সময় এসেছে মানব ধর্মে দীক্ষা নেয়ার

প্রকাশ | ০৬ নভেম্বর ২০১৬, ২১:০৯

একটা সময় ছিল, যখন হিন্দু-মুসলিম মুখ দেখত না। মুখ দেখলেই নাকি জাত যেতো। এমনকি বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেও জাত যেতো। সেই সময় বন্ধুত্ব হল একজন ব্রাহ্মণ এবং একজন মুসলিম পুরুষের। যারা একি আত্মার দুই বন্ধু। তারা এক পাতে বসে খেতো। সময়টা কমপক্ষে একশত বছর আগের বা তারও আগের...

তারা দুজনেই ছিলেন খুবই মেধাবী এবং শিক্ষিত। সার্টিফিকেটে তো বটেই কিন্তু তারা সেই সার্টিফিকেট, পেশাগত দিকের বাইরেও তৎকালীন হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ বাদ দিয়ে তাদের উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় রেখে গেছেন। ফলত, তৎকালীন সমাজ আঙ্গুল তুলে তাদের প্রশ্ন করেছিল কিনা তা আমার জানা নেই কিন্তু সেই সমাজের মানুষ তাদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়নি, তা আমি জানি।

সেই মুসলিম বন্ধুর ঘরে জন্ম নেন এক কন্যা। মাত্র ৬/৭ বছরের কন্যা এবং ছোট এক পুত্র রেখে খুব কম বয়সেই দুরারোগ্য অসুখে মারা যান লোকটি। মৃত্যুর সময় তার হিন্দু বন্ধুর হাতে তুলে দিয়ে যান তার অবুঝ দুই শিশুকে, বলে যান আমার ছেলেমেয়ের দায়িত্ব আজ থেকে তোর।

সেই কথা হিন্দু বন্ধুটি রাখেন, এবং সেই শিশু কন্যা এবং পুত্র তাকে নিজেদের বাবার মতন সম্মান দিতেন।

সেই কন্যা আমার দাদী। তিনি কঠিন সংগ্রাম করেছেন সারাজীবন। তিনি সংসার, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি নিয়ে ভেবেছেন। তার লেখা গল্প কবিতা দুই বাংলার পত্রিকায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তিনি রাজনীতিও করেছেন। তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন সর্বক্ষেত্রে। তিনি নিজের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করেছেন এবং প্রকৃত মানুষ করে গেছেন। নিজের ছেলেমেয়ের বাইরেও অনেক ছেলেমেয়েদের নিজের সন্তানের মত ভালোবেসেছেন, লেখাপড়া শিখিয়েছেন এবং তাদেরও প্রকৃত মানুষ করার চেষ্টা করেছেন।

আমি দেখেছি, পিতামাতা হারানো এক হিন্দু পরিবারের ছেলেমেয়ে তাকে আম্মা ডাকতেন। আমিও তাদের চাচা, পিসি ডাকতাম। চাচার সাইকেলে পুরো শহর ঘুরেছি ছোটবেলায়। লক্ষ্মী পুজোয় তাদের বাড়ী গিয়ে আলপনা দিয়েছি, লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ এঁকেছি, কলা বউ সাজিয়েছি, ছোট ডাবে সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক এঁকেছি। বাড়ি ফেরার সময় নাড়ু, মোয়া নিয়ে এসেছি..

দেখেছি এক খ্রীষ্টান পরিবার আমাদের পরিবার হয়ে গিয়েছিল। তারা আমাদের বাড়িকে নিজেদের দাদুবাড়ী মনে করেন। আমরা না গেলে তাদের বড়দিনের কেকই কাটা হতো না। ওই বাড়িতে আমি নিজ হাতে ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়েছি... সেই বাড়ীতে আমার তিন দিদি আছেন। তারা বলতে গেলে আমার মায়ের বয়সী। আমি জানি তাদের যদি কেউ প্রশ্ন করে আমি তাদের সম্পর্কে কে হই? তারা এক বাক্যে বলবেন আমি তাদের কাকাতো বোন।

আমার দাদীকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেই ডাক্তার চেকআপ করতেন নিয়মিত, তিনিও হিন্দু ধর্ম পালন করতেন।

উপরের কথাগুলো দেখলে আজকালকার অনেকেই এক ঝটকায় বলে বসবেন, আমার দাদী নাস্তিক ছিলেন। কিন্তু আমি আমার দাদীকে নামাজ পড়তে দেখেছি। কিন্তু কোনদিন তাকে দশহাত চওড়া ঘোমটা দিতে দেখি নি শাড়ির আঁচল দিয়ে।

এমন পরিবারেই আমার বেড়ে ওঠা। শুধু আমি নই এমন পরিবার আরও আছে আমি জানি।

আরও বলি, আমাকে যিনি প্রথম হাতে খড়ি দেন, অর্থাৎ আমাকে যিনি অ-আ শিখিয়েছিলেন তার ধর্ম খ্রিষ্টান, তারপর যিনি দীর্ঘদিন আমাকে গৃহশিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছেন তার ধর্ম ছিল হিন্দু। কিন্তু তাতে কি হল? আমার জাত গেল? তাতে কি আমার ধর্ম চলে গেল? আমি বিধর্মী বা নাস্তিক হয়ে গেলাম?

আমার ছোটবেলাকার পরিবেশ এমনি ছিল। উৎসব মানে আনন্দ, সেখানে ধর্ম মূল বিষয় ছিল না।

কিন্তু দেখলাম গত কিছু বছর ধরে, ধর্ম নিয়ে কাটাকাটি, খুন। অথচ এমন সংকটাপন্ন দেশ দেখার আশা, কোনদিন আমার পুর্বপুরুষেরা দেখেন নি। কথায় কথায় ধর্ষণ, লাঞ্ছিত মেয়েরা, এমন দিনও আসবে তা হয়তো ভুলেও ভাবেননি তারা। ভাবেননি অসাম্প্রদায়িক দেশের স্বপ্ন এমন ভাবে নষ্ট হবে..!

আমাদের পোড়া কপাল আমরা চেয়ে চেয়ে দেখি।

আমি জানতাম সংস্কৃতিমনা মানুষেরা উদারমনা হন। কিন্তু কিছুদিন আগে দেখলাম এক সংস্কৃতি জগতের মানুষ বললেন ধর্ম যার যার উৎসব সবার নয়, উৎসব তার তার। তিনি এও বলেছেন হিন্দুরা কি মুসলমানের উৎসব পালন করেন? 

আমি বিস্মিত হলাম। ভাবলাম, তিনি মানুষ সম্পর্কে তেমন বিষদ আকারে কিছুই জানেন না। তাহলে নিশ্চয়ই জানতেন বর্তমান সমাজে এখনও অনেক মানুষই আছে যারা সব ধর্মের উৎসবে বেড়ান, ঈদ মোবারক, শুভ বিজয়া, হ্যাপি ক্রিসমাস, বৌদ্ধ পুর্নিমায় শুভেচ্ছা জানান।

আসলে মানুষের মনের পরীধি সীমিত হলেই শুধু ধর্ম নিয়ে মানুষ কাঁদা ছিটায়। তারা জানেন না সকল ধর্মের উপরে প্রকৃতি, মানুষ, জীবজন্তু। ধর্ম তো মানুষই পালন করে। মানুষ খুন করলে ধর্ম পালন করবেন কে? 

জন্মগতভাবে মানুষ যে ঘরে জন্মায় সে ঘরের ধর্মই পালন করে। একটা সদ্যজাত শিশুকে কেউ যদি রাস্তায় ফেলে দেয়, সেই শিশু কিন্তু জানে না সে কোন ধর্মের বা কোন শিশুকে যদি কোন পরিবার দত্তক নেয় সেই শিশুও কিন্তু দত্তক নেয়া পরিবারের ধর্ম পালন করবে। কারণ সে তো জানে না তার ধর্ম কি?

অন্য ধর্মের মানুষেরা নিজেদের ধর্ম নিয়ে কিছু বললে, মানুষ বলে, তারা উদারমনা, প্রগতিশীল। কিন্তু ইসলাম নিয়ে কোন কথা বললেই, বলে নাস্তিক! সেই মানুষগুলো জানে না যে নাস্তিক হওয়া এত সোজা না। বললেই নাস্তিক হওয়া যায় না বা বললেই নাস্তিক হয় না। নাস্তিক হতে যুক্তি লাগে। নাস্তিকের থেকে আস্তিক হওয়া অনেক সোজা।
 
এই যে প্রতিদিন শুনি সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণ হচ্ছে, সারাদেশে হিন্দুদের সংখ্যালঘু বলে অত্যাচার করছে,ঘর-বাড়ি তছনছ করে দিচ্ছে, কি লাভ হচ্ছে তাদের? তারা কি জানেন প্রাচীন কালে কোন ধর্মই ছিল না। তারা কি জানেন প্রায় ৪০০০ বছর পুর্বে সকলে সনাতন ধর্মের ছিলেন। তখন অন্য কোন ধর্ম ছিল না। সনাতন ধর্মকেই যে হিন্দু ধর্ম বলা হয় তা কি জানেন তারা? তারা কি জানেন সনাতন ধর্ম কি করে হিন্দু ধর্ম হল?

শুনেছি অনেক বছর (কত বছর, তা আমি সঠিক বলতে পারবো না) আগে একটা দাঙ্গা হয়েছিল। মারামারি, কাটাকাটি করতে করতে তারা একটি নদীর পারে গিয়ে থেমে গেছিল। সেই নদীর নাম ছিল হিন্দ। তারা ওই নদীর ওপারে যেতে পারেন নি তাই তারা বলেছিলেন ওপারের মানুষ হিন্দু। সেই থেকে হিন্দু ধর্ম হয়েছে। তারপর বিভিন্ন বিবর্তনে অন্যান্য ধর্ম এসেছে।

তারা যদি নিজেদের আস্তিক বলে দাবী করেন, তাহলে আমি তা বিশ্বাস করি না। তারা কেউ মানুষ ই না। মানুষের চেহারার হিংস্র পশু এক একটা। তাদের কোন জাত, ধর্ম, গোত্র নেই। থাকতে পারে না।
থাকলে এমন বর্বরতা করতে পারতো না।

আরও একটা কথা বলে রাখি,আমার অনেক শিক্ষক ধর্মীয় দিক থেকে হিন্দু অর্থাৎ তারা হিন্দু ধর্ম পালন করেন। আমি বিশ্বাস করি শিক্ষক, মা-বাবার সমতুল্য । তাদেরকে এক মন্ত্রী মালাউনের বাচ্চা বলে গালি দিয়েছেন।

মন্ত্রী সাহেব, আপনি আমার মা-বাবাকে গালি দিয়েছেন, অপমান করছেন তাদের। ভুলে যাবেন না, তাদের সন্তানেরা মরে যায়নি এখনও বেঁচে আছে।

শুরুতে আমি কমপক্ষে একশ বছরের পুরানো ঘটনা দিয়ে শুরু করেছিলাম। তারপর সমাজ বেশ খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। অনেক মানবিক হয়েছে আবার বেশ কিছু বছর আগে থেকে সমাজ আবারও স্রোত হারিয়েছে সাথে হারিয়েছে মানবিকতা। এখন সময় এসেছে মানবিকতা শেখার। সময় এসেছে বক ধার্মিকতা বাদ দিয়ে সমাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। সময় এসেছে মানুষ খুন, ধর্ষণ বাদ দিয়ে মানবিকতা শেখার। 

সময় এসেছে মানব ধর্মে দীক্ষা নেয়ার...

লেখক: সংস্কৃতিকর্মী