পুরুষ কেন ধর্ষণ করে?
প্রকাশ | ২৪ অক্টোবর ২০১৬, ১৮:৫৫
দিনাজপুর পার্বতীপুরের পূজা নামের ৫ বছরের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, ৫০ বছরের এক জানোয়ার সাইফুল।
কিন্তু কেন?
তার উত্তর, ফরাসী নারীবাদী তাত্ত্বিক, সিমোন দ্য বোভোয়ার দিয়েছেন এইভাবে, নারীর শরীর পুরুষের কাছে একটি মাংসপিন্ড, তাদের কাছে সে একটি সেক্স অবজেক্ট। ঠিক এই কারণেই একজন পুরুষ ৫ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করতে পারে। পারে, কারণ তার বয়স যাই হোক, সে একটি সেক্স অবজেক্ট কারণ সে নারী, তার শরীরে একটি যোনী আছে, জরায়ু আছে। যৌনতার জন্য একজন পুরুষের একটি যোনী হলেই চলে, জরায়ু হলেই চলে। তার বয়স দেখা লাগে না, সম্পর্ক দেখা লাগে না, প্রেম দেখা লাগে না, সময় দেখা লাগে না, সমাজ, বিবেক কিছুই লাগে না।
পুরুষ কেন ধর্ষণ করে, এর উত্তর ঐতিহাসিক। নারীর উপরে নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য যেভাবে পুরুষতান্ত্রিক ‘উত্তরাধিকার’ ক্ষমতার জন্ম হয়েছে , যেভাবে তাকে জোর করে বিয়ে করে গৃহবন্দি করা হয়েছে, তাকে দিয়ে পুরুষের সম্পত্তির পাহারাদার পুত্রের পরিচয় নির্ধারণ করা হয়েছে, বংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, সেই জায়গা দিয়ে নারীকে ধর্ষণের লিগ্যাসি তৈরি হয়েছে ইতিহাসে।
জীব বিজ্ঞানীরা নানানভাবে গবেষণা করে দেখেছেন যে, প্রাণী জগতের বাইরে অন্য কোন প্রানীর মধ্যে ধর্ষণ নেই। এটি আছে কেবল মানুষের মধ্যে। এবং অনেক আগ থেকেই মানব সমাজে নারীকে পুরুষ জোর পূর্বক ধর্ষণ করে। কেন নারীকে ধর্ষণ করা যায় তা বুঝার জন্য আমাদেরকে যৌনতার ধারণা বুঝা দরকার। যৌনতা একটি প্রাকৃতিক ধারণা কিন্তু ধর্ষণ একটি সামাজিক প্রপঞ্চ। এই ধারণাটির জন্ম সমাজে দেয়া হয়েছে।
আমেরিকান নারীবাদী লেখিকা-সুশান ব্রাউন মিলার তার বিখ্যাত বই ‘এ্যাগেইন্সট আওয়ার উইল; ম্যান উইমেন এ্যান্ড রেইপ’ বইয়ে খুব এলাবোরেটলি দেখিয়েছেন যে-সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার মধ্যে দিয়েই নারীকে ধর্ষণ করার ধারণা জন্ম হয়েছে। নারীকে যখন থেকে সামাজিকভাবে সম্পত্তি ভাবা হল-তখন তার একটি ভ্যালুস তৈরি হল নিজের শরীরের কারণে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে এমনভাবে তৈরি করলো যে তার ভার্জিনিটির মূল্য আছে। এই ভার্জিনিটি দিয়ে অন্য গোত্রের ছেলেদের সাথে বার্গেনিং করা যায়। আবার তার এই ভার্জিনিটি যদি কেউ নষ্ট করে তাহলে তার কাছ থেকেও এর মূল্য আদায় করা যায়। অর্থ্যাৎ নারী একটি টুলসে পরিণত হল। সে কুমারী হলেও পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের লাভ আবার সে ধর্ষিত হলেও পরিবারের লাভ। কুমারী থাকায় তার মূল্যের কারণ-সে কুমারী, আবার কেউ তাকে ধর্ষণ করলে –সে কুমারীত্বের মূল্য হারিয়েছে। এই দুই জায়গা দিয়েই পরিবার লাভবান হচ্ছে। এখনো আমাদের সমাজে কোন মেয়ে রেইপ হলে-সালিশি বা বিচারে তার বিয়ের জন্য টাকা আদায় করা হয় বা কুমারীত্ব হরণের জন্য ঐ রেপিস্টকে বিয়ের চাপ দেয়া হয়। ধর্ষণের মনস্ত্বত্ব আসলে সমাজে এইভাবেই এসেছে।
ক্ষমতার প্রকাশও আরেকটা দিক। মানুষ যখন পাওয়ারফুল হয়, তখন সে আগে দুর্বলের দিকে টার্গেট করে নিয়ন্ত্রণ নেয়ার। আমাদের সমাজেও নারীকে একটি দুর্বল আইডেন্টিটি ভাবা হয়। পুরুষ ধরেই নেয় যে, একজন নারী সে যেই হোক, সে তার চেয়ে নিচের। তার ক্ষমতা অনেক কম। এভাবেই যেকোন নারী পুরুষের জন্য অবজেক্ট হয়ে যায়। সেজন্য যে কোন জায়গায় একজন পুরুষ পাশে থাকা নারীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য শরীরকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করে।
আরেকটি দিক হল- সমাজ কর্তৃক নারীর শরীরের উপর ট্যাবু তৈরি করা। তার কুমারী থাকাটাকে গ্লোরিফাই করা। যখন কোন পুরুষ রেইপ করে, সে কেবল রেইপ করে; কিন্তু যখন নারী রেইপড হয় তার সাথে তার জীবন অনিরাপদ হয়, তার পরিবারের সম্মান কমে যায়, তার বিয়ে অনিশ্চিত হয়। সবচেয়ে বড় বিষয় দাঁড়ায় তখন, যখন এই ধর্ষিতা নারীর গর্ভে সন্তান চলে আসে। সমাজে যেহেতু স্বীকৃতি ছাড়া সন্তান জন্ম দেয়া সম্ভব নয় ফলে ঐ নারী তখন পরিবার, সমাজ আর নিজের শরীরে অনাগত প্রশ্ন নিয়ে আতঙ্কে থাকে। এই দুর্বলতার জায়গা অনেক বেশি কাঠামোগত। এর শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। এই ট্যাবু থেকে বের হয়ে আসাটাও ধর্ষণ বিষয়কে নারীর সম্মানের জায়গার চেয়ে বরং অপরাধীর অপরাধের জায়গা থেকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেবে। এইটা আসল লড়াইয়ের জায়গা।
সমাজে ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য সঠিক কোন ভ্যাকসিন নেই। এটা মানবজাতির গভীরতর সামাজিক সমস্যা। তবে এটাকে রিডিউস করার জন্য অনেক প্রচেষ্টা থাকা জরুরী। আধুনিক কোন সমাজেই ধর্ষণ জিরোতে পৌঁছে যায়নি। তবে তাকে কমিয়ে রাখার জন্য সোশ্যাল অ্যাপ্রোচ, ইনিশিয়েটিভ দরকার।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে সবার আগে দরকার সামাজিক আন্দোলন। এই আন্দোলন কিন্তু নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নের পথের আন্দোলন। এটি উন্নয়ন এজেন্ডার অ্যাপ্রোচ নয়। এটি মূলত-নারীর নিজের শরীরের উপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখার আন্দোলন। তার শরীর একান্তই তার নিজের, এই দাবির আন্দোলন। তার সন্তান জন্ম দান থেকে, যৌন সম্পর্ক সব কিছুই এই আন্দোলনের বিষয়। সেই সাথে যে কোন নারী রেইপড হলে-তার জন্য সর্বস্তরের সামাজিক আন্দোলন। এটি যতটা না আন্দোলন তার চেয়ে বেশি নারীর শরীরকে যৌনতার বাইরে মানুষের শরীর হিসেবে প্রতিষ্ঠার একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন।
দেশে আইন দরকার। নারীরা যেখানেই ভালনারেবল সেখানেই লিগ্যাল প্রটেকশন বাড়ানো দরকার। রেপিস্টের প্রতি সকল প্রকার সামাজিক সহমর্মিতা অপসারণ করে নিয়ে তার বিচারের কার্যকর পন্থা বলবৎ রাখা দরকার। এটি করা গেলে নারীর উপর রেইপ কমানো যাবে। আইন কোন সময়ই কোন সমস্যাকে নির্মূল করতে পারে না, কিন্তু এটি সমস্যাকে কমিয়ে রাখতে সহায়ক। সেজন্য ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন খুব জরুরী।
সবশেষে যা দরকার, সঠিক যৌন ধারণা ও যৌন শিক্ষা। একটি শিক্ষা ও বিনোদনমূলক ব্যবস্থার ভেতরে যদি যৌনতাকে ক্রমান্বয়ে শিশুদেরকে শেখানো যায়। ধর্ষণের ধারণা কোন মানবিক ধারণা নয়, যদি এটিকে সামাজিক মূল্যবোধের ভেতরে আনা যায়, তাহলে ৫ বছরের শিশুকে কারো পক্ষে সেক্স অবজেক্ট হিসেবে দেখা সম্ভব হবে না। এই জায়গা আমাদের সমাজে খুব কম উপস্থিত। এটা বাড়ানোর জন্য যৌন ধারণা ও শিক্ষা লাভের প্রথাগত খোলনলচে পালটে আমূল পরিবর্তন আনা দরকার।
লেখক: গবেষক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট