আমাদের শৈশব ও ধর্ষকামী সমাজ
প্রকাশ | ২৫ অক্টোবর ২০১৬, ১৯:৩৩
বর্তমানে আমরা যে সমাজে বসবাস করি তাকে আধুনিক সমাজ বলা হয়। আমাদের চিন্তা-ভাবনা, কথা-বার্তা, আচার-আচরণ সবই আধুনিক, প্রগতিশীল। নারী স্বাধীনতা ও সমতায় বিশ্বাসী এই সমাজ। কিন্তু আমাদের আদিম কালের মনোভাব বেরিয়ে আসে তখনই যখন সমাজে কোন যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে, সমাজে কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর প্রতিক্রিয়ায় সমাজ নিপীড়িত মানুষটির পোশাক পরিচ্ছদ আর তার চাল চলনের চুল চেরা বিশ্লেষণ শুরু করে। সমাজ ব্যস্ত হয়ে উঠে ধর্ষিতার অতীত ও তার সম্পর্কগুলোর ময়নাতদন্তে।
সাইবার ক্রাইম বা গোপন ভিডিও প্রকাশ বা সেক্স টেপ বের হলে সমাজ এক কথায় নারীকে বেশ্যা বলে ঘোষণা দেয়। এই সবকিছুই আমাদের ধর্ষকামী মনোভাব তুলে ধরে। সমাজ যেন ধর্ষককে বুঝিয়ে দেয়- তুমি অপরাধী নও কিংবা তুমি অপরাধী হলে সেও সমান অপরাধী। আর এর সবই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করে একজন যৌন নিপীড়ককে, একজন ধর্ষককে। একবার নিপীড়িত হবার পর একজন নারী বার বার নিপীড়িত হতে থাকে পরিবার, পরিজন, প্রতিবেশী এমনকি মিডিয়ার মাধ্যমে। মেনে নিলাম এই সবই নিয়তি বা বলতে পারেন সমাজের অলিখিত নিয়ম।
কিন্তু যখন এই ঘটনা ঘটে একজন শিশুর সাথে? তখন কি বলবে আমাদের ধর্ষকামী সমাজ? যে বয়সে একজন শিশুর হেসে খেলে দিন কাটানোর কথা- সে বয়সে সে হয়তো চিকিৎসা নিচ্ছে কোন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে, কেউ কেউ হয়তো লোক লজ্জার ভয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে কোন প্রাইভেট ক্লিনিকে। কতজনের হিসাব আমরা রাখি? কতজনের খবর আমরা পাই? সমাজই যখন ধর্ষকামী, সমাজই যেখানে নিপীড়কের সহায়তাকারী, সেখানে কত জন মুখ ফুটে বলতে পারে নিপীড়নের কথা? সমাজের এই ধর্ষকামী মনোভাবের বলি হয়ে যে কত শিশু নিপীড়নের শিকার হচ্ছে দিনের পর দিন তার দায় কি নিবে এই সমাজ?
ছোটবেলায় পাশের বাড়ির দাদা, চাচা এমন কি নিজ পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে কোন প্রকার নোংরা আদর বা সংবেদনশীল অঙ্গে ইচ্ছাকৃত স্পর্শ পায়নি এমন শিশুর সংখ্যা ১০ ভাগও হবে কিনা সন্দেহ! অনেক ক্ষেত্রে আমরা শিশুকে সাবধান করি, তাকে বলি ওর কাছে যেও না বা সে দুষ্টু, তার থেকে দূরে থাকো। কিন্তু সেই নিপীড়ককে ডেকে এনে তাকে জানিয়ে দেয়া যে এইটা অপরাধ- এমন ঘটনা সকল ক্ষেত্রেই বিরল। আর এই একদিন দুই দিনের দুষ্টামি আর নোংরামি থেকেই জন্ম হয় এক একজন ধর্ষকের। শুধু মেয়ে শিশু নয়, এই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ছেলে শিশুরাও। আর শিশুর মনস্তত্বে এর প্রভাব থেকে যায় সারা জীবন। এমনকি এই শিশুই বড় হয়ে অনেক সময় নিপীড়ক হয়ে উঠে।
তাই শুধু নারী স্বাধীনতা বা সমতার জন্য নয়, আমাদের শিশুদের জন্য আমাদের মানসিকতার বিস্তর পরিবর্তন দরকার। এই ধর্ষকামী মনোভাব যেমন নারীর জন্য ক্ষতিকর, তেমনই ক্ষতিকর আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। শুধু চলনে বা বলনে নয় আমাদের আধুনিক হতে হবে মন মানসিকতায়। সমাজ যেন ধর্ষকের আঁতুড়ঘরে পরিণত না হয়, সমাজ যেন হয়ে উঠে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যতের সূতিকাগার। সমাজের সংস্কার শুরু হোক আজ থেকেই।
লেখক: চিকিৎসক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট