বৃদ্ধাশ্রম : ভাবনা ও বাস্তবতা
প্রকাশ | ১০ নভেম্বর ২০১৬, ০০:৪৫ | আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬, ১২:২৭
বৃদ্ধাশ্রম কি এবং কোন বয়সের লোকজন এখানে বসবাস করে কম বেশী আমরা সবাই জানি। আমাদের দেশে খুব কম মানুষই বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করেন এবং অধিকাংশ মানুষের মধ্যে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে একটি বিভিন্ন ধারণা ও ডিসকোর্স বিরাজমান! যেমন, “ছেলে-মেয়ে থাকতে কেন মানুষ বৃদ্ধাশ্রমে থাকবে?” অথবা “ছেলে-মেয়ে নিশ্চয় দেখভাল করেনা তাই বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রমে থাকে বা রাখে” ইত্যাদি ইত্যাদি …।
মানুষের বয়স বেড়ে গেলে তারা শিশুর মতো হয়ে যায়। বেশী কথা বলতে চায়, নিজের বুঝমত সিদ্ধান্ত দিতে চায়। তাদের সিদ্ধান্তগুলো অনেক সময় যুগোপযোগী হয়না। ফলে তাদের দেয়া সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়না বা নেয়া যায়না। এতে বৃদ্ধা বা বৃদ্ধ বেচারি মনে কস্ট পান; অনেক সময় এই মনোমালিন্য অনেক দূর গড়ায়, পরিবারে বিভেদ আর পারষ্পারিক দূরত্ব বাড়ায়। আমাদের ব্যস্ত জীবনে প্রত্যেকে আমরা মা- বাবাকে কতটুকু সময় দিতে পারি? আমাদের বাচ্চাদেরই তো কোয়ালিটি টাইম দিতে পারিনা। বাইরে ঘুরতে নিয়ে গেলে তার জন্য বড়সড় মাসুল দিতে হয়। তথ্য প্রযুক্তির যুগে স্মার্ট সন্তানদের কথার অত্যাচারে অনেক সময় আমরা অস্থির থাকি সেখানে মা-বাবার কথা কে, কতটুকু শুনতে পারি বলুন?
যেসব মা-বাবার শুধুমাত্র কন্যা সন্তান আছে এবং যাদের মেয়েরা চাকুরী বা অন্য কোন আয়মূলক কিছু করেন না, পরিবারের অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর সাথে সেই সব মেয়েদের কি পরিমাণ কর্তৃত্ব থাকে? তার উপর যদি সেই মেয়ের শ্বশুর শ্বাশুড়ী জীবিত থাকেন! সেই সব কন্যা সন্তানদের বৃদ্ধ মা-বাবা কোথায় থাকবেন? আবার এরকম মা-বাবাদের সন্তানরা অনেক সময় বিদেশেও থাকতে পারেন! বিদেশে সব সময়, সব স্ট্যাটাসে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নেয়াও যায়না! আবার এরকমও দেখা যায়, মেয়েদের কাছে বৃদ্ধ মা-বাবা ভালই থাকেন কিন্তু সব মা-বাবা আর তাদের সন্তানরা সমান হন না বা সমান বাস্তবতায় থাকেন না। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে মেয়ের বাড়িতে মা-বাবার থাকাটা এই সমাজ খুব একটা ভাল চোখে দেখেনা। আবার আত্মসম্মানবোধ প্রবল এমন অনেক বয়স্ক ব্যক্তি এটাকে মেনে নিতেও পারেন না।
এবার আসি ছেলের বাড়ি প্রসঙ্গে, অনেক মা-বাবাই ছেলের বাড়িতে থাকেন তাঁদের বৃদ্ধ বয়সে! আগে তিনি তাঁর নিজের সংসার নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিলেন যে ছেলে-বউয়ের বাচ্চাদের দেখাশুনা করার সুযোগও পান নি। এদিকে ছেলের বউ অনেক কস্ট করে বাচ্চা প্রতিপালন, বাচ্চার জন্য ক্যারিয়ার, নিজের আত্ন-পরিচয় বিসর্জন দিয়েছেন। একজন নারীর এই সমাজে একটি অবস্থান/আত্মপরিচয় তৈরি করে নেয়া এতোটা সহজ নয়। সেই পরিচয়টিও যখন বাচ্চার জন্য বিসর্জন দিতে হয় তা আসলে ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তাই দাদা-দাদী স্নেহ থেকে বঞ্চিত বাচ্চাদের সাথে এবং ছেলের বউয়ের সাথে কখনো এই ধরনের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনা! সম্পর্কের ফারাক থেকেই যায়। ফলে ছেলের সংসারে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ভাল থাকতে পারেন না।
আমাদের সমাজে ছেলের বউ ও তার বাচ্চা নিয়ে অনেকের অনেক খারাপ ধারণা বিরাজমান! মায়েদের নিজের মেয়ের উপর যেমন দায়িত্ব আছে, ছেলের বউয়ের প্রতি তেমন কোন দ্বায়িত্ব নেই - এইরকম একটি নোশন বিরাজমান! যদিও এইটা ভুল নোশন, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সেই ভুল ধারণা চলমান। যেমন অনেক বাড়িতে আমরা দেখি, বাচ্চাদের কোন সমস্যা হলে বউকে তার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে; এমনকি বাচ্চা হবার কালেও। বাচ্চাও তো তাদের বংশের সন্তান তাহলে মায়ের কাছে পাঠানোর রেওয়াজ কেন? কারণ মা তার মেয়ের যত্ন ভাল নিতে পারবেন, তাইতো ধারণা? কেন শাশুড়ি পারবেন না? আমাদের পারা না পারার মাঝে নানারকম মনোবিভক্তি থেকেই যায়! ফলে বৃদ্ধা-বৃদ্ধকে নিয়ে পরিবারে নানাবিধ মানসিক সমস্যাও চালু থাকে, যা দুই পক্ষকেই সমান ভাবে কস্ট দেয়। ফলে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া একজন বৃদ্ধা নিজের ছেলের বাড়িতেও ভাল থাকেন না।
ছেলের বাড়িতে সবাই ব্যস্ত, বৃদ্ধাদের সাথে আসলে কথা বলার সময়ই হয়না কারও। যেখানে তিনি একটু কথা বলতে ভালবাসেন, সেখানে মানুষের সময় কোথায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাথে গল্প করার? অনেক সময় অনেকে বৃদ্ধাদের গল্প পছন্দ করেন না। অথচ অনেক বৃদ্ধারা যদি এক জায়গা থাকেন তাহলে তাদের কথা বলার মানুষেরও অভাব হয়না এবং গল্পের বিষয়েরও অনেক মিল থাকে। ফলে অন্যের সাথে নানা মনোমালিন্যের চেয়ে বৃদ্ধাশ্রমে মনে হয় বৃদ্ধারা ভাল থাকতে পারেন। আমাদের সকলেরই বৃদ্ধ বয়সের প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন, অন্তত বয়স যখন পঞ্চাশ পেরোবে! বৃদ্ধ বয়সে নানারকম মানসিক জটিলতার চেয়ে আমার কাছে বৃদ্ধাশ্রম অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ! আমি ব্যক্তিগত ভাবে বৃদ্ধাশ্রমকে খারাপ ভাবে দেখিনা।
যে সকল মায়ের সন্তান যদি বিদেশে থাকেন কিন্তু অর্থনৈতিক কিংবা আইনি কারণে মা-বাবাকে বিদেশে নিতে পারছেন না (অথবা নিজেরাই বিদেশে যেতে চাননা) সেসব বাবা-মা বাড়িতে বৃদ্ধ বয়সে অনেকখানি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন; আর্থিক সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও পার করেন একাকী, বিষণ্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবন। এর চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম কি ভাল নয়?
আর ইদানীং আমাদের সমাজজীবনে পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে যে পুঁজিবাদী মনোবৃত্তি গ্রোথিত হচ্ছে তার একটি প্রচ্ছন্ন প্রতিফলন অনেকক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যাচ্ছে পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। সন্তান প্রতিপালন কোন ব্যবসায়িক লগ্নি নয়। কোন মা-বাবা যদি সন্তানকে ‘বড় হয়ে ফল দিবে’ এমন ‘আপেল’ গাছের মত করে গড়তে চেষ্টা করেন তাহলেই যত সমস্যা। সন্তান কখনো আপেল গাছ হতে পারেনা, ভাল মানুষও হতে পারেনা। আর স্বার্থপরতার সবক দিয়ে আমরা যেভাবে আমাদের সন্তানদের মানুষ করছি তাতে একসময় সে মা-বাবা-ভাই-বোনকেউ নিজের জীবনের গণ্ডি থেকে ধীরে ধীরে বের করে দিচ্ছে। মা-বাবার প্রতি সন্তানের দ্বায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার বিষয় না এটা লার্নিং পদ্ধতি! যা দেখে সে বড় হবে তাই করবে! আমরা সংসারে কর্তৃত্ব করতে গিয়ে ভালবাসাগুলো ধ্বংস করে ফেলি। এই কর্তৃত্ব অনেক সময় বাবা-মা করেন অনেক সময় ছেলে-মেয়ে করেন; ক্রমশঃ একে অন্যের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেন।
বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম অনেক গুরুত্বপূর্ন; বিশেষ করে নারীদের জন্য। সাধারণভাবেই আমাদের সমাজে নারীদের অবস্থা ও অবস্থান পুরুষের চেয়ে ভঙ্গুর; তাই নারীর জন্য বৃদ্ধাশ্রম বেশী জরুরী। আমরা সমাজের অসহায় নারীদের জন্য ছোট পরিসরে একটি বৃদ্ধাশ্রম স্থাপন করেছি, চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি অনেকটা নিজেরা-নিজেরাই। এর মূল স্বপ্নদ্রষ্টা সৈয়দা সেলিনা শেলী, আট বছর ধরে এর পিছনে তিনি; নিজের শ্রম-সাধনা দিয়ে একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন ‘আপন নিবাস’। শেলী আপা ও অন্যান্য সহযোগীদের প্রতিদিনের ভালোবাসা আর শ্রমে আজ পঁচিশ জন অসহায় বৃদ্ধাকে আমরা এখানে ঠাঁই দিতে পেরেছি।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী, মানবাধিকার কর্মী ও ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলার