প্রসঙ্গ: ম্যারিটাল রেপ
প্রকাশ | ২৪ অক্টোবর ২০১৬, ০১:৪৬
ম্যারিটাল রেপ অথবা দাম্পত্য ধর্ষণ বলে একটা কথা আছে। যেখানে স্বামী দ্বারা ধর্ষিত হয় স্ত্রী। তবে এ শব্দটা এখনো অনেকের কাছে ‘ভাসুরের নাম মুখে না নেওয়ার মতই’। আর তাই অনেক নারী প্রতিনিয়ত স্ত্রীর ভূমিকায় স্বামী নামের পশুর হাতে ধর্ষিত হচ্ছে।
এখন কেউ বলতেই পারেন, একজন স্বামী তার স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করবে-এটাই তো স্বাভাবিক। এখানে আবার ধর্ষণের কথা আসছে কোথা থেকে! স্বামী তার স্ত্রীর সাথে জোর করে হোক আর যেভাবেই যৌন-সঙ্গম করলে সেটা ধর্ষণ হবে কেনো? এটা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অধিকার।
হ্যাঁ অধিকার। আমাদের প্রচলিত ধর্মগুলোও ঠিক তাই বলে। আর তাই তো স্বামী তার অধিকার ফলাতে রাতের পর রাত অনেক স্ত্রীকে ধর্ষণ করে যাচ্ছে। ধর্ষিত হচ্ছে অজস্র নারী। ধর্ষিত হচ্ছে আর যৌনাঙ্গের ব্যথা নিয়ে চার দেয়ালের ভেতরে মুখ টিপে কাতরাচ্ছে তারা।
এ সংখ্যা কত হবে? জানা নেই। আমরা জানার চেষ্টাও করি না। এসব নিয়ে মাথা ঘামানোটাও ঠিক না। কি দরকার? এমন বলি আর ভাবি। ভাবি আর এড়িয়ে যাই। অনেক শিক্ষিত সচেতন মেয়েরাও এমন যৌন নির্যাতন মুখ বুজে দিনের পর দিন সহ্য করে যাচ্ছে। এছাড়া কি আর করার আছে তাদের? তারা যদি স্বামী নামের পশুটাকে ধর্ষক বলে দাবী করেন, তবে সমাজ কি তা গ্রাহ্য করবে? বরং সমাজ হাসবে। সমাজ ধর্ষিত স্ত্রীকে কুলটা, বেশ্যা, ছিনাল, মাগি এবং নষ্টা নারী বলে উপাধি দিবে।
স্বামী যদি স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করে আর ভুক্তভোগী স্ত্রী আইনের আশ্রয় নেয়, তাহলে ধীরে হলেও ব্যাপারটা আমরা মেনে নিতে শুরু করি। কিন্তু স্বামী স্ত্রীকে ধর্ষণ করছে! এটা মেনে নিতে আজও কোথাও যেন বাধে। ‘ম্যারিটাল রেপ' বা দাম্পত্য ধর্ষণ এখনও যে অপরিচিত না হলেও অনুচ্চারিত একটি শব্দ! এর পেছনে অবশ্য রয়েছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, সামাজিক অবকাঠামো, যেখানে স্ত্রীকে আজও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা হয় স্বামীর সম্পত্তি হিসেবে।
এখানে নারীকে পারিবারিক চাপ অথবা অন্য উপায় না থাকার ফলে বছরের পর বছর বাস করতে হয় ‘স্বামী' নামের ধর্ষকের সঙ্গে। একবার নয়, হয়ত প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে ধর্ষণ হয় তার। লোকলজ্জার ভয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না সে। তাই বয়ে বেড়াতে হয় যৌন রোগ, ক্ষত বা মানসিক অসুখ।
তাই কোনো নারীকে যদি প্রশ্ন করেন, ‘আপনার স্বামী কি আপনাকে ধর্ষণ করছেন’? এক্ষেত্রে বেশিরভাগ নারীই হয় চুপ হয়ে যাবে নয় তো পড়ে যাবে চিন্তায়। আর কেউ যদি সাহস করে অপ্রিয় সত্যটা বলেও ফেলে, তাহলে তার ভবিষ্যৎ কী? কে দেবে তাকে পুনর্বাসন, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ? পরিবার? রাষ্ট্র? ধর্ম?
এ ক্ষেত্রে একটা বাস্তব ঘটনাকে অবলম্বন করতে পারি। মেয়েটির নাম তিতলি (ছদ্মনাম)। তার বয়স তখন ১৮। অসম্ভব সুন্দরী সে। এর কারণে তার উপর নজর পড়ে একজন রাজনৈতিক নেতার। যে নেতার বয়স তার থেকেও দ্বিগুণ। পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে তিতলিকে বিয়ে করে সে। বিয়েটা মেনে নিতে চায়নি তিতলি। তারপরও সে সমাজ সংসারের হাতে বাঁধা। বাধ্য হয়েই বিয়ে করতে হয় তাকে।
তিতলি অবশ্য ভেবেছিল বিয়ে যখন হয়েই গেছে, তখন আর কি করা? স্বামীকে মেনেই নিই। ভালোবাসার চেষ্টা করি। হয়তো আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই তিতলি ফুল শয্যা রাতে ভেবেছিল তার বর এসে তাকে দু’চারটে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে। ভালো কি করে বাসতে হয় সে শিখিয়ে নিবে। কিন্তু ঘটনা ঘটলো পুরো উল্টোটা!
স্বামী এসে দু-একটা মিষ্টি কথা বলা তো দূরের কথা, একরকম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তিতলির শরীরে! যন্ত্রণায় চিৎকারও করতে পারেনি সে, মুখে গুঁজে দেয়া হয়েছিল চাদর। বাহ্ রে, নিজের বউ বলে কথা। তার ওপর জোর-জবরদস্তি করার একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে না স্বামীর? আর ‘বিয়ে' তো শুধু নারী-পুরুষের মধ্যকার সামাজিক ও ধর্মীয় চুক্তি নয়, এ তো স্বামীর ইচ্ছে মতো স্ত্রীকে ভোগ করার একটি বৈধ ‘লাইসেন্স'। তাই না?
সে রাতে ধর্ষিত হয়েছিল তিতলি। ক্ষত হয়েছিল তার যৌনাঙ্গ। রক্তাত্ব যৌনাঙ্গ নিয়ে ব্যথায় ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিল সে। স্বামী ফিরেও দেখেনি! বরং পাশেই তার স্বামী নামের জানোয়ারটা পরম তৃপ্তি সহকারে সিগারেট ফুঁকছিল!
সেদিনের পর থেকে তিতলির কাছে যৌন-সঙ্গম মানেই যন্ত্রণার এক একটি রাত। সেই প্রথম দিন থেকে গত ১৪টি বছর সে ধর্ষিত হয়ে আসছে। তিতলি নিজেও জানে না যৌন-সঙ্গম যে একটা সুখকর, মানসিক প্রশান্তি। এটা জানার ভাগ্য তার হয়নি। তাই তার কাছে যৌন-সঙ্গম মানেই যন্ত্রণার আর চরম ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ।
এরকম হাজারো তিতলি রাগ, ক্ষোভ কিংবা যন্ত্রণা চেপেই সংসার করে যান। কারণ সমাজ শেখায় বিয়ের পর নারীর শরীরের মালিক হয় স্বামী যা চাহিবামাত্র তাকে দিতে বাধ্য থাকিবে। এমনকি শিক্ষিত নারীরাও ভাবেন এরকম কিছু হতেই পারে যা দাম্পত্য জীবনেরই অংশ। মেনে নিতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়। আর এই মেনে নেয়া, মানিয়ে নেয়ার নিচে জমা পড়ে থাকে অজস্র কান্না।
লেখক: ব্লগার