ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনটি আমাদেরই করতে হবে

প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০১৬, ১৭:০০

আমার সময়টি ‘শিকারির শ্রেষ্ঠ সময়’। আর যেহেতু শিকারির অভয়ারণ্যে নারীকে ধর্ষণ করে, একই সঙ্গে অ্যাসিড ছোড়ে, ছুরি মারে, খুন করে বাথরুমে ফেলে রাখে, চলন্ত বাসে ধর্ষণ করে পার পেয়ে যাচ্ছে এসব ক্রূর শিকারি, দৃশ্যমান বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না তাদের কিংবা সহিংসতার মিছিল থামছে না দেখতেই পাচ্ছি, তখন আমি প্রথমে আমাকে অভিযুক্ত করছি ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনটি করে উঠতে পারিনি বলে, আমার যা সম্বল, তা নিয়েই আমি মাঠে নেই বলে।
 
টাঙ্গাইলের মেয়েটিকে তিন দিন দলবদ্ধ ধর্ষণ শেষে গ্রামের রেললাইনের পাশে ফেলে রাখার আগে-পরে কী আছে, হিসাব নিতে গিয়ে স্নায়ু অসাড় হয়ে যাচ্ছে! গত বছরের ৬ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের মেয়েটি ধর্ষিত হলো তো ৩১ ডিসেম্বর পঞ্চগড়ে ধর্ষিত হলো প্রথম শ্রেণীর এক ছাত্রী। পাতা কুড়াতে যাওয়া এই শিশুটিকে ধর্ষণ করল ৩৫ বছরের এক প্রতিবেশী। আর ইলিরা দেওয়ান বড় বেদনায় লিখলেন (৪ জানুয়ারি, প্রথম আলো), ‘টাঙ্গাইলের স্কুলছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়ে এখন হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। মেয়েটি মানসিক ভারসাম্য হারালেও বেঁচে আছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের কাউখালীর পিতৃহীন অষ্টম শ্রেণীর ফুটফুটে পাহাড়ি মেয়েটিকে দুর্বৃত্তরা বাঁচতেই দেয়নি। বাড়ি থেকে কয়েক শ গজ দূরে পাহাড়ের ঢাল থেকে গরু আনতে গিয়ে আর ঘরে ফিরে আসেনি। ধর্ষণের পরে দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যা করেছে।’ 
 
এর পরদিনই পত্রিকায় দেখি দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে এক নারী, যিনি তিন সন্তানের মা, দিনদুপুরে যাচ্ছিলেন বাবার বাড়িতে, দেবর ছিলেন সঙ্গে, আখখেতের পাশে তাস খেলছিলেন পাঁচজন পুরুষ, তাঁরা দেবরকে মেরে তাড়িয়ে দিয়ে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করলেন তাঁকে। রাজবাড়ীতে আমরা দেখলাম, ধর্ষণচেষ্টা মামলায় ছাড়া পেয়ে আসামি স্থানীয় ব্র্যাক স্কুলের শিশু শ্রেণীতে পড়ুয়া পাঁচ বছরের মেয়েটিকেই বাঁশবাগানে নিয়ে খুন করে ফেলল। রাঙামাটির লংগদুতে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী সুজাতা চাকমাকে ধর্ষণ ও খুনের দায়ে অভিযুক্ত মোহাম্মদ ইব্রাহিমও একই এলাকার অন্য এক পাহাড়ি শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় জেল থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসে ঘটান এ ঘটনা। দুই ক্ষেত্রেই ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টায় অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে বেরিয়ে এসে আরও বড় অপরাধ ঘটিয়েছেন।
 
একই সময়ে আমরা নীলফামারী জেলা সদরের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষিত হতে দেখলাম চাচাতো বোনের বিয়েতে যাওয়ার পথে। বাক্প্রতিবন্ধী দিনমজুর বাবার এই মেয়েটিকে তাঁর দুই প্রতিবেশীর দুই ছেলে গ্রামের একটি সেতুর কাছে নিয়ে ধর্ষণ করে ফেলে যায়। আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়তে ও দেখতে থাকি, খাবার সরবরাহকারী মায়ের কাজে সাহায্য করার জন্য শিশু মেয়েটি গেল টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে আসতে। কিন্তু সে আর ফিরে আসেনি। তাকে পাওয়া গেল ১০ দিন পর, ততক্ষণে সে ধর্ষিত, মৃত। প্রান্তিক নারী ও শিশুদের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত মেয়ে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীকে অ্যাসিডদগ্ধ ও ছুরিকাহত হতে দেখলাম বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায়। এ কোন আশ্চর্য সময় আমরা পার করছি, যখন বিয়ের কাবিননামা প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি একই মুহূর্তে পুরুষের এক হাতে থাকে অ্যাসিড, অন্য হাতে উদ্ধত ছুরি! আর সবশেষে দেখলাম, দিল্লির জ্যোতি সিং পান্ডের মতোই মানিকগঞ্জের বাসে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার পোশাক কারখানার এক নারী শ্রমিককে। বাসের হেলপার আর চালক ধর্ষণ শেষে তাঁকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন চলন্ত বাস থেকে।
 
মাত্র এক মাসের এ ধর্ষণ-খুন-অ্যাসিড নিক্ষেপের ধারাবাহিকতা যে নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়, তা হলো, চার বছরের শিশু থেকে তিন সন্তানের মা—কেউ নিরাপদ নন। প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকা থেকে ঢাকা শহরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের নারী—কেউ-ই বাঁচতে পারছেন না। ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, খুন ও চলন্ত বাসে দলবদ্ধ ধর্ষণ শেষে বাস থেকে ফেলে দেওয়া—এসবই সম্ভব, যদি কেউ ইচ্ছা করে। প্রতিটি ঘটনা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে, ধর্ষণের সঙ্গে ‘অন্য পক্ষের ইন্ধন’, ‘পোশাক-আশাকের শালীনতাহীনতা’, বা ‘চরিত্রহীনতা’র কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, পাঁচ বছরের শিশুর পক্ষে এসব কিছুই করা সম্ভব নয়। তাহলে? এই যে ইচ্ছা হলেই ধর্ষণ করা যায়, ধর্ষণ শেষে শ্বাস রোধ করে মেরে ফেলা যায়, প্রতিবেশীর ছেলে, সাবেক প্রেমিক কিংবা অচেনা ড্রাইভার—যে কেউ-ই যা কিছু করতে পারেন যেকোনো নারীর বিরুদ্ধে, তার উৎস কী? সাদা চোখেই তার উৎস হলো, বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর সমাজে নারীর ধর্ষণ-অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর ‘সম্ভ্রমহীনতা’র সনদ যোগ করে দেওয়ার সংস্কৃতির যৌথ মেলবন্ধন। বিচারহীনতার সংস্কৃতির সঙ্গে পুলিশ, প্রসিকিউশন, কোর্ট, কেস, কমিউনিটি—সবাই জড়িত। ধর্ষিতাকে প্রমাণ করতে হয় সে ধর্ষিতা। এটি যে কত কঠিন, সেটি বোঝা যায় শাজনীন ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় এমন প্রভাবশালী বাবারও ছয় বছর লেগেছিল বিচার পেতে! নীলফামারীর বাক্প্রতিবন্ধী দিনমজুরের মেয়েটির কেস কে লড়ে দেবে? কে নিয়ে আসবে রায়? তারই সঙ্গে যুক্ত হয় সমাজের সতীত্ব সংস্কার, যার বলি নির্যাতিত মেয়েটি। টাঙ্গাইলের মেয়েটিকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন তার বাবা, আশ্রয় জোটেনি মামার বাড়িতেও।
 
এসব বিষয়ে টক শো, আলোচনা, কলাম লেখা চলছে অবিরত। গণমাধ্যমকে ধন্যবাদ জানাই। পত্রিকার মধ্যপাতা থেকে ক্রমেই প্রথম পাতায় স্থান করে নিয়েছে এসব ঘটনা। ধারণা করি, ঘটনাগুলো আগেও ঘটেছে, প্রচার পায়নি। তবু কেন জোর প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না? প্রায় প্রতিটি টক শোয় একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে শুনতে পাই, কী করছে আমাদের নারী নেতৃত্ব? আরও একটি অবধারিত সম্পূরক প্রশ্ন এ প্রসঙ্গে, দিল্লির ঘটনায় যদি এত আন্দোলন হতে পারে, আমাদের এখানের নারীনেত্রীরা কী করেন? সাধারণ পাঠক-দর্শকের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, লেখক, এমনকি পরিচিত এক পুলিশ কর্মকর্তা পর্যন্ত দিল্লির সঙ্গে এই তুলনাটি করলেন সেদিন। যেহেতু দিল্লির সঙ্গেই তুলনাটি হচ্ছে বারবার, তাই দিল্লির প্রতিবাদ-প্রতিরোধ চিত্রের দিকেই তাকাই একটু। কারা ছিলেন দিল্লির প্রতিরোধে? শুধু কি নারীনেত্রীরা? কতজন মানুষ জড়ো হয়েছিলেন দিল্লির প্রতিবাদে? স্মৃতি সাহায্য না করলে আমরা যেন একটু মাস খানেক আগের পত্রিকা দেখি বা ইন্টারনেটে ঢুকি। যদি দিল্লির ঘটনাটিকে আমি একটুও বুঝে থাকি, তা হলো, সেখানকার প্রতিরোধকারীরা কোনো নারীনেত্রী বা সুশীল সমাজ বা মানবাধিকারকর্মী এসে তাদের আন্দোলনটি করে দিয়ে যাবেন, সে আশায় বসে ছিল না। তারা এসেছিল প্রাণের তাগিদে। হাজার হাজার মানুষ, নারী, পুরুষ, শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনীতিক-নির্বিশেষে এবং অবশ্যই তাঁদের মধ্যে নারীনেত্রী ও মানবাধিকার-কর্মীরাও ছিলেন। আমরা যদি সত্যিই গভীরভাবে আলোড়িত হই, তবে অন্য কেউ কেন আমার আন্দোলনটি করে দিচ্ছে না, সেই অপেক্ষায় না থাকি। অন্য কেউ আমার আন্দোলনটি করে দিয়ে যাবে আর দাতাগোষ্ঠী আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে—এ দুই ধারণায় মূলগত পার্থক্য কি খুব বেশি?
 
১৯৬৪ সালে কিটি জেনোভেস নামের এক নারীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল নিউইয়র্কে। প্রত্যক্ষদর্শীরা ভেবেছিল, এর দায় তাদের নয়, তাই মুখ খোলেনি। এ ঘটনার ওপর ভিত্তি করে সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজ মনোবিজ্ঞানীরা ১৯৬৮ সালে pluralistic ignorance and diffusion of responsibity নামের এক তত্ত্ব দাঁড় করান, যার মূল কথা হলো, সামষ্টিক অজ্ঞতা থেকেই নিজের দায়কে অন্যের কর্তব্য বলে ধরে নেওয়া। আজ যারা ধর্ষণের প্রতিরোধ আন্দোলনে নেই, ভাবার অবকাশ নেই যে তারা ধর্ষণবিরোধী নয়। বরং তারা খেয়াল করে দেখছে না হয়তো যে তারাই পারে আসল পরিবর্তনটি ঘটানোর সবচেয়ে শক্তিশালী নিয়ামক হিসেবে কাজ করতে। নারীনেত্রীরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করেননি, রাজনীতিকেরা এগিয়ে আসেননি, ধর্মীয় নেতারা ধর্ষণের বিরুদ্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি—তো কী আছে? দিল্লির আন্দোলনকারীরা তিনটি লক্ষ্যে বৃহত্তর প্রতিরোধ আন্দোলনে নেমেছিল: [ক] ধর্ষণ মামলার তদন্ত থেকে বিচার তিন মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে। [খ] রাষ্ট্রপতি যে শাস্তি হ্রাস করার ক্ষমতা ভোগ করেন, কোনো ধর্ষণ অভিযুক্তের বেলায় যেন তার প্রয়োগ না করেন। [গ] ক্যামেরা ট্রায়াল নিশ্চিত করতে হবে।
 
আমাদের সব ঘরে যত মেয়ে আছে, তাদের জীবনকে নিঃশঙ্ক করার জন্য আমাদের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনটি আমাদেরই করতে হবে। সরকারকে, রাষ্ট্রকে আসুন বলি, যথেষ্ট হয়েছে, এবার থামান।
 
লেখক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।