। কেন শুনবে না? কারণ আপনি এই সরকারকে ফেলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। ক্ষমতার কেন্দ্রে যদি ঝাঁকিই দিতে না পারলেন তাহলে আপনি কে? একটা কাকের সাথে আপনার কি পার্থক্য? কিংবা সেই শেয়ালটার সাথে যে এখনো এই ডিজিটাল নগরীতে বাস করেও কবরস্থান থেকে মাঝরাতে হুক্কা হুয়া বলে চিৎকার করে। আপনি চিৎকার করবেন? চ্যাঁচামেচি করবেন? করেন, করতে থাকেন। ঐ শেয়ালের সাথে আপনার পার্থক্য কি? সে চেঁচায় কবরস্থানে আর আপনি চেঁচান টেলিভিশনে বা শাহবাগে। এই তো।
যারা সরকারে আছেন ওরা আপনার কথা শুনবে না। কেননা আপনি ওদের কাছে ঈমান বন্ধক রেখেছেন। কখন শুনবে জানেন? আপনি যখন একশজন বা হাজার জনের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে লক্ষ মানুষের জমায়েত করতে পারবেন। লক্ষ মানুষ যখন একত্রে বলবে যে, হিন্দুদের উপর অত্যাচার করা অন্যায়, তখন দেখবেন সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে পুলিশ কিভাবে পিটায়। যখন লক্ষ মানুষ একত্রে বলবে যে সাঁওতালদের বাসস্থানের অধিকার রুটি রুজির অধিকার খর্ব করা যাবে না, তখন দেখবেন পুলিশ আর রমেশ, শ্যামল, মঙ্গলকে গুলি করবে না।
কিন্তু লক্ষ মানুষ একত্রে হব কি করে? সরকার অন্যায় করলে আপনারা চুপ করে থাকেন। আমরা যখন প্রতিবাদ করি তখন উল্টা আমাদেরকে ভয় দেখান- জামাত চলে আসবে পাওয়ারে। ও ভাই, এই জুজুর ভয় আর কত দেখাবেন? এই জুজুর ভয় দেখিয়ে ইলেকশন সিস্টেমটা বরবাদ করে দিয়েছেন। এই জুজুর ভয় দেখিয়ে যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছেন। আর কত? সবকিছুরই তো একটা মাত্রা আছে আর কি।
(৪)
বুদ্ধিমান লোক গজিয়েছে। বলে কিনা 'আওয়ামী লীগকে ডিস্টার্ব করা যাবে না', 'শেখ হাসিনার বিকল্প নাই' ইত্যাদি। ভাইজান, আপনার মনে যদি এটাই থাকে যে শেখ হাসিনাকে অনন্তকাল ক্ষমতায় রাখার মধ্যেই দেশ ও জাতির মুক্তি নিহিত তাহলে উনার দলেই যোগ দেন। এইরকম বাম সাজার ভণ্ডামি করেন কেন? আওয়ামী লীগকে ডিস্টার্ব করবো না তো কি গণফোরামকে ডিস্টার্ব করবো? নাকি সাম্যবাদী দলকে? ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ আমার ভাইকে হত্যা করছে আওয়ামী লীগ, হিন্দু পিটাচ্ছে আওয়ামী লীগ আর আমি গিয়ে বি চৌধুরীর দরজা ভাঙবো?
শোনেন, শেখ হাসিনার বিকল্প অনেক আছেন। আপনাদের মধ্যেই আছেন। সেটা নিয়ে সমস্যা নাই। আর যদি শেখ হাসিনার বিকল্প না খুঁজতে চান, তাতেও অসুবিধা নাই। অন্তত উনাকে এই বার্তাটা দেন যে আপনি যে কোন অবস্থায় আওয়ামী লীগকে সমর্থন করার লিস্টি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এখন তো শেখ হাসিনা মনে করেন যে বাংলাদেশের সকল সেক্যুলার বাম বা লিবারেল মানুষ শেষ বিচারে তাকেই ভোট দিবে। এখন তিনি ভাবছেন, এদের ভোট তো পেয়েই বসে আছি এবার একটু ধার্মিকদের ভোট জোগাড়ের চেষ্টা করি। এই ভেবে তিনি মদিনা সনদ নিয়ে বসেছেন।
আপনারা একটু এক হন মেহেরবানী করে। সিপিবি তো আছেই মাঠে। বাসদও আছে। বাকিরা চৌদ্দ দলে ঢুকেছে সেখানেই থাকুন। কিন্তু এই যে সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কর্মীরা আছেন, ছাত্র ফ্রন্ট বা মৈত্রী করতেন একসময়, এখন কোন রাজনীতি করেন না কিন্তু শেখ হাসিনার কোলে আটকে আছেন, আপনারা একটু নামেন। এছাড়াও অনেক বাম লিবারেল সেক্যুলার ব্যক্তি আছেন প্রতিষ্ঠান আছেন। রেডিক্যাল চিন্তা করেন, নাস্তিকরা আছেন, নারীবাদীরা আছেন। সকলে একটু একসাথে হওয়ার চেষ্টা করেন। এক সাথে বলেন। লক্ষ মানুষ একসাথে কানাঘুষা করলেও তার অনেক শক্তি।
(৫)
একসাথে হয়ে কি করবেন? সরকারকে ফেলে দেবেন? নিজেরা নির্বাচনে জিতে আসবেন? সরকার গঠন করবেন? ওয়েল, সেটাও অসম্ভব কিছু না। কিন্তু সে তো দূরের বাদ্য। আপাতত জরুরী কাজটা হচ্ছে জমায়েত হওয়া।
জমায়েত হলে কি হবে? চট করে বিপ্লব হয়ে যাবে না। কিন্তু জমায়েত বড় হলে অন্যরা বার্তাটা পাবে। আমরা যদি বিশাল জমায়েত করে বলতে পারি যে হিন্দুদেরকে অত্যাচার করা চলবে না, সাঁওতালদেরকে গুলি করে মারা চলবে না, নারীর উপর অত্যাচার বন্ধ করতে হবে, শিশুদের উপর অত্যাচার বন্ধ করতে হবে, সেক্যুলার মুক্তচিন্তার জন্যে মানুষকে হয়রানি করা অন্যায়, সমপ্রেমের অধিকার মানুষের একটি জন্মগত অধিকার তাহলে দেখবেন যে আওয়ামী লীগ তো আওয়ামী লীগ, বিএনপিও এসে বলবে হ্যাঁ আপনাদের কথা ঠিক।
ভয় পাবেন না। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে আপনাকে যেতে হবে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির কোন ক্ষতিও হবে না। আপনাকে যদি এখনো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তির ভয়ে থাকতে হয় তাহলে তো অসুবিধা আর কি। এখন তো সময় হয়েছে যে আমাদের সরকারী দলও থাকবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর বিরোধী দলও থাকবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেরই শক্তি। আর যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকলকে আওয়ামী লীগের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলতে চান, তাহলে আওয়ামী লীগও ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে কাজকর্ম শুরু করবে।
(৬)
দাসখত কি জিনিস জানেন তো? দাসত্বের দলিলে স্বাক্ষর করে দেওয়া। মেহেরবানী করে দাসখতটা ছিঁড়ে ফেলুন। নিজের মেরুদণ্ডটা যে আছে সেটা একটু স্মরণ করেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলেন- সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা না। স্পষ্ট করে বলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে কাজ করবেন- সাম্প্রদায়িকতা করবেন আর আদিবাসীদেরকে মারবেন তাহলে আপনাকে আমি আর সমর্থন করবো না।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্যই তো আওয়ামী লীগের প্রতি আপনার এতো মুহব্বত? সেটাই যদি ওর না থাকে তাহলে আর কিসের মুহব্বত রে ভাই?
লেখক: আইনজীবী