তবে বেশ্যাই ভালো
প্রকাশ | ১৩ অক্টোবর ২০১৬, ২২:১১
বাবা-মা এবং রক্ষণশীল সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আলমকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল লীনা। বিয়ের দু’বছর ভালোই ছিল। এরমধ্যে তাদের সংসারে একমাত্র সন্তান রওনক আসে। তবে এ সংসারটা ছাড়তে বাধ্য হয় লীনা! ভালোবেসে বিয়ে করেছে সবার অমতে। আবার নিজের ইচ্ছেতে সংসার ছেড়েছে! নাহ, এই মেয়েটা বাজে একটা মেয়ে। তার চরিত্রের কোন ঠিক নেই। সে বেশ্যা!
আশপাশে এমন অজস্র কথা লীনাকে নিয়ে চর্চা হয়। এসব পাশ কাটিয়েই ছেলেকে নিয়ে একা বাসায় উঠেছে সে। অনেকের ধারণা, তার সাথে কোন ছেলের বিশেষ সম্পর্ক আছে, তাই সে সংসার ছেড়েছে। সে একটা নষ্টা মেয়ে। নিজ পরিবার এমনকি দূরের, কাছের অনেকেই এসব নিয়ে মুখ টিপে টিপে হাসে। নানা কথা বলে বেড়ায়। লীনা প্রথম প্রথম হতাশ হলেও এখন আর এসব গায়ে মাখে না।
এ হচ্ছে লীনার বাহ্যিক। ভেতরটা ক’জন জানে? আমরা লীনাদের বাহ্যিকটাই দেখি। ভেতরটা জানার চেষ্টা না করেই নিজের মত করে তাকে বেশ্যা উপাধি খুব সহজেই দিয়ে দিই। কারণ, লীনারা মানুষ নয়, নারী! নারীর একা থাকার অধিকার নেই। তারা একা থাকতে গেলে এই সমাজ তাদের বেশ্যা উপাধি দিবেই। তাহলে কী একজন নারী নিজের ভালো মন্দের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না? সে অধিকার কী তার নেই?
কেন থাকবে না! তাই বলে ভালোবেসে ঘর বেঁধে আবার সে ঘর ছাড়তে হবে? বেশ্যারা ছাড়া ভালো মেয়েরা এমন কখনোই করে না। এই তো বলবেন? আচ্ছা বলুন তো, ‘ভালো মেয়ে’ আপনাদের সংজ্ঞায় কেমন? যারা স্বামীর অত্যাচার, নির্যাতন, স্বামীর অক্ষমতাকে মেনে নিয়ে মানিয়ে চলছে, তারা? উত্তর যদি হয় এমন, তবে বলব প্রতিটি মেয়েরই বেশ্যা হওয়া দরকার। বেশ্যাই ভালো।
কিভাবে বেশ্যা ভালো! তাহলে চলুন লীনা জীবনের সংক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা থেকে জেনে নিই? লীনার বর বিয়ের পর মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। লীনার চোখের সামনেই চেনা মানুষটা খুব সহজেই বদলে যেতে থাকে। লীনা নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে সূক্ষ্ম স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনার প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। সময় দিয়েছেন। চিকিৎসা করিয়েছেন। সংসারে হাল নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কিন্তু, এতেও কাজ হয় নি। বরং নেশার টাকার জন্য লীনার গায়েও হাত তোলা শুরু করে আলম।
ব্যর্থতার দায় নিয়ে পাঁচ বছরের মাথায় সেপারেশনে আসতে বাধ্য হয় লীনা। তবে ডিভোর্স নেন নি। বরং আলাদা থেকেও কৌশলে রিহ্যাবে ভর্তি করিয়ে আলমকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছি। সে ভেবেছিল, হয় তো ছেলে এবং আমার টানে আলম আবারও ফিরবে। না। আলম ফিরে নি। একসময় মৃত্যুটাই আলমের প্রাপ্য হয়। লীনা ডিভোর্সি নয়, বিধবা হয়।
লীনা এখনও একা আছে। এখনও তাকে শুনতে হয় ‘বেশ্যা’ শব্দটা। এখনও অনেকের ধারণা, বিবাহ বহির্ভূত ছেলেদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক তার আছে! তা না হলে একটি মেয়ে কী করে ভরা যৌবন নিয়ে এভাবে একা থাকে? এ সমাজ কিছুতেই এমন ভাবনা থেকে সরে আসতে পারছে না! এই সমাজ ততক্ষণ পর্যন্ত শান্ত নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত সে একজন নারীর ললাটে বেশ্যার তিলক এঁটে দিতে না পারবে।
লীনার মতো এমন আরও যারা একা থাকেন, তারাও বেশ্যা! লীনার মত যারা সংসার ছেড়ে একা থাকতে বাধ্য হয়েছে, তারাও বেশ্যা! যারা লীনার মত নিজের সিদ্ধান্তটা নিজে নিয়েছে, তারাও বেশ্যা! আচ্ছা, বলতে পারেন, এই সমাজ কবে কোন নারীকে বেশ্যা শব্দটা উপহার দেয় নি?
যে মেয়েটি পাবলিক বাসে পুরুষের নোংরামির শিকার হয়ে প্রতিবাদ করেছে, সেও বেশ্যা! যে মেয়েটি নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখতে গিয়ে পুরুষের নোংরা মুখটা এঁকেছেন, সেও বেশ্যা! যে মেয়েটি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে বিয়ে করবে না বলে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সেও বেশ্যা! যে মেয়েটা রাস্তায় ইভ-টিজিংয়ের শিকার হয়ে প্রতিবাদ করে, সেও বেশ্যা! যে মেয়েটি একা একা বাজার করে, সেও বেশ্যা! যে মেয়েটি নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে চেষ্টা করছেন, সেও বেশ্যা! যদি এ হয় বেশ্যা হওয়ার কারণ, তবে কী বলতে পারি না, প্রতিটি মেয়েরই বেশ্যা হয়ে উঠা উচিৎ? বলতে কী পারি না, বেশ্যাই ভালো?
লেখক: ব্লগার