ট্রাম্প নন, নন হিলারি, মেলেনিয়াই খিলাড়ি!
প্রকাশ | ১০ নভেম্বর ২০১৬, ১৯:১৭
ফার্স্ট লেডি হলে নগ্ন হয়ে স্ট্রিপ টিজ নাচবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন সদ্য আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্ত্রী মেলেনিয়া ট্রাম্প। সেই নাচের এখন কি খবর তা ঠিক জানি না, তবে স্বল্পবুদ্ধির অল্প রাজনৈতিক জ্ঞানের মাথায় এটুকু বুঝতে পারি- নারীর শরীর অনেকসময় ট্রাম্পকার্ডের মতন ব্যবহার হয়। শরীর দেখানো বা প্রদর্শন করাটা মোটেই কোনো অপরাধ না, শরীর প্রদর্শন ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ ততক্ষণ যতক্ষণ শরীরটি একটি মানব শরীর। যে শরীরটির আলাদা পরিচয়, স্বকীয়তা আছে। তবে আপত্তিটা তখনই যখন মধ্যযুগীয় কায়দায় দাসী হয়ে নিজেকে বিক্রি করা যাচ্ছে না বলে নিজের শরীরটিকে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে তুলে দেওয়া হচ্ছে! কেউ সেই শরীর দেখে মনে মনে ধর্ষণ করুক, লেহন করুক, স্বপ্নদোষ ঘটাক তা কেউ নাইই বা জানুক, নিজের শরীরটিকে অপমান করার মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ নারীকে অপমান করার অধিকার কারোর নেই।
মেলেনিয়া ট্রাম্প ঠিক সেটিই করেছেন। সারা পৃথিবী যখন নারীর অধিকার, নারী পুরুষ সমতার ব্যাপারে খানিক হলেও সোচ্চার, তখন পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ধারক ও বাহক হিসেবে নিজের শরীরটি নিয়ে, পণ্যের পসরার মতন শরীরের পরিচয় নিয়ে বারবার প্রেসিডেন্টের ভাবী স্ত্রী নাম্নী শারীরিক পণ্য হয়ে উঠছেন মেলেনিয়া।
মেলেনিয়া ন্যুড মডেল ছিলেন, দারুণ সেক্সি বা স্টাইলিশ এগুলি ব্যাপার নয়। ন্যুড মডেল হওয়াও অপরাধ না। কারণ নেশাগত ও পেশাগত কারণে ন্যুডিজম ঘরানার প্রতি আমার আগ্রহ মাত্রাধিক। যেহেতু ফাইন আর্টের ছাত্রী, কাজেই অমৃতা শেরগিল থেকে শুরু করে রেম্ব্রান্ট...সকলের ন্যুড আর্টের প্রতিই আমার অসীম আগ্রহ ব্যক্তিগতভাবে। কিন্তু যখন একজন নারী তার শরীরটিকে পণ্যের মতন মোড়কে ভরে বা মোড়কহীনভাবে মঞ্চে তুলে দেন তখন পণ্য হওয়ার জ্বালায় হৃদয়ের একটা অংশ জ্বলে যায়।
সারা পৃথিবীতে যখন সচেতন মেয়েরা আমরা সমতার কথা বলি, যখন পুরুষদের মাঝেও নতুন করে নারীর অধিকার বা সম্মানের প্রতি জাগরণ দেখে ভালো বোধ করি, ঠিক তখনই ডোনাল্ড ট্রাম্প এর মতো মেয়েদের নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য করা, বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো কাণ্ডজ্ঞানহীন নিরেট ব্যবসায়ী লোকটিকে আমেরিকা নামের ক্ষমতাশালী দেশের ক্ষমতার ছড়িটি হাতে নিতে দেখলে অসুস্থ বোধ হয়। যিনি অভিবাসীদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন (যদিও তার নিজের স্ত্রীই একজন অভিবাসী), যিনি সকল পরিশীলিত আচরণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে টাকার জোরে, দম্ভের জোরে আত্মপ্রকাশ ঘটান তাকে যখন একটি উন্নত(!) দেশের মানুষ নিজেদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করে তখন মানবজাতি আসলেই কত উন্নত তাতে আমার সন্দেহ জাগে! যে দেশগুলি উন্নত বলে আমরা মনে করি তারা আসলেই উন্নত, নাকি প্রযুক্তিগতভাবে, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত? উন্নত দেশ মানে সেখানের মানুষও, মানবমনও সামগ্রিকভাবে উন্নত হবে তেমন কোনো কথা আসলেই নেই!
এমন ভাবার দরকার নেই আমি হিলারির একনিষ্ঠ ভক্ত, তিনি নারী বলে সাতখুন মাফ। ব্যাপারটা হচ্ছে হিলারি মিথ্যেবাদী হলেও, তার ইমেইল কেলেঙ্কারি ফাঁস হলেও তিনি এই দুই মন্দের মাঝে মন্দের ভালো ছিলেন। যদিও হতাশার কথা এটাই ছিল যে- ট্রাম্প বা হিলারি যেইই জিতুন, ক্ষমতা ওই পুরুষতন্ত্রের হাতেই!
বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক, আমি মাঝেমাঝেই অবাক হয়ে ভাবি দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার থেকে মন্ত্রী সবাই নারী, তবুও দেশে এতো নারী নির্যাতন কেন? কারণটা আমরা সবাই জানলেও কেউই বলতে চাই না। সেটি হচ্ছে- এই নারীরা ক্ষমতা পেয়েছেন উত্তরাধিকারসূত্রে। বঙ্গবন্ধু কারো পুত্র হয়ে রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেননি, দিয়েছেন নিজ নামে। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজনামে পরিচিত হলেও বঙ্গবন্ধু কন্যা নামে বেশি পরিচিত। বেগম জিয়াও পরিচিত জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে, রওশন এরশাদেরও একই দশা!
পুরুষের প্রতিনিধি হয়ে ক্ষমতায় আসা আর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা পুরুষের নামে। অন্যের লেজ ধরে ক্ষমতা যা থাকে সেটি নামেমাত্র। বাকিটা তাদের হাতেই থাকে, যারা ধর্ষণ, নিপীড়নের মতন অপরাধ করেও দলীয় মদদে ছাড় পেয়ে যায় ওই পুরুষ বলেই। পুরুষতন্ত্রের পতাকা হাতে নিয়ে পুরুষের প্রতিনিধি হওয়া ছাড়া বেশি কিছু হয় বলে আমার মনে হয় না!
হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন, আমার কাছে রাজনৈতিক দীক্ষায় দীক্ষিত সাধারণ একজন নারী যিনি নিজের আত্মবিসর্জন দিয়েছেন নামের শেষে ঝুলে থাকা 'ক্লিনটন' নামটির মধ্য দিয়েই। তিনি বড়জোর বিল ক্লিনটনের নারী প্রতিনিধি ছিলেন, সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি নন!
খিলাড়ি একটি হিন্দি শব্দ। এর অর্থ- যে খেলা করতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্ত্রী স্বামীর হয়ে কতোটা পণ্য হয়ে উঠেছেন, কতোটা পুরুষ খিলাড়ি’র হাতের খেলনা হয়েছেন জানি না। কিন্তু পণ্য হয়ে উঠে জনগণকে খেলানো দেখে নারী হিসেবে, মানুষ হিসেবে বড্ড অসহায় লাগে।
আমেরিকার নব্য ফার্স্ট লেডি মেলেনিয়া, তিনি নারী হিসেবেই আমার কাছে গণ্য হতে পারছেন না। কারণ নিজেকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ট্রাম্পকার্ড করে তোলে, যে পণ্য করে নিজের শরীরটিকে, যে আবেগহীন একটি পুতুলের মতন স্বামীর অধীনত্ব মেনে নিয়ে নিজেকে চূড়ান্ত পণ্য করে তোলে সে আমার কাছে না মানুষ, না নারী!
লেখক: তরুণ লেখক ও সাহিত্যিক