নারী: আমাদের মিডিয়ার রূপকথা ও ডুবকথা
প্রকাশ | ৩০ মে ২০১৬, ০২:৩৩
মিডিয়াকর্মী হিসেবে সামান্য যুক্ত থাকায় সেদিন একটা রেডিও স্টেশন থেকে আমাকে আমন্ত্রণ করেছিলো মিডিয়া বিষয়ে আলোচনা করতে। সেই সরাসরি আলোচনা অনুষ্ঠানে অনেকেই প্রশ্ন করেছিলো আমাদের মিডিয়ার নারীকর্মী বা আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে অভিনেত্রীদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা সম্পর্কে জানতে। সেদিন সংক্ষিপ্ত পরিসরে সব প্রশ্নের ডিটেইল উত্তর দিতে না পেরে কথা দিয়েছিলাম যে আমাদের মিডিয়া ও মিডিয়ার নারীকর্মীদেরকে নিয়ে ডিটেইলস লিখবো, সেই কথা রাখার দায় শোধ করতেই এই লেখার অবতারণা।
প্রচলিত রূপকথা: মিডিয়ায় যারা কাজ করে সেইসব মেয়েরা খারাপ, মিডিয়া খারাপ।
ডুবকথা: আসুন আগে আমরা একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। আমাদের দেশের মতো একটা পুরুষতান্ত্রিক ও সংখ্যাগুরু ধার্মিকদের দেশে নারীদের জন্য কি এমন কোন পেশা আছে যেই পেশাকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা হাসিমুখে গ্রহণ করেছে? অথবা আমাদের দেশে এমন কোন পেশাজীবী নারী কি রয়েছে যাকে তার পেশায় কাজ করতে পুরো সমাজ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত? আমার মনে হয় তেমন পেশা নেই। অন্যভাবে বলতে গেলে তেমন পেশার অভাব নেই কিন্তু নারীকে ঘরের বাইরে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবার সেই সদিচ্ছার অভাব রয়েছে আমাদের মানসিকতায়। আর মিডিয়ার মতো আলো ঝলমলে রঙিন একটা পেশায় নারী কাজ করলে সেটা সমাজের চক্ষুশূল হবে সেটাই স্বাভাবিক। কারণ আমরা এখনো নারীকে ঘরের চারদেয়ালের অন্ধকারে দেখতেই স্বস্তিবোধ করি। আজো নারীকে আমরা প্রকাশ্য আলোতে দেখতে চাই না।
নাটক সিনেমায় অভিনয়টা যেহেতু ডাক্তারি পেশার মতো একই ইউনিফর্ম পরে করা যায়না, নিত্য নতুন চরিত্র রূপায়ন করতে নিজেকে নিত্য নতুন রূপে হাজির করতে হয়, এখন এই রূপ পাল্টানো দেখেই যদি নারীকে বহুরূপী হিসেবে গণ্য করা হয় তবে সেটা হবে নারীর প্রতি বড্ড অন্যায়। কারন মেকআপের নিচে একটা রক্ত মাংসের খুব সাধারন মানুষ থাকে যে আপনার আমার মতোই খুব স্বাভাবিক মানুষ। বরং অন্য পেশায় চেয়ে অভিনয় মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে একজন নারীকে আরও বেশী শ্রম দিতে হয়, চর্চা করতে হয়। কারন ক্রিয়েটিভ কাজ কেবল শরীর বা চেহারা দিয়ে হয়না এর জন্য সৃষ্টিশীল অভিনয়ের গুণাবলী আয়ত্ত করতে হয় একজন অভিনেত্রীকে। হুট করেই চায়ের কাপে তুড়ি মেরে ‘নায়িকারা খারাপ’ বলে দেয়া সহজ কিন্তু একজন অভিনেত্রীর জন্য নিজের ব্যক্তিস্বত্বা থেকে বেরিয়ে এসে অন্য একটা চরিত্র নিজের মধ্যে ধারণ করা পাবলিকের তুড়ি মারা সমালোচনার মতো সহজ নয়। আর আমাদের দেশে পূর্ণ নারীবান্ধব কোন পেশা কি আদৌ আছে? আমার মনে হয় নেই।
কিছুদিন আগে যুগান্তর পত্রিকায় একটা নিউজ এসেছিলো যে একটা উচ্চ বিদ্যালয়ে পুরুষ সহকর্মীর হাতে ধর্ষিত হয়েছিলো একজন নারী শিক্ষক। সব পেশায়ই কিছু নেতিবাচক প্রভাবের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সেই নেতিবাচক প্রভাবকে অস্বীকার করে নিজের সততা আর ব্যক্তিত্ব ধরে রেখেই প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে সকল পেশায় সফল হচ্ছে এদেশীয় নারীরা। মিডিয়ার অবস্থাও অন্য পেশার মতোই। এখানে যারা কাজ করে তারা অন্য গ্রহের কেউ না, তারা আমাদের চারপাশ থেকেই উঠে আসা কিছু মানুষ। তাই এখানেও সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানীরা ওঁত পেতে থাকে আবার এখানেই রয়েছে মানবিক ও শিল্পমনা স্বপ্নবাজ অসংখ্য মানুষ। তাই এখানে যারা কাজ করছে তারা তাদের নিজস্ব রুচিবোধ অনুযায়ী নিজের অবস্থান তৈরী করছে।
আর যারা মিডিয়ায় কাজ করতে আসবে তাদেরকে আত্মসচেতন থেকে, নিজের ব্যক্তিত্ব ও সততা ধরে রেখে কাজ করতে অনুরোধ করবো। সাফল্যের কোন শর্টকাট রাস্তা নেই। সমাজের চোখরাঙ্গানি আর প্রচলিত রূপকথার ভয়ে দরজা লাগিয়ে বসে থাকলে কখনোই স্বপ্নপূরণ হবেনা। রূপকথাকে অস্বীকার করে নিজের স্বপ্নপূরণের পথে লম্বা শ্বাস নিয়ে ডুবসাঁতার দিতে হবে, আত্ম বিশ্বাস থাকলে নিজেকে বিকৃত বা বিক্রিত না করেই সাফল্যের তীরে পৌছানো সম্ভব। সবাই সৎসাহস আর আত্মসচেতন ভাবে এগিয়ে আসলে আমাদের মিডিয়া সমাজের রূপকথাকে ভুল প্রমাণ করে পূর্ণ নারীবান্ধব মিডিয়া হয়ে উঠবেই একদিন।
মিডিয়ার রং আমাদের বিবর্ণ জীবনকে রঙিন করে তুলুক।